বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী সেলের ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার শিল্পীদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয়েছে ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী উৎসব ২০২৪।
সোমবার (১১ জুন) বিকেলে সাড়ে ৫টার দিকে জাতীয় চিত্রশালা মিলনায়তনে এ বর্ণিল অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়।
উৎসবে বাংলাদেশে বসবাসকারী ১৩টি সম্প্রদায়ের - চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, পাংখোয়া, খাসিয়া, লুসাই, রাখাইন, গারো, হাজং, সাঁওতাল, ওঁরাও এবং মণিপুরী শিল্পীরা অংশগ্রহণ করেন। তারা নিজ নিজ সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক ঐহিত্য পরিবেশন করেন। অনুষ্ঠানের শুরুতের ১৩টি সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণে উদ্বোধনী নৃত্য পরিবেশিত হয়। এরপর অনুষ্ঠানে উপস্থিত অতিথিদের মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে মূল পর্বের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সচিব সালাহউদ্দিন আহাম্মদ। বক্তব্যে তিনি বলেন- “শিল্পের সকল শাখায় আমরা কাজ করছি, মহাপরিচালকের নেতৃত্বে সব সম্প্রদায় ও জনগোষ্ঠিকে নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য প্রদান করেন বিশিষ্ট গবেষক সঞ্জীব ড্রং । তিনি বলেন- “আমরা যেন কোন ভাষা সংস্কৃতিকে হারিয়ে যেতে না দেই, মানুষের জন্য এই সংস্কৃতির জন্য আরো বেশি বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন। ভিন্ন ভিন্ন ভাষা জাতিকে স্বীকৃতি না দিলে ভাষা হারিয়ে যায়, সম্প্রদায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। প্রকৃতির সাথে এই সম্প্রদায়গুলোই যুক্ত তারাই প্রকৃতিকে রক্ষা করে চলেছে। আজকে জলবায়ু পরিবর্তনের কথা আমরা বলছি তার নিয়ন্ত্রক এই সম্প্রদায়গুলো।”
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী। সভাপতির বক্তব্যে তিনি বলেন- “প্রাথমিকভাবে যখন ১৩ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের উল্লেখ করে গেজেট প্রকাশ করা হয়, সেই ২০১০ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পক্ষ থেকে আমরাই ৫০ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের সন্ধান করি এবং পরবর্তীতে ৫০ সম্প্রদায়ের উল্লেখ করে গেজেট প্রকাশ করা হয়। তাদের মধ্যে আজ ১৩ সম্প্রদায়ের পরিবেশনা উপস্থাপন করেছে’। একাডেমির ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী সেলের মাধ্যমে নানান কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন মহাপরিচালক।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব রাজীব কুমার সরকার।
সাংস্কৃতিক পর্বের শুরুতেই কক্সবাজারের রাখাইন সম্প্রদায়ের ‘আর কে রাখাইন গ্রুপ’ দলনেতা ছেন ছেন ওয়ান রাখাইন এর নেতৃত্বে ‘প্রদীপ নৃত্য’ পরিবেশন করেন। রাখাইনদের কাছে প্রদীপ একটি শান্তির আলোক রশ্মি যা রাখাইনরা বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব বা প্রার্থনার কাজে মোমবাতি জ্বালিয়ে তা স্মরণ করে থাকে। পৃথিবীর সকলের মঙ্গল কামনায় রাখাইনরা এই ঐতিহ্যবাহী প্রদীপ নৃত্য পরিবেশন করে থাকে। এরপর ঢাকার চাকমা সম্প্রদায়ের ‘মনোঘর শিল্পী গোষ্ঠী’ শোভন দেওয়ান টিটুর নেতৃত্বে ‘চাকমাদের জীবনধারা’ তুলে ধরেন।
মূলত পাবর্ত্য চট্টগ্রাম এবং বাংলাদেশের বিখ্যাত নদগুলো নিয়ে একটি বন্ধুত্বের মেল বন্ধনের ওপর ভিত্তি করে চাকমা আদিবাসীদের নদী কেন্দ্রিক যে জীবন ধারা তা এ নৃত্যটিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
রাঙ্গামাটির ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের ‘রাঙ্গামাটি ত্রিপুরা কল্যাণ ফাউন্ডেশন’ শুক্লা ত্রিপুরার নেতৃত্বে পরিবেশন করেন ‘হজাগিরি নৃত্য’। হজাগিরি ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী মাঙ্গলিক নৃত্য, ত্রিপুরাদের মধ্যে ৩৬টি গোত্র রয়েছে। তাদের মধ্যে রিয়াং গোত্রটি অন্যতম। কোনো এক শুভ দিনে ১৪ হাজার দেবতার স্বরণ করে হরগে্ৗরী উদ্দেশ্যে দেশের মঙ্গলার্থে পরিবেশন করা হয়ে থাকে। মৌলভীবাজরের মনিপুরী সম্প্রদায়ের ‘জ্যোতিনন্দন’ দলটি ‘মন্দিরা নৃত্য’ পরিবেশন করেন।
নৃত্যটির দলনেতা হিসেবে ছিলেন জ্যোতি সিনহা। মনিপুরী নৃত্য একটি আবশ্যিক বাদ্যযন্ত্র মন্দিরা, মণিপুরি নারীদের নটপালা সংকীর্তন ‘খুবাক- ঈ্শৈ’ পরিবেশনায় মন্দিরা বাজিয়ে বিভিন্ন তালে লয়ে ছন্দে গান গাওয়া হয়। এই পরিবেশনায় মণিপুরী শিল্পীরা মৃদঙ্গের বিভিন্ন বোলে মন্দিরা বাজিয়ে মণিপুরী নৃত্য পরিবেশন করে।
রাঙামাটির পাংখোয়া সম্প্রদায়ের ‘পাংখোয় শিল্পীবৃন্দ’ লাল রৌবেল পাংখোয়া আবেলের নেতৃত্বে ‘শিং নৃত্য’ পরিবেশন করেন। সিয়াল কি দেং বা শিং নৃত্য বলা হয়। মৃতদের স্মরনোৎসব অতি ব্যায় বহুল ভোজ উৎসবের পালন করা। কেবল মৃত্যুর লোকের স্মরণার্থে এই নৃত্যনুষ্ঠান হয়ে থাকে। জীবকালে তার যশ,খ্যাতি ও নানান সুকীতি পরিবেশন করাই শিং নৃত্যনুষ্ঠান বিষয়বস্ত হিসেবে শুধু পুরুষরাই অংশগ্রহণ করে থাকে। ধারাবাহিক পরিবেশনায় নেত্রকোনার হাজং সম্প্রদায়ের ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি,বিরিশিরি নেত্রকোনা’ মালা মার্থা আরেং-এর নেতৃত্বে পরিবেশন করেন ‘জীবন ধারা’। সনাতন ধর্মাবলম্বী হাজং সম্প্রদায়ের দৈনন্দিন জীবনযাপন ও ধর্মীয় উৎসব উদযাপনের ঐতিহ্যবাহী ও বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির অন্তর্গত নৃত্য সমূহ যেমন, হালবাওয়া, রোয়া লাগানো ,জাখামারা (মাছধরা), লেওয়াতানা, দিউলী পূজা, মহিষাসুর বধ প্রভৃতি বহুল প্রচলিত ও জনপ্রিয় হাজং নৃত্য গুলো একসূত্রে গেঁথে,বৈচিত্র্যপূর্ণ এই নৃত্যগুলোর সংক্ষিপ্তরুপ পরিবেশনা।
মারমা সম্প্রদায়ের ঢাকার ‘কালারস অফ হিল’ অন্তুর দেওয়ানের নেতৃত্বে ‘উৎসব নৃত্য’ পরিবেশন করেন। মারমা‘রা উৎসবপ্রবণ একটি জাতি। তাদের রয়েছে নিজস্ব অক্ষর,ভাষা আর সংস্কৃতি। এই নাচে মারমাদের তিনটি উৎসবের কথা বলা হয়েছে সাংগ্রাই, বিয়ে এবং ভান্তে পোড়ানো। তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের ঢাকার ‘ফুকালাং শিল্পী গোষ্ঠী’ রুমেল তঞ্চঙ্গ্যা’র নেতৃত্বে পরিবেশন করেন ‘মাছ ধরা নৃত্য’। নদী মাতৃক দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। তার মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদী অন্যতম। এই কর্ণফুলী নদী রাঙামাটি তঞ্চঙ্গ্যাদের জীবন ধারার একটি অংশ। কর্ণফুলী নদীকে কেন্দ্র করে ছিল তাদের এই পরিবেশনা।
দিনাজপুরে বসবাসরত সাঁওতাল সম্প্রদায় তাদের ‘ঐতিহ্যবাহী নৃত্য’ পরিবেশন করে। নৃত্য পরিবেশনায় ছিল ‘হিহিড়ি পিপিড়ি শিল্পী গোষ্ঠী’ এবং দলনেতা ছিলেন কৃষ্ণা প্রিয়া মুর্মু। এই নৃত্যের প্রথম ও দ্বিতীয় অংশে সাঁওতালদের ধর্ষীয় উৎসব ‘বাহা’ও ‘সহরায়’ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এবং নৃত্যের তৃতীয় ও চতুর্থ অংশে ১৮৮৫ সালে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ এবং শোষণকারী মহাজন ও জমিদারদের বিরুদ্ধে সংঘটিত মহান সাঁওতাল বিদ্রোহ তুলে ধরা হয়েছে।
লুসাই সম্প্রদায়ের ঢাকার ‘তপস্যা’ নৃত্যদল পরিবেশন করে ‘বাঁশ নৃত্য’। নৃত্যটির দলনেতা ছিলেন ফিফা চাকমা। লুসাইদের অন্যতম ঐতিহ্যবাহি একটি নৃত্য হল বাঁশ নৃত্য মৃত ব্যক্তির স্মারণার্থে এই নৃত্যটি পরিবেশিত হয়ে থাকে। সিলেটে বসবাসরত খাসিয়া সম্প্রদায়ের ‘খাসি স্টুডেন্ট ইউনিয়ন’ জুলি খংলা’র নেতৃত্বে পরিবেশন করে দলীয় নৃত্য ‘একতাই বল’। খাসিয়া তরুণ/তরুণী একসাথে থাকতে বেশি পছন্দ করি যে কোন বিপদে - আপদে একে অপরের পাশে অবস্থান করে থাকি। এমনকি আমাদের পুঞ্জিতে যে কোন কাজে আমরা একতাবদ্ধভাবে সম্পাদন করতে পছন্দ করি। এই গানে মূলত খাসিয়া শিল্পীরা সেই বিষয়টিকে নৃত্যের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছে। ওঁরাও সম্প্রদায়েরে ঢাকার নৃত্যদল ‘কারসা’ পরিবেশন করে ‘মাড়ুয়া নাচ’। এই নৃত্যের দলনেতা ছিলেন বিথী কুজুর। ওঁরাও সম্প্রদায় হলো আনন্দপ্রিয় একটি জাতি। নিজেদের সকল পূজা পার্বন থেকে শুরু করে সামাজিক অনুষ্ঠান নাচ এবং গানের মাধ্যমে উদযাপন করে থাকে । তেমনই তাদের এই পরিবেশনা হলো ওঁরাও সম্প্রদায়ের বিয়ের অনুষ্ঠানকে ঘিরে যেখানে সকলে হাতে হাত ধরে পায়ের তাল মিলিয়ে মাড়োয়াকে বিয়ের মন্ডপকে কেন্দ্র করে নাচ করে থাকে।
অনুষ্ঠানের সবশেষ পরিবেশনা ছিলো গারো সম্প্রদায়ের নৃত্যদল ‘আনসেংআ আচিক ক্লাব’ এর প্রযোজনা ‘জীবন ও প্রকৃতি’। নৃত্যটির দলনেতা ছিলেন মিশ্রা চিসিম। এই গানে গারো সমাজে নারী-পুরুষ একসাথে কাজ করে। কাজে যাওয়ার সময় নারীরা মাথায় ঝুরি আর সন্তান সাথে নিয়ে যায়। জুম পাহাড়ে কাজ করার সময় পানি পিপাসা পেলে কাছের ঝর্ণার থেকে পানি পান করে। পাখিদের মিষ্টি মধুর ডাক ভেসে আসে। কাজ করতে করতে দিন শেষে সন্ধ্যা নেমে আসে। এভাবে পূর্বপুরুষ থেকে শুরু করে নিজেদের জীবন জীবিকা চালিয়ে যাচ্ছে। এই নৃত্য পরিবেশনের মাধ্যমে সমাপ্ত হয় এ উৎসব।
নয়া শতাব্দী/এসআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ