দেশে জ্বালানি তেলের দাম কমাল সরকার। প্রথমবারের মতো স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণের ঘোষিত প্রজ্ঞাপনে জ্বালানি তেলের দাম কমেছে। আজ শুক্রবার থেকে নতুন দর কার্যকর হচ্ছে। গতকাল বৃহস্পতিবার নির্ধারিত নতুন মূল্যের তথ্য জানিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়। প্রজ্ঞাপনে দেখা যায়, প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিনে দাম কমেছে ৭৫ পয়সা। পেট্রোলে কমেছে ৩ টাকা ও অকটেনে কমেছে ৪ টাকা।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, যখন গণপরিবহনের ভাড়া বেড়েছে, নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে, মানুষের ব্যয় বেড়েছে কয়েক গুণ, তখন এ সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। তবে জ্বালানি তেলের দাম লিটারে ৩ টাকা কমানোর সিদ্ধান্ত ভোক্তার তেমন কোনো কাজে না-ও আসতে পারে। এ সিদ্ধান্তে তেমন কোনো লাভ হবে বলে মনে করেন না গোলাম রহমান।
তিনি বলেন, ‘এই যে পেট্রোলের লিটারে ৩ টাকা করে দাম কমল, তাতে কি পরিবহনের ভাড়া কমবে? সাধারণ যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে এর কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়বে, তা মনে হয় না।’ জ্বালানির ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি এবং মাত্র ৩ টাকা করে দাম কমানোয় আসলে দুদিকেই ক্ষতি হলো বলে মনে করেন ক্যাব চেয়ারম্যান গোলাম রহমান। তিনি বলেন, এর ফলে একদিকে সরকারের রাজস্ব কমবে, আবার মানুষের দুর্ভোগও কমবে না।
জ্বালানি তেলের নতুন দাম নির্ধারণ করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জারি করা প্রজ্ঞাপনে প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ১০৯ টাকা থেকে কমে হয়েছে ১০৮ টাকা ২৫ পয়সা। ভেজাল প্রতিরোধে কেরোসিনের দাম ডিজেলের সমান রাখা হয়। অকটেনের দাম ১৩০ টাকা থেকে কমে হয়েছে ১২৬ টাকা। আর পেট্রোলের দাম ১২৫ টাকা থেকে কমে হয়েছে ১২২ টাকা।
গত ২৯ ফেব্রুয়ারি জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণের নির্দেশিকা প্রকাশ করে জ্বালানি মন্ত্রণালয়। তারই ধারাবাহিকতায় আজ প্রাইসিং ফর্মুলা অনুসারে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয়ের প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করা হলো। এর আগে, ২০২২ সালের ৩০ আগস্ট থেকে দেশের বাজারে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম লিটারপ্রতি ৫ টাকা কমিয়েছিল সরকার।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম তামিম বলেন, দাম কমানোর বিষয়টি হয়তো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু পেট্রোলের দাম ৩ টাকা কমানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই, অন্তত ১৫ টাকা কমানো যেত। যতটুকু কমিয়েছে তাতে পরিবহন মালিকরা ভাড়া কমাবেন না। বাড়তি টাকা ব্যবসায়ীদের পকেটে যাবে; সরকারের কোনো রাজনৈতিক সুবিধা হবে না।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, মানুষের সঙ্গে এক ধরনের রসিকতা হলো কিনা, তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। যে হারে দাম বেড়েছিল, সে হারে কমেনি। এটা কখনো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। যতটুকু কমেছে, তার আদৌ কোনো প্রতিফলন হয় কিনা, তা দেখতে চাই।
ইমেরিটাস অধ্যাপক ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এম এ সাত্তার মণ্ডল বলেন, ডিজেলের লিটারে ৭৫ পয়সা কমিয়ে কৃষকের তেমন কোনো সাশ্রয় হবে না। ডিজেলের দাম এক দফায় অনেক বাড়িয়ে সেখানে মাত্র ৭৫ পয়সা কমিয়ে কত লাভ হবে। এতে কৃষি ব্যবস্থায় তেমন কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে হয় না। কৃষির সত্যিকারের ভালো চাইলে শুধু কৃষির জন্য ব্যবহার হওয়া ডিজেলের দাম সন্তোষজনক কমানোর পরামর্শ দেন অধ্যাপক সাত্তার মণ্ডল।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, ফর্মুলা বা গাইডলাইন অনুসারে এখন থেকে প্রতি মাসেই জ্বালানি তেলের আমদানি বা ক্রয়মূল্যের আলোকে ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রয়মূল্য সমন্বয় করা হবে।
পেট্রোলের দাম কমেছে লিটারে ৩ টাকা। তাই বাসভাড়া তো কমা উচিত। এই যুক্তিই দিচ্ছিলেন কামরুল হাসান। তিনি রাজধানীর ফার্মগেট এলাকা থেকে উঠেছিলেন আবদুল্লাহপুর থেকে ফুলবাড়িয়া পর্যন্ত চলা ‘এয়ারপোর্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউ পরিবহন’-এর একটি বাসে। কামরুলের গন্তব্যের ভাড়া ২৫ টাকা। তিনি টাকাটা বের করে দিয়ে বাসচালকের সহকারীর সঙ্গে ভাড়া কমানোর যুক্তি দিচ্ছিলেন। মুচকি হেসে সহকারী হেলাল বললেন, ‘অহনো নোটিশ পাই নাই। পাইলে তো কমবোই।’ এবার কামরুল হাসানসহ একাধিক যাত্রীর অনুযোগ, তেলের দাম বাড়লে কোনো অপেক্ষা না করেই ভাড়া বাড়ে। কিন্তু এখন তেলের দাম কমেছে, তাহলে ভাড়া কমাতে এর জন্য নোটিশের অপেক্ষা কেন?
এদিকে দেশে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করা হলেও প্রতিবেশী দেশ ভারতের কলকাতায় বর্তমানে ডিজেল লিটারপ্রতি ৯২ দশমিক ৭৬ রুপি বা ১৩৩ টাকা ৫৭ পয়সা (১ রুপি সমান ১ দশমিক ৪৪ টাকা হিসেবে) এবং পেট্রোল ১০৬ দশমিক ০৩ রুপি বা ১৫২ টাকা ৬৮ পয়সায় বিক্রি হচ্ছে। যা প্রতি লিটার ডিজেলের দাম বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২৪ টাকা ৫৭ পয়সা ও পেট্রোল ২৭ টাকা ৬৮ পয়সা বেশি বলেও জানিয়েছে মন্ত্রণালয়।
গত বুধবার এক ব্রিফিংয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, আমরা সাশ্রয়ী মূল্যে গ্রাহকদের জ্বালানি দিতে চাই। এখন থেকে প্রতিমাসের প্রথম সপ্তাহে দাম নির্ধারণ করা হবে। স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা চালু হওয়ায় খরচ কমে আসবে। বিশ্ববাজারে যদি কোনো পরিবর্তন না হয়, তাহলে তেলের ক্ষেত্রে দাম আরও কমে আসবে।
দেশে জ্বালানি তেলের আমদানি, বিক্রয় ও বিপণন করে থাকে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বিপিসি। এর মধ্যে অকটেন ও পেট্রোল বিক্রি করে সব সময়ই মুনাফা করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। তবে ডিজেল বিক্রির ওপর বিপিসির লাভ-লোকসান নির্ভর করে থাকে। দেশে ব্যবহূত জ্বালানি তেলের ৭৫ শতাংশই ডিজেল। দীর্ঘ সময় ধরে ডিজেল বিক্রি করে মুনাফা করছে প্রতিষ্ঠানটি।
তবে জ্বালানি তেলের মধ্যে উড়োজাহাজে ব্যবহূত জেট ফুয়েল ও বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহূত ফার্নেস অয়েলের দাম নিয়মিত সমন্বয় করে বিপিসি। আর ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রোল ও অকটেনের দাম নির্ধারণ করে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। ভর্তুকির চাপ এড়াতে ২০২২ সালের আগস্টে গড়ে ৪২ শতাংশ বাড়ানো হয় জ্বালানি তেলের দাম। এরপর ব্যাপক সমালোচনার মুখে ২৩ দিনের মাথায় প্রতি লিটারে ৫ টাকা করে দাম কমানো হয়।
ভর্তুকি সমন্বয়ের কথা বলে দাম বাড়ানোর পর গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৪ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা মুনাফা করে বিপিসি। তার মধ্যে সরকারকে লভ্যাংশ দিয়েছে ২০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসেও (জুলাই-ডিসেম্বর) ৫০০ কোটি টাকার বেশি মুনাফা করেছে সংস্থাটি। এরপরও মূল্য সমন্বয় করা হয়নি।
নয়া শতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ