সংযমের মাস রমজানে উল্টোটা ঘটে বাংলাদেশে। অতি মুনাফার লোভে কৃত্রিমভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে কোটি কোটি রোজাদারকে কষ্ট দেয় একশ্রেণির ব্যবসায়ীরা। ইসলামি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোজাদারদের জিম্মি করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীর রোজাই কবুল হওয়ার কথা নয়।
রোজা এলেই প্রতিবছর অস্থিতিশীল হয়ে উঠে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার। অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে জিনিসপত্রের দাম। সব ধরনের জিনিস চলে যায় সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। এটা নতুন কোনো ঘটনা নয়- এই অবস্থা চলে আসছে দীর্ঘদিন থেকে। তবে এবার রোজা শুরুর দুই মাস আগে থেকেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে শুরু করে। এমন প্রেক্ষাপটে ভোক্তাদের আশ্বস্ত করে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেছিলেন, ‘রোজায় বাড়বে না নিত্যপণ্যের দাম।’ কিন্তু তার আশ্বাসের কোনো প্রভাবই পড়েনি রাজধানীর বাজারে। বরং সংযমের এ মাসে বাজারের ‘অসংযমী আচরণে’ দিশাহারা হয়ে পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষ।
দেশের একশ্রেণির ব্যবসায়ীরা কাজটি করেন বেশ সুচারুভাবে। ইসলামের দৃষ্টিতে রোজাদারের দায়িত্বই হলো সংযম, ত্যাগ ও পারস্পরিক সহমর্মিতা। ইসলাম বিশেষজ্ঞদের মতে, রোজা রেখে কেউ কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়ালে ওই ব্যক্তির রোজা কবুল হওয়ার বদলে গুনাহ হবে। খিলক্ষেত উত্তর নামাপাড়া জান্নাতুল ফেরদাউস জামে মসজিদের সাবেক খতিব ও ইমাম মাওলানা মো. আতিকুর রহমান বলেন, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বেশিরভাগ দেশেই রমজানে ব্যবসায়ীদের মাঝে দাম কমানোর প্রতিযোগিতা চলে। কিন্তু আমাদের দেশে সম্পূর্ণ উল্টো। এ ব্যাপারে ব্যবসায়ীদের অবশ্যই দায় রয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের নবী হজরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সা.) বলেছেন, ভবিষ্যতে দাম বাড়বে এবং অতি মুনাফা করবে এই আশায় জিনিসপত্র পুঁজি করে সে সব ব্যবসায়ী অভিশপ্ত এবং জাহান্নামি।
রাজধানীর নর্দ্দা এলাকার বাসিন্দা গণমাধ্যমকর্মী সৈয়দ রিফাত হাসান বলেন, রমজানের শুরুতেই নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছুর দাম হু হু করে বাড়লেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কিংবা সরকারের এ বিষয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না। শুধু সরকারের দু-একজন মন্ত্রী ও দলীয় শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার ফাঁকাবুলি দেয়া ছাড়া আর কিছুই করছে বলে আমরা দেখছি।রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতাদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পাওয়া গেছে। ক্রেতারা বলছেন, দেশে এখন কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেই। তাই ফসল উৎপাদনে ঘাটতির প্রশ্নই ওঠে না। এরপরও নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার কোনো যুক্তি নেই। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়াচ্ছে। বাজারের দ্রব্যমূল্যের গরমে ‘হাড্ডি গলছে’ গরিবের। তবে ব্যবসায়ীদের দাবি, বাজারে সিন্ডিকেট বলে কিছু নেই। আগের তুলনায় পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়া এবং অতিরিক্ত পণ্য কিনতে ক্রেতাদের প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতাই এজন্য দায়ী। বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যবসায়ীদের নিয়ে বৈঠক করছেন বাণিজ্যমন্ত্রী। রমজান উপলক্ষ্যে সংবাদ সম্মেলনও হলো। বিভিন্ন মনিটরিং সেলও গঠন করা হয়েছে। সংযমের মাসে পণ্যমূল্য নির্ধারণ করে দেয় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনও। এত আয়োজন! তবুও নিয়ন্ত্রণহারা নিত্যপণ্যের বাজার। সব ঘোষণা-ই যেন বুমেরাং। রমজানের দুই মাস পূর্ব থেকে লাগামহীন দ্রব্যমূল্য। যেন ক্রমেই নিয়ন্ত্রণহীন হচ্ছে বাজার।
এদিকে জনগণের দুর্ভোগের জন্য দায়ী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর হতে এবং তাদের বিচারের আওতায় আনতে সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মাদ সাহাবুদ্দিন। তিনি বলেন, ‘একটি মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সরবরাহ ও চাহিদার অবস্থা বিবেচনা করে পণ্যের দাম নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু আমাদের এখানে চাহিদা ও সরবরাহের সমন্বয়হীনতা নয়, বরং কারসাজি করে পণ্যের দাম বাড়ানো হয়। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। ’
রাষ্ট্রপ্রধান বলেন, বাংলাদেশে রমজান, ঈদসহ বিভিন্ন উৎসবের আগমনে দেখা যায় কোনো কোনো পণ্যের দাম হঠাৎ বেড়ে যায়। কিন্তু বিশ্বের অনেক দেশেই সাধারণত জাতীয়, ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব উপলক্ষ্যে পণ্যের দাম কমে যায়। তিনি বলেন, ‘এখানে কোনো উৎসব এলেই দেখা যায়, উৎসবকে পুঁজি করে কিভাবে জনগণের পকেট কাটা যায় তা দেখার অপেক্ষায় থাকে ক্ষুদ্র ও দানব ব্যবসায়ীদের একটি অংশ। ’‘দাম বাড়ালে কঠোর ব্যবস্থা’ সরকারের এমন হুঁশিয়ারি আমলে-ই নেয়নি ব্যবসায়ীরা। রমজান উপলক্ষ্যে শুধু দাম-ই বৃদ্ধি করা হয়নি, বাজারভেদে ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামতো দাম আদায় করছেন বলে ভোক্তাদের অভিযোগ। আবার ক্রেতাদের অভিযোগ, রমজান উপলক্ষ্যেই গলাকাটা দাম আদায় করছেন ব্যবসায়ীরা। এ মাসে দ্রব্যমূল্য সংযত রাখার কথা থাকলেও ব্যবসায়ীরা কথা রাখছেন না। সরকারের মনিটরিং এখন তথাকথিত। ভেঙে পড়েছে বাজারকাঠামো। শান্তিনগরের ব্যবসায়ী ইলিয়াস হোসেন বলেন, ‘আড়তে দাম চড়া, তাই আমাদেরও চড়া দামে সবজি বিক্রি করতে হচ্ছে। আমরা কম দামে কিনতে পারলে ক্রেতাদের কম দামে দিতে পারব।’ কচুক্ষেতে বাজার করতে আসা মাহবুব আলম বলেন, বাজারে এখন ডাকাতি হচ্ছে। রোজা উপলক্ষ্যে গোটা মুসলিম বিশ্বে পণ্যের দাম কমে।
আর আমাদের এখানে দ্বিগুণ হয়। প্রতিটি সবজির দাম গত এক সপ্তাহে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। মূল্যবৃদ্ধির দায় রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র তার দায়িত্ব পালন করলে এই নৈরাজ্য চলতে পারত না। মালিবাগ বাজারের মুদি দোকানি আমিনুল হক বলেন, ‘বাজার ঘুরে দেখেন কী পরিমাণ মানুষ! সবাই অতিরিক্ত জিনিস কেনে। এতে চাপ বেড়ে যায়। এটা জিনিসের দাম বাড়ার পেছনে বড় প্রভাব রাখে।’
ইতোমধ্যে বাজারে সব ধরনের ফল ও ইফতার পণ্য বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে। বিপরীতে আয় বাড়েনি বেশিরভাগ সাধারণ ক্রেতার। ফলে বাজারে গিয়ে তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ছে। উচ্চমূল্যের বাজারে যারা ফল কিনতে পারছেন না তাদের দীর্ঘশ্বাস ছাড়া কোনো উপায় নেই। বাজার ঘুরে খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খুচরা পর্যায়ে আপেল প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকা, যা গত বছর একই সময় ১৭০-১৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
প্রতি কেজি মাল্টা বিক্রি হচ্ছে ২২০-২৩০ টাকা, যা আগে ১৬০-১৮০ টাকা ছিল। কমলা বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকা, যা গত বছর একই সময়ে ছিল ১৫০ টাকা। এ ছাড়া খুচরা পর্যায়ে গত বছর ৪৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়া মরিয়ম খেজুর এখন ৭৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আজোয়া খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৭০০ টাকায়, যা আগে ৩৫০ টাকা ছিল। আর প্রতিকেজি সাধারণ মানের খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকা, যা আগে ১৬০ টাকা ছিল।বাজারে আসা ক্রেতা মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘খেজুরের দাম গত বছরের চেয়ে অনেক বেশি, প্রায় দ্বিগুণ দাম বেড়েছে। আমরা সাধারণ মানুষ খেজুর কিনতে হিমশিম খাচ্ছি। গত বছর যে খেজুর ১২০ টাকা ছিল সেই খেজুর এ বছরে ২০০-২৫০ টাকা কেজি কিনতে হচ্ছে। যেসব খেজুর ৫০০ টাকা কেজি ছিল তা ১৫০০ টাকা। ৮০০ টাকার খেজুর ১৬০০-১৭০০। আর ইফতার সামগ্রীসহ সব ধরনের জিনিসপত্রের দামও বেড়েছে। কিন্তু আয় আর বাড়েনি।’
খেজুর ব্যবসায়ীরা বলেন, ডলারের বিনিময়ে খেজুর কিনতে হয়। ডলারের দাম বৃদ্ধির ফলে খেজুরের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের দেশে চিনির দাম বাড়লে গুড়ের দাম বেড়ে যায়। বাজার মনিটরিং করা হচ্ছে না। হঠাৎ করে যে কোনো কিছুর দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। সকালে এক দামে কিনছি, বিকেলে আরেক দাম। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, কোনো পণ্যে কারা দাম বাড়ায় সরকারের উচিত হবে তা চিহ্নিত করা।
একই সঙ্গে কোন স্তর থেকে কতটা বাড়ানো হয় তার যৌক্তিক পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা নেয়া দরকার। দাম বাড়ার এ প্রবণতায় দুর্বল বাজার মনিটরিংয়ের কারণে ভোক্তাদের কাছে সুফল মিলছে না। তিনি আরও বলেন, নিত্যপণ্যের মূল্য কারসাজির সঙ্গে জড়িত সবাইকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। আদাবর কাঁচাবাজারে আসা ক্রেতা বুলবুল আহমেদ বলেন, ‘অসাধু ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে রোজার সময় পণ্যের দাম বাড়ায়। এতে বড়লোকের ক্ষতি না হলেও গরিবের সংসার পুড়ে ছাই হয়।’কারওয়ানবাজারের পাইকারি কাঁচামাল ব্যবসায়ী নুরুল ইসলাম বলেন, ‘পণ্যের কোনো ঘাটতি নেই ঠিকই, তবে রাস্তার অবস্থা তেমন ভালো নয়। এতে পরিবহন খরচ বেড়ে গেছে। ফলে দামও কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী।’ পণ্যের দাম বাড়ার পেছনে ক্রেতাদের অতিরিক্ত পণ্য কেনাকেই দায়ী করেন। কচুক্ষেত বাজারের মাছ ব্যবসায়ী বাবুল মোল্লা মূল্যবৃদ্ধির এই দায় দিলেন রাষ্ট্রকে। তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা চাইলেই সব করতে পারে না। সরকারের নজরদারি থাকলে অবশ্যই ব্যবসায়ীরা দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাধ্য। সব জায়গায়ই সিন্ডিকেট। পণ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজারে আনা পর্যন্ত সিন্ডিকেটের হাত থাকে।
রাস্তায় রাস্তায় চাঁদাবাজি। অথচ সব দায় এসে পড়ে আমাদের ওপর। সরকার সবই জানার কথা।’ রমজানে বাংলাদেশে জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও বরাবরই ব্রিটেনে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। বাঙালি, পাকিস্তানি, ভারতীয় গ্রোসারি শপ ও মাছ-মাংসের বাজারে রমজান উপলক্ষ্যে প্রতিবারই ঘোষণা দেয়া হয় বিশেষ ছাড়সহ নানা অফারের। এবারের রমজানও তার ব্যতিক্রমী নয়।
এমনকি বহুজাতিক ব্যান্ড টেসকে, আজদার মতো বড় প্রতিষ্ঠানগুলোও পবিত্র রমজান উপলক্ষ্যে ছোলা, বুট, চাল, জুসসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীতে বিভিন্ন অফার ও ছাড়ের ঘোষণা দিয়েছে। লন্ডন ও লন্ডনের বাইরে টেককো ও আজদার বড় স্টোরগুলোতে রীতিমত রোজা উপলক্ষ্যে বর্ণিল সাজে সাজানো হয়েছে আলাদা তাক।
সেখানে স্বাভাবিক মূল্যের চেয়ে কম দামে বিক্রি হচ্ছে ইফতার ও সাহরিতে ব্যবহূত বিভিন্ন নিত্যপণ্য। সাউথ ইস্ট লন্ডনের ক্রয়োডন এলাকার খান ক্যাশ অ্যান্ড ক্যারির স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ খান জানান, রমজান উপলক্ষ্যে প্রতিটি ক্যাশ অ্যান্ড ক্যারির মালিকরা চান তাদের কাস্টমাররা যেন রোজায় আমাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে সন্তুষ্টি নিয়ে ফিরে যান। এজন্য বিভিন্ন অফার দিয়ে নিজেদের মুনাফা কমিয়ে আমরা গ্রাহকদের সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করি।নয়া শতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ