ঢাকা, শনিবার, ৫ অক্টোবর ২০২৪, ২০ আশ্বিন ১৪৩১, ১ রবিউস সানি ১৪৪৬

‘উধাও’ শুল্ক সুবিধার ফল

প্রকাশনার সময়: ০১ মার্চ ২০২৪, ০৭:৩৯

রোজার বাকি দুই সপ্তাহের কম সময়। মুসলমানদের এই ধর্মীয় উপলক্ষ্যকে সামনে রেখে পণ্যমূল্য সহনীয় রাখতে চায় সরকার। শুল্কছাড় ছাড়াও বাড়ানো হয়েছে বাজার তদারকি। সিন্ডিকেট এবং মজুতদারদের বিরুদ্ধে দেয়া হচ্ছে হুঙ্কার। তারপরও নেই দাম কমার লক্ষণ। উল্টো রমজান যতই এগিয়ে আসছে লাগামহীন নিত্যপণ্যের বাজার।

টিসিবির হিসাব বলছে, গত বছরের তুলনায় এবছর রোজার আগে প্রয়োজনীয় সব পণ্যের দামই ঊর্ধ্বমুখী। এদিকে দাম সহনীয় রাখতে কয়েকটি পণ্যে শুল্ক ছাড় দিয়েছে সরকার। এরপরও সুফল পাচ্ছেন না সাধারণ মানুষ। শুধু শুল্ক ছাড়ের প্রভাব পড়বে সয়াবিন তেলে। আজ ১ মার্চ থেকে কমছে সয়াবিনের দাম। অন্যান্য শুল্ক ছাড় করা পণ্যের দামের ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন নেই। বরং দাম বাড়তির দিকে। নতুনভাবে বাজারে বেড়েছে চিনির দামও। ব্যবসায়ীরা বলছেন, দাম বেশি থাকায় পণ্য কেনা কমিয়েছেন ক্রেতারা।

এ বিষয়ে ক্রেতা তানভীর হাসান বলেন, বাজারে সবকিছু ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। সবার জন্য বাজারের জিনিসপত্র কেনা কঠিন। কিছু মানুষ আছে যারা কিনতে পারে, তবে বেশির ভাগ মানুষের জন্য খুবই কষ্টকর। খেজুরে বড় ধরনের শুল্ক ছাড় দিয়েছে সরকার। তবে এখনো বেশি দামেই বিক্রি হচ্ছে রোজায় প্রয়োজনীয় এ পণ্য।

উল্টো কেজিতে দাম বেড়েছে ১০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। রাজধানীর খেজুর বিক্রেতা মো. ছোলায়মান মিয়া বলেন, জাম্বুরা নামে এক জাতের খেজুর আছে, এটির এখন দাম এক হাজার ৮০০ টাকা। কয়দিন আগেও ছিল এক হাজার একশ থেকে দুইশ টাকা। মারিয়াম ছিল ছয়শ থেকে সাতশ টাকা কেজি, এখন এক হাজার। সব খেজুরের দাম বেড়েছে। মাশরুক এতদিন ছিল এক হাজার থেকে এক হাজার দুইশ টাকা কেজি, এখন দেড় হাজার বিক্রি হচ্ছে।

এদিকে চিনির দামেও স্বস্তি নেই। খুচরা পর্যায়ে ১৪৫ থেকে ১৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে খোলা চিনি। প্যাকেট চিনির দাম আরও বেশি। ছোলার দামও কমেনি। বরং গেল বছরের চেয়ে দাম কেজিতে বেড়েছে ২০ থেকে ৩০ টাকা।

এক খুচরা ব্যবসায়ী বলেন, বর্তমানে বাজারের যে অবস্থা ক্রেতা নেই বললেই চলে। বিক্রি কমেছে। আমাদের দোকানে যে খরচ হয়, সেটি তোলাই কঠিন হয়ে পড়েছে। সবকিছুর দাম বাড়তি। এখানে তো আমাদের কোনো হাত নেই। বেশি দিয়ে কিনতে হচ্ছে, তাই বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।

আরেক দোকানি মো. কামাল হোসেন বলেন, কাবলি ও ছোলা আনতে গিয়েছিলাম। পাইকাররা দেয়নি। বলেছে, কয়দিন পরে নিতে। তখন নাকি দাম কমবে। খুচরা পর্যায়ে কেজিপ্রতি পেঁয়াজের দাম উঠেছে এখন ১৩০ টাকা পর্যন্ত। কয়েকদিনের ব্যবধানে কেজিতে অন্তত ২০ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে ব্রয়লার মুরগির দাম। শবেবরাত এবং রোজাই মূল্যবৃদ্ধির কারণ। গরুর মাংসের দামও এখন বাড়তির দিকে। কেজিপ্রতি ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকার বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে এই মাংস। গুটিকয়েক মাংস ব্যবসায়ী ক্রেতাদের জিম্মি করে বাড়িয়ে দিয়েছে দাম।

রাজধানীর এক বয়লার মুরগি ব্যবসায়ী বলেন, গত ১০ থেকে ১৫ দিন আগেও ১৮০ থেকে ১৯০ টাকা কেজিতে মুরগি বিক্রি করেছি। আজকে (শবেবরাতের দিন) বাজার দর ২৩০ টাকা। আমাদেরকে দুইশর বেশি দিয়ে কিনতেই হয়েছে।

তবে মনিটরিংয়ের নামে মাঝে মাঝে ভোক্তা অধিকারের কর্মকর্তাদের ‘দৌড়াদৌড়িতে’ বাজার নিয়ন্ত্রণে আসবে না জানিয়েছেন কনজ্যুমার ফোরামের সাধারণ সম্পাদক এমদাদ হোসেন মালেক। তিনি বলেন, বাজারের যে ব্যবস্থাপনা, সেখানে গুটিকয়েক লোক আমদানিকারক। আরও আমদানিকারক বাড়াতে হবে। রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি ব্যতীত, বাজারে একে অপরকে দোষারোপ করে এবং আহ্বান জানিয়ে কিংবা কারো ওপর চাপ তৈরি করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। আমদানিকারক বাড়াতে হবে। অন্যথায় ভোক্তার কর্মকর্তাদের দৌড়াদৌড়িতে বাজার নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয়।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বলছে, গত এক মাসের তুলনায় প্রায় ২০ ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। গত মাসে এ সময় বাজারে প্রতি কেজি ছোলার দাম ছিল ৯৫ থেকে ১১০ টাকা। সেই হিসাবে এক মাসে ছোলার দাম বেড়েছে ১৬ শতাংশ। চিনির দাম ১৪০-১৪৫ টাকা থেকে বেড়ে এখন ১৪৫-১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সাধারণ মানের খেজুর প্রতি কেজি ২৫০-৪৫০ টাকা থেকে বেড়ে এখন ২৫০ থেকে ৮৫০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। পেঁয়াজ প্রতি কেজি ৭০-৯০ টাকা থেকে বেড়ে এখন ১১৫-১২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খোলা সাদা আটা ৪৫-৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৫০-৫৫ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। এখন সরু চাল ৬৫-৭৮ টাকা, মাঝারি চাল ৫৪-৫৮ টাকা এবং মোটা স্বর্ণা ৫০-৫২ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।

কারওয়ানবাজারের মেসার্স নুর ট্রেডার্সের বিক্রেতা জানান, চিনি ১৪৫ টাকা কেজি বিক্রি করছেন তারা। ‘গত বছর ছোলা বিক্রি করেছিলাম ৮০ টাকা কেজি, এখন ১০৫ টাকা বিক্রি করছি।’

প্রতি বছর রমজানকে ঘিরে ছোলা ও চিনির মতো সয়াবিন তেলের দাম বৃদ্ধির আশঙ্কায় থাকেন ভোক্তারা। এবারও তাই হয়েছে। বিক্রেতাদের শঙ্কা, পুরানো সেই স্টাইলে রমজানের আগে আরেকদফা দাম বাড়ানোর তৎপরতা চালাতে পারে প্রতিষ্ঠানগুলো।

এদিকে তেল ও চিনির মতো ছোলার বাজারও নিয়ন্ত্রণ করছে কয়েকটি করপোরেট গ্রুপ। এমন অভিযোগ ছোট আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের। তাদের মতে, বড় আমদানিকারকদের আধিপত্যেই বাড়ছে ছোলার দাম। তবে পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, দাম কিছুটা বাড়তি হলেও রমজানে সরবরাহের সংকট হবে না। আর বিশ্লেষকদের মতে, এবার দেশি ছোলার মৌসুমেই শুরু হচ্ছে রমজান। তাই দাম না বেড়ে বরং কমার সম্ভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি সয়াবিন তেলের বাজার স্থিতিশীল রাখতে বড় পাঁচটি কোম্পানির আধিপত্য রুখতে হবে বলে মত বাজার বিশ্লেষকদের।

খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, রমজানকে সামনে রেখে ১৫ থেকে ২০ দিন আগেই ক্রাইসিস দেখানো হয়। এ সুযোগে তারা দাম বৃদ্ধি করেন। দাম বৃদ্ধির বিষয়টি ভোক্তা অধিদপ্তর ও গণমাধ্যমে আসতে কিছুদিন সময় লাগে। আর এই সময়ে তারা হাজার হাজার কোটি টাকা লাভ করে নিয়ে যায়।

আবার পাইকারী ব্যবসায়ীরা জানান, দাম বাড়তি থাকলেও সরবরাহ লাইন ঠিকঠাক আছে। বাজার এখন স্বাভাবিক। সব মিলে ডেলিভারিও ক্লিয়ার আছে। একই দাবি আমদানিকারকদেরও। তারা বলেন, সবারই মাল স্টক আছে। সংকটের কোনো কারণ নেই।

তবে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু জানিয়েছেন, রোজায় ভোক্তা পর্যায়ে পণ্য সরবরাহ ও দাম নিয়ে যাতে কোনো বিভ্রান্তি না থাকে সে জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে মন্ত্রণালয়। রমজান শুরুর এক সপ্তাহ আগে সেটির বাস্তবায়ন হবে।

বাজারে কারসাজি ও মজুতদারি কমে এসেছে দাবি করে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আরও জানান, রমজানে নিত্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে পণ্য পরিবহন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বসবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। পরিবহনে ভাড়া না বাড়াতে অনুরোধ করা হবে। প্রয়োজনে নিত্যপণ্য পরিবহনে ট্রাকের ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়া হবে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু।

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ