ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কত প্রাণে নড়বে টনক?

প্রকাশনার সময়: ০২ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | আপডেট: ০২ মার্চ ২০২৪, ০৭:৩৮

রাজধানীর এফআর টাওয়ারে আগুনের ঘটনায় ২৬ জন, চুড়িহাট্টায় ৭১ জন ও নিমতলী কেমিক্যাল গোডাউনের আগুনে ১২৪ জন এবং আশুলিয়ার তাজরিন গার্মেন্টের আগুনে ১১৭ জনের মৃত্যু হয়। এ ছাড়া মাঝেমধ্যেই বহুতল ভবনে আগুন লাগার সংবাদ পাওয়া যায়। এসব ঘটনার পর নড়েচড়ে বসে প্রশাসন।

কিন্তু কিছু অভিযানের পর থেমে যায় সব ধরনের তৎপরতা। ফলাফল ফের নতুন একটি ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। সর্বশেষ বেইলি রোডে গ্রিন কজি কটেজ নামের সাততলা ভবনটিতে আগুনে ৪৬ জনের মৃত্যু হয়। কিন্তু ওই ভবনে কোনো অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। ঝুঁকিপূর্ণ জানিয়ে ভবন কর্তৃপক্ষকে তিনবার চিঠি দেয়া হয়েছিল।

তারপরও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। গতকাল শুক্রবার সকালে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটি পরিদর্শনে গিয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন সাংবাদিকদের এ কথা বলেন।

এমন পরিস্থিতিতে নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, একটি ভবন নির্মাণ করতে পাঁচ সংস্থার অনুমতি নেয়া লাগে। সেগুলো হচ্ছে- রাজউক, সিটি করপোরেশন, গণপূর্ত, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ত্রাণ মন্ত্রণালয় ও ফায়ার সার্ভিস। ওই সংস্থাগুলো একটু কঠোর হলেই ত্রুটিপূর্ণ ভবন নির্মাণ করা সম্ভব হতো না।

কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় অদৃশ্য কারণে নিশ্চুপ থাকেন সংস্থার লোকজন। একটি ঘটনা ঘটার পরই বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল। এক্ষেত্রে এ সংস্থাগুলোর দায়িত্বপ্রাপ্তদের শাস্তির আওতায় আনা হলে এ ধরনের ঘটনা থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব হবে।

জানা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অতি ঝুঁকিপুর্ণ ভবন রয়েছে ১০৬৯টি। এ ছাড়া কমবেশি ঝুকিপূর্ণ ভবন রয়েছে ৩৭৮৬টি। ২০১৭ সালে ফায়ার সার্ভিসের এক পরিসংখ্যানে এ চিত্র উঠে আসে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের দাবি, বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক প্রতিনিয়ত ভবন পরিদর্শন করা হয়।

সেখানে কোনো ভবনের ত্রুটি থাকলে তা মালিকদের জানানো হয়। এবং করণীয় বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তু বেশিরভাগ মালিক পক্ষই তা মানেন না। ফায়ার সার্ভিসের অভিযানিক কোনো ক্ষমতা না থাকার কারণে বাড়ির মালিকদের সতর্ক করা ছাড়া কিছুই করণীয় থাকে না।

আর মালিক পক্ষের এ উদাসীনতার কারণেই বারবার এ ধরনের অগ্নিকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি ঘটছে। যদিও এ বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব রাজউকসহ আরও অনেকের। বিল্ডিং কোড মেনে তা নির্মাণ করা হয়েছে কিনা তা সময়মতো পরিদর্শন করলেই ত্রুটিপূর্ণ ভবন নির্মাণ করা সম্ভব হতো না।

সর্বশেষ বেইলি রোডের ভবনটিতে রাউকের অনুমতি না নিয়েই নকশা বহির্ভূত খাবারের দোকান বসানো হয়। ভবনটিতে আটটি রেস্তোরাঁ, একটি জুসবার (ফলের রস বিক্রির দোকান) ও একটি চা-কফি বিক্রির দোকান ছিল। ছিল মুঠোফোন ও ইলেকট্রনিকস সরঞ্জাম এবং পোশাক বিক্রির দোকানও।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের বরাত দিয়ে র‍্যাবের মহাপরিচালক এম খুরশীদ হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, নিচতলা থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। তিনি বলেন, ভবনে অনেকগুলো গ্যাস সিলিন্ডার থাকায় সেগুলো বিস্ফোরিত হয়ে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে যায়। রাজউক জানিয়েছে, ভবনটির অনুমোদন আটতলার। শুধু আটতলায় আবাসিক স্থাপনার অনুমোদন আছে।

রাজউকের নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) প্রকল্পের পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, ভবনটির এক থেকে সাততলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক অনুমোদন নেয়া হয়েছে। তবে তা শুধু অফিসকক্ষ হিসেবে ব্যবহারের জন্য। রেস্তোরাঁ, শোরুম (বিক্রয়কেন্দ্র) বা অন্য কিছু করার জন্য অনুমোদন নেয়া হয়নি।

ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, ভবনের নিচতলায় ‘স্যামসাং’ ও ‘গ্যাজেট অ্যান্ড গিয়ার’ নামের দুটি ইলেকট্রনিকস সরঞ্জাম বিক্রির দোকান, ‘শেখলিক’ নামের একটি জুস বার (ফলের রস বিক্রির দোকান) ও ‘চুমুক’ নামের একটি চা-কফি বিক্রির দোকান ছিল। দ্বিতীয় তলায় ‘কাচ্চি ভাই’ নামের একটি রেস্তোরাঁ, তৃতীয় তলায় ‘ইলিয়ন’ নামের একটি পোশাকের দোকান, চতুর্থ তলায় ‘খানাস’ ও ‘ফুকো’ নামের দুটি রেস্তোরাঁ, পঞ্চম তলায় ‘পিৎজা ইন’ নামের একটি রেস্তোরাঁ, ষষ্ঠ তলায় ‘জেসটি’ ও ‘স্ট্রিট ওভেন’ নামের দুটি রেস্তোরাঁ এবং ছাদের একাংশে ‘অ্যামব্রোসিয়া’ নামের একটি রেস্তোরাঁ ছিল। অবশ্য ভবনের ছবিতে সপ্তম তলায় ‘হাক্কাঢাকা’ নামের একটি রেস্তোরাঁর সাইনবোর্ড দেখা যায়, যা ফায়ার সার্ভিসের হিসেবে আসেনি।

রাজউক যেমন বলছে যে ভবনটিতে রেস্তোরাঁ বা পোশাকের দোকানের অনুমোদন ছিল না, তেমনি ফায়ার সার্ভিসও বলছে, ভবনটিতে অগ্নিনিরাপত্তায় ঘাটতি ছিল।

ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বেইলি রোডে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ভবনটিতে কোনো অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল না। ঝুঁকিপূর্ণ জানিয়ে ভবন কর্তৃপক্ষকে তিনবার চিঠি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এদিকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, নিমতলীতে ১২৪ জন মারা যাওয়ার পরে কি হয়েছে? কিছুই হয়নি।

নিমতলীর পর চুড়িহাট্টার ঘটনা ঘটেছে, আবার বনানীতে আগুনে ২৬ জন মারা যায়। এভাবে একের পর এক ঘটনা ঘটেই চলেছে। বৃহস্পতিবার বেইলি রোডে ৪৬ জন মারা গেছে। এ মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে শুনেছি আমি। গতকাল শুক্রবার বিকেলে বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে তিনি এসব কথা বলেন।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, এতগুলো মানুষ মারা গেছে এরচেয়ে দুর্ভাগ্য আর কিছুই হতে পারে না। আমরা বারবার একই ঘটনা দেখতে পাচ্ছি, এরপর কিছুদিন এ ঘটনায় উত্তপ্ত থাকে তারপর আবার আগের মতোই হয়ে যায়।

তিনি বলেন, আগুন লাগা সাততলা ভবনটিতে একটি মাত্র সিঁড়ি, বের হওয়ার পথ ছিল না। যেই একটি মাত্র সিঁড়ি ছিল সেখানে আবার গ্যাসের সিলিন্ডারে পরিপূর্ণ। এগুলো অত্যন্ত ভয়ঙ্কর ব্যাপার। এ রকম একটা অবস্থায় আপনি কীভাবে অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা করবেন। এসব ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের অবশ্যই দায় আছে। বিশেষ করে যেসব বাণিজ্যিক ভবনে এ রকম অবস্থা সেখানে ফাস্ট সেফটি নিশ্চিত করা তাদের দায়িত্ব ছিল বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, গত বছরের ৪ জুন আমরা একটা জাতীয় সেমিনার করি। সেখানে আমরা নিমতলীর ঘটনা, চুড়িহাট্টার ঘটনা, বঙ্গবাজারের ঘটনা, নিউ মার্কেটের ঘটনাসহ বড় বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে পর্যালোচনা করি। সেখানে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সুপারিশ করি। কিন্তু সেসব সুপারিশের আজ পর্যন্ত কোনো কাজ হয়নি।

তিনি আরও বলেন, আমরা জানতে পেরেছি এখানে রেস্টুরেন্টে পার্টি হচ্ছিল। কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টে ২০ পার্সেন্ট ডিসকাউন্ট দিয়েছিল যে কারণে মানুষের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। কিন্তু তারা আর জীবন নিয়ে ফিরতে পারলেন না।

আমাদের জাতীয়ভাবে দুর্ভাগ্য আমরা কেউ এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড নিয়ে সচেতন হচ্ছি না। আমাদের কর্তৃপক্ষকে এখন বাধ্য করতে হবে ফায়ার সেফটি নিশ্চিত করতে বলেও জানান তিনি। উপস্থিত সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখানে অবশ্যই অবহেলা ছিল। এত বড় একটি বাণিজ্যিক ভবন সেখানে অগ্নি নির্বাপক থাকবে না? আর এটা না থাকার কারণে মানুষ পাগলের মতো ছোটাছুটি করেও বের হতে পারেনি।

কর্তৃপক্ষের অবহেলা সম্পর্কে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, এখনো দেখেন পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যালের গোডাউন সরেনি। কাদের দায়িত্ব্ব এটা সরানোর? ফায়ার সার্ভিস সরানোর জন্য একের পর এক নোটিশ করবে আর এগুলো সরবে না এটা তো হতে পারে না।

এ মৃত্যুকে তিনি হত্যাকাণ্ড বলবেন কি না এমন এক প্রশ্নে তিনি বলেন, এত কিছুর পরেও যদি কর্তৃপক্ষের টনক না নড়ে তাহলে তো আর কিছু বলার নেই। উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে তিনি বলেন, আসলে কি টনক নড়েছে? নিমতলীতে ১২৪ জন মারা যাওয়ার পরে কি হয়েছে? কিছুই হয়নি। নিমতলীর পর চুড়িহাট্টাসহ রাজধানীর কয়েকটি স্থানে আগুনের ঘটনা ঘটেছে। একের পর এক ঘটনা ঘটেই চলেছে।

ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, এ রকম ঘটনা ঘটতে থাকা মানে হলো আমরা অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগে বসবাস করছি। তাই এ অগ্নিকাণ্ড থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের আলোর দিকে এগিয়ে যেতে হবে।

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ