ঢাকা, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

প্রি-পেইড মিটারে ‘ডিজিটাল’ ভোগান্তি

প্রকাশনার সময়: ২১ মার্চ ২০২৪, ০৭:৪২ | আপডেট: ২১ মার্চ ২০২৪, ১২:৫১

একরামুল হক-ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন পাওয়ার লিমিটেডের (ডিপিডিসি) বনশ্রী ডিভিশনের গ্রাহক। তার বাড়িতে বিদ্যুতের প্রি-পেইড মিটার ৩২টি। কিন্তু রিচার্জ করতে গেলে সবগুলোতেই দুই থেকে আড়াইশ ডিজিটের টোকেন নম্বর আসছে। ফলে রিচার্জ করতে গিয়ে অনেক সময় ও শ্রম দিতে হচ্ছে তাকে। তার মতে, ‘এটা হলো ডিজিটাল বিড়ম্বনা’।

একরামুল হক বলেন, প্রি-পেইড মিটার রিচার্জ করতে গেলেই ২২০টি নম্বর ওঠানো একটি বিরক্তিকর কাজ। সংশ্লিষ্টরা সফটওয়্যার আপডেট না করে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে গ্রাহককে দিয়ে কার্ড রিচার্জ করাচ্ছে। এতে করে ভুল হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

এভাবেই বিদ্যুতের প্রি-পেইড মিটার রিচার্জ নিয়ে চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছেন গ্রাহকরা। বিদ্যুৎ অফিসে ধরনা দিয়েও সুরাহা মিলছে না। বিষয়টি সমাধানে কাজ চলছে বলে দায় সারছে বিদ্যুৎ সংস্থাগুলো।

জানা গেছে, বিদ্যুতের প্রি-পেইড মিটার রিচার্জের ক্ষেত্রে সাধারণত ২০ ডিজিটের একটি টোকেন নম্বর আসে গ্রাহকের মুঠোফোনে। সেই টোকেন নম্বরটি মিটারে প্রবেশ করালে রিচার্জ সম্পন্ন হয়। কোনো ধরনের ভুল হলে সেই রিচার্জ আর সফল হবে না। একাধিকবার ভুল হলে মিটারটি লক হয়ে যায়। তবে ২০ ডিজিটের নম্বরটি কিছুটা সহজ হলেও বর্তমানে বিপত্তি বেঁধেছে। সেই ২০ ডিজিটের নম্বরটি এখন স্বাভাবিকের চেয়ে ১০-১২ গুণ বেশি অর্থাৎ ২০০ থেকে ২২০ ডিজিট আসছে। এ নিয়ে ভোগান্তিতে গ্রাহকরা। লম্বা এ ডিজিট মিটারে প্রবেশ করাতে একদিকে যেমন ভোগান্তি, অন্যদিকে ভুলের কারণে কখনো কখনো লক হচ্ছে মিটার।

ভোগান্তির বিষয়ে খিলক্ষেত এলাকার বাসিন্দা মো. সোহাগ হাওলাদার নামের এক ভুক্তভোগী বলেন, ‘আমার বিদ্যুতের মিটারটি বাসার সিঁড়ির নিচে। যেখানে বসাও যায় না, আবার দাঁড়িয়েও থাকা যায় না। এমন একটা জায়গায় কোমর বাঁকা করে দাঁড়িয়ে ২৪০টি ডিজিট নির্ভুলভাবে মিটারে প্রবেশ করানো বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। আবার তিনবার ভুল করলে মিটার লক হয়ে যাবে।

প্রথমবার আমার ভুল হয়েছিল, দ্বিতীয়বারে অনেকবার চেক করে সবগুলো ডিজিট মিটারে প্রবেশ করে রিচার্জ সম্পন্ন করেছি। দেশ ডিজিটাল হয়েছে, বর্তমানে আমাদের লক্ষ্য স্মার্ট বাংলাদেশ গড়া। ডিজিটাল দেশের সব কিছু হবে সহজসাধ্য, ঝামেলামুক্ত। কিন্তু হচ্ছে তার উল্টো। বিদ্যুতের প্রি-পেইড মিটার রিচার্জের এমন ভোগান্তিকে আমার কাছে ডিজিটাল ভোগান্তি মনে হচ্ছে।’

অঞ্জনা বেগম নামের আরেক গ্রাহক বলেন, ‘আমি মিটারে নম্বর প্রবেশ করাতে গিয়ে মিটার লক করে ফেলেছি। বারবার অফিসে জানালেও দুদিন পর অফিস থেকে লোক এসে ঠিক করে দিয়ে যায়।’

এ ব্যাপারে ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (ডেসকো) ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক খন্দকার জহিরুল ইসলামের মোবাইলে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া সম্ভব হয়নি।

আবার নারিন্দা এলাকার বাসিন্দা ও ডিপিডিসির গ্রাহক মকবুল হোসাইন বলেন, ‘আমি যখনই মিটারে পাঞ্চ করতে গিয়েছি, আমার মিটারটি লক হয়ে গেছে। অফিসে ফোন দিতে দিতে জীবন প্রায় শেষ হয়ে যায়। এটার জন্য আবার অফিসে যেতে হচ্ছে এবং অফিস থেকে লোক এনেছি। কিন্তু দীর্ঘক্ষণেও সমাধান হয়নি। আমি টাকা দিয়ে কেন ভোগান্তি কিনব।’

প্রি-পেইড মিটারে বিড়ম্বনার বিষয় নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ক্ষোভ ঝেড়েছেন কোনো কোনো গ্রাহক। গ্রাহক ভোগান্তির সমাধান কোথায় তা জানতে রাজধানীর বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোতে যোগাযোগ করা হয়।

এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিপিডিসির আইসিটি বিভাগের শীর্ষ এক কর্মকর্তা জানান, ডিপিডিসির প্রি-পেইড মিটার রিচার্জ সংশ্লিষ্ট সফটওয়্যার আপডেট না থাকায় গ্রাহকদের ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে রিচার্জ করতে হচ্ছে। ফলে গ্রাহকদের এই বিড়ম্বনায় পড়তে (কার্ড রিচার্জে ২২০টি নম্বর টিপতে হয়) হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক টেকনিক্যাল কিউএম শফিকুল ইসলামের মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ নোমান বলেন, বিদ্যুতের নতুন মূল্যহার সমন্বয় করতে গিয়ে দেখা দিচ্ছে এই সমস্যা। তবে কয়েকদিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে।

তবে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোর খামখেয়ালিপনার ফলে গ্রাহকদের এ ভোগান্তি হয়েছে বলে দাবি তথ্য প্রযুক্তিবিদদের। তাদের মতে বিকল্প আছে অনেক, প্রয়োজন কেবল প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহারের সদিচ্ছা।

তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সালাহউদ্দিন সেলিম বলেন, অনেক আধুনিক টেকনোলজি আছে। মিটারটিকে যদি এনএফসি কিংবা আরএফআইডি সিস্টেমে নিয়ে আসা যায়। তাহলে যে পেপার দেয়া হবে সেটি মিটারের কাছাকাছি ধরলে অটো স্ক্যান হয়ে মিটারে এন্ট্র্রি হয়ে যাবে অটোমেটিক্যালি। এই ম্যানুয়াল এন্ট্রি তো এই যুগে মানানসই নয়।

ডিপিডিসির বাসাবো ডিভিশনের আওতাধীন পূর্ব গোড়ান ৮ নম্বর রোডের বাসিন্দা রুবেল, সিয়াম, রাসেল মুঠোফোনে জানান, ‘আমরা তো সরকারের কাছ থেকে প্রি-পেইড মিটার চাইনি। সরকার একপ্রকার জোর করেই আমাদেরকে প্রি-পেইড মিটার বাড়িতে বসিয়ে দিয়েছে। এখন প্রি-পেইড মিটার রিচার্জ করতে গেলে ২২০টি নম্বর চাপতে হয়। এতে করে ভুল হওয়ার আশঙ্কা থাকে এবং এ এক বিড়ম্বনার কাজ।’

বাংলাদেশ সাধারণ নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘দেশের সব কিছু এখন ডিজিটাল হচ্ছে। ডিজিটাইজেশনের কারণে যেখানে সব কিছু সহজ হওয়ার কথা, সেখানে যদি একটি মিটার রিচার্জ করতে গ্রাহককে ২০০ থেকে ২২০টি ডিজিট প্রেস করতে হয়, তাহলে তো রীতিমতো ভোগান্তির ব্যাপার’। মিটার রিচার্জের প্রক্রিয়াটিকে জটিল না করে বরং কিভাবে গ্রাহকদের জন্য একে সহজ করা যায়- সে বিষয়ে সচেতন হতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের সিস্টেম অপারেশন পরিদপ্তরের পরিচালক (কারিগরি) মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘যখনই বিদ্যুতের মূল্য পরিবর্তন হয়, তখন মিটারে তার ইনপুট দিলে ২২০ ডিজিটের টোকেন আসে। নতুন মূল্যে প্রথমবার রিচার্জ করার পর, পরবর্তীতে মূল্য পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত আর এই সমস্যাটি হয় না।’

দীর্ঘ সারির এই ডিজিট মিটারে চেপে রিচার্জ করতে গিয়ে গ্রাহকের ভোগান্তির বিষয়টি স্বীকার করে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘এটি আসলে একটি কারিগরি বিষয়। ধীরে ধীরে আমরা সব মিটারকে অনলাইনে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাজ করছি, মিটারগুলো অনলাইন হয়ে গেলে গ্রাহকদের আর এ সমস্যা পোহাতে হবে না।’

এই কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে সারা দেশে পল্লী বিদ্যুতের প্রায় তিন কোটি ৪১ লাখ গ্রাহকের মধ্যে প্রি-পেইড মিটার ব্যবহার হচ্ছে ১৩ লাখ। এর মধ্যে ৯৮ শতাংশই আবাসিক গ্রাহক।

গ্রাহকদের ভোগান্তির বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে।

ঢাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-৩ এর মহাব্যবস্থাপক মোল্লা মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘যখনই বিদ্যুতের ট্যারিফ (মূল্য) পরিবর্তন হয়, তখনই তা করতে গিয়ে এ সমস্যাটি তৈরি হয়। তবে কিভাবে গ্রাহকরা এই ২২০টি ডিজিট চেপে মিটার রিচার্জ করবেন সেই পদ্ধতি ইতোমধ্যে আমরা আমাদের ওয়েবসাইটসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করেছি। এতে সাময়িকভাবে গ্রাহকদের ভোগান্তি হলেও ধীরে ধীরে গ্রাহকরা এর সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে যাবেন।’

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ