শীত শেষ, গরমের হাতছানি। বাড়ছে বিদ্যুতের চাহিদা। বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ফিরতে শুরু করেছে লোডশেডিং। মাত্র ১০ হাজার মেগাওয়াট চাহিদারও পুরোটা মেটানো যাচ্ছে না এ সময়। অথচ গ্রীষ্মে তা নিতে হবে সাড়ে ১৭ হাজারে। আর এই লক্ষ্য পূরণে জ্বালানি কেনার টাকার জোগানই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ— বলছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তার মতে, অর্থায়ন আটকে গেলে সংকট বড় হতে পারে আবারও।
জানা গেছে, জানুয়ারির প্রায় পুরোটা সময় এবার বিদ্যুতের উৎপাদন ছিল ৮ হাজার মেগাওয়াটের আশপাশে। কখনো তা নেমে যায় ৬ হাজারের ঘরে। বর্তমান সক্ষমতার যা ২৫ শতাংশের নিচে। তবে সপ্তাহখানেক ধরে শীতের তীব্রতা কিছুটা কমায় একটু একটু করে বাড়ছে চাহিদা। কিন্তু এটা মেটাতেও লোডশেডিং করতে হচ্ছে প্রায়ই।
আর মাত্র কয়েকদিন পর রমজান আর পাশাপাশি সেচ মৌসুম শুরু হলে তখন সর্বোচ্চ চাহিদা দাঁড়াবে সাড়ে ১৭ হাজার মেগাওয়াটে। যাতে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে জ্বালানি সংকট। কারণ, এর ১৫ হাজার মেগাওয়াটই আনতে হবে গ্যাস, কয়লা ও ফার্নেস তেল পুড়িয়ে। আর এসব জ্বালানি আমদানিতে অর্থের জোগানই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
জানা গেছে, নিকট অতীতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বহুল ব্যবহূত ফার্নেস অয়েল প্রতি টনের দাম ছিল ৩০০ ডলারের মতো। আমদানি পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট, অগ্রিম কর (এটি) ৫ শতাংশ ও ১০ শতাংশ ডিউটি মিলে ৩৫ শতাংশ ডিউটির পরিমাণ হতো ১০৫ ডলারের মতো। অর্থাৎ ডিউটিসহ পণ্যটির দাম পড়ত ৪০০ ডলারের মতো। সেই ফার্নেস অয়েল টনপ্রতি দাম ওঠে ৭০০ ডলারের মতো, তখানা প্রায় ৩৫ শতাংশ ডিউটি আদায় করা হতো। এতে প্রতি টনে ২৪৫ ডলারের মতো ডিউটি দিতে হতো। যা আগের পণ্যের দামের কাছাকাছি। এতে করে পণ্যটির দাম আকাশচুম্বী হয়ে পড়ে।
এ কারণে অনেকদিন ধরে মূল্যভিত্তিক ভ্যাট কাঠামো ভেঙে পণ্যের পরিমাণভিত্তিক ভ্যাট চালুর দাবি করে আসছিল বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়। অনেক দেশেই পরিমাণভিত্তিক কাঠামো অনুসরণ করা হয়। বাংলাদেশেও বিষয়টি অনুসরণ করার বিষয়ে এনবিআর ও মন্ত্রণালয়ের মধ্যে রশি টানাটানি চলছে। এছাড়া গেল নভেম্বর থেকে এলএনজিবাহী একটি জাহাজ বন্ধ থাকায় গ্যাস সংকট চলছে পুরো দেশে। যার কাটার সম্ভাবনা নেই আগামী ২০ মার্চের আগে। অন্যদিকে বিপুল বকেয়া পড়ে আছে বিদ্যুকেন্দ্র, আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি এবং বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে। আইটিএফসির সঙ্গে ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি কিছুটা স্বস্তির খবর দিলেও চিন্তা রয়েছে দীর্ঘমেয়াদে সমাধান নিয়ে।
পিডিবির এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সরকার ব্যাংকগুলোকে বন্ড ইস্যু করে বিলগুলো পরবর্তীতে দেওয়ার সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু এ ব্যাংকগুলোতে তারল্য এবং ডলার সংকট তো রয়েই গেছে। বেশি দামের ডিজেলচালিত কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয়ে তিনি বলেন, পিডিবির গ্রীষ্মকালীন পরিকল্পনায় এগুলোকে ব্যাকআপ হিসেবে রাখা হয়েছে। গত বছর ১৬ হাজার ৯৬ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে ১৯ এপ্রিল সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছিল ১৫ হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট।
বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, অর্থায়ন ঠিক থাকলে আমরা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দিতে পারব। আমাদের যথেষ্ট পাওয়ার প্ল্যান্ট আছে। সেক্ষেত্রে আমরা বিদ্যুৎ সঞ্চালন করতে পারব। আমাদের এখন ট্রান্সমিশন, ডিস্ট্রিবিউশন, পাওয়ার প্ল্যান্টের জেনারেশনের কোনো চ্যালেঞ্জ নেই। মূল চ্যালেঞ্জ হলো গ্যাস নিয়ে এসে সময়মতো দেয়া। দেশের গ্যাসের সর্বোচ্চ ব্যবহার করা। আর তেল সময়মতো দেয়া।
তিনি বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনে আমাদের অর্থ বেশি লাগে। কারণ, খরচ বেশি হয়। ফলে অর্থের জোগান ঠিকমতো থাকলে আগামীতে লোডশেডিং হবে না। বিদ্যুৎ সচল থাকবে। এমন সংকটের মধ্যে নতুন করে জনমনে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির গুঞ্জন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পরিকল্পনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, তবে এই লক্ষ্য অর্জন নির্ভর করবে আমদানিকৃত গ্যাস, কয়লা ও তেলের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের ওপর, যা সরকার ডলারের মজুদের ওপর চাপ তৈরি করবে বলে নিশ্চিত করতে পারছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯৯০ কোটি ডলার, যা বড়জোর তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য যথেষ্ট। এরই মধ্যে, ঢাকা এবং দেশের অন্যত্র অনেক এলাকা প্রতিদিন ৫০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুতের ঘাটতির সম্মুখীন হচ্ছে, যখন চাহিদা সর্বোচ্চ পর্যায়ের ধারেকাছেও নেই।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে পিডিবি ১১ হাজার মেগাওয়াটের বেশি চাহিদার বিপরীতে সন্ধ্যার পিক আওয়ারে ৯ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট থেকে ১০ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে, যার অর্থ ঢাকা ও অন্যান্য এলাকার মানুষ বিদ্যুতের চাহিদা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছানোর আগেই প্রতিদিন লোডশেডিংয়ের সম্মুখীন হচ্ছে। জানুয়ারির শেষার্ধে যখন তাপমাত্রা আরও কম ছিল তখন থেকেই লোডশেডিং শুরু করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি। এদিকে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, আগামী মার্চ মাস থেকে সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়াতে যাচ্ছে। শিগগিরই এ বিষয়ে গেজেট প্রকাশের কথা আছে। যার অর্থ, যখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তখন বিদ্যুৎ সরবরাহের কোনো উন্নতি না হলেও বেশি বিল গুনতে হবে ব্যবহারকারীদের। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে জ্বালানির দাম সমন্বয় করার আগে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির পেছনে কোনো যুক্তি নেই। তিনি বলেন, যদি দাম বাড়ানো হয় তার প্রভাব পড়বে সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এবং মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে।
অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে মূল্যস্ফীতির গড় হার ছিল ৯ দশমিক ৭ শতাংশ, যা সরকারের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ৫ শতাংশের চেয়ে অনেক বেশি।
গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সরকার যতই গতানুগতিক উপায়ে জ্বালানি ঘাটতি সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করবে, ততই একটি দুষ্ট চক্রের মধ্যে আটকে যাবে।
তিনি বলেন, ‘আজ যদি ২ হাজার মেগাওয়াটের মতো সৌরবিদ্যুৎ প্ল্যান্ট থাকত, তাহলে সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ওই পরিমাণ জ্বালানির প্রয়োজনীয়তা কমাতে পারত। তারা দীর্ঘদিন স্থানীয় গ্যাস সরবরাহও বাড়াতে পারেনি।’
গরমের মাসগুলোতে চাহিদা মেটাতে পিডিবি এবার গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশাপাশি এবং কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ওপরও নির্ভর করবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, দৈনিক প্রায় ১৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ পাওয়া গেলে সর্বোচ্চ ৬ হাজার ৭৬০ মেগাওয়াট আসবে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। পিডিবির সদস্য (জেনারেশন) খন্দকার মোকাম্মেল হোসেন বলেন, সম্প্রতি এক বৈঠকে পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা বলেছেন, মার্চ থেকে তারা গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে পারবেন। তবে পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা বলেছেন বিদ্যুৎ খাতে ওই পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব নয়। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পিক সিজনে ৪ হাজার ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে বলে আশা করা হচ্ছে। আর ভারত থেকে আমদানি করা হবে ২ হাজার ৩৪০ মেগাওয়াট। এদিকে ভর্তুকি কমানোর জন্য আগামী মাসে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কথা ভাবছে সরকার। এ পরিস্থিতিতে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে শুধু দাম বাড়ানোর ওপর নির্ভর করলে বিদ্যুৎ খাতের চ্যালেঞ্জগুলোর টেকসই সমাধান করা যাবে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ খাতের চ্যালেঞ্জগুলোর দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সঙ্গে ক্যাপাসিটি চার্জ চুক্তি বাতিল করে প্রতিযোগিতামূলক সমন্বিত বিদ্যুতের বাজার তৈরি করা উচিত। আইএমএফের ঋণের শর্তপূরণে আগামী তিন বছরের মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি পর্যায়ক্রমে বন্ধ করার লক্ষ্য রয়েছে সরকারের।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গত ২০ ফেব্রুয়ারি সচিবালয়ে এক ব্রিফিংয়ে পাইকারি ও খুচরা উভয় পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ৪ শতাংশ বাড়তে পারে বলে ইঙ্গিত দেন। সর্বশেষ এক বছর আগে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছিল। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) মহাপরিচালক (পাওয়ার সেল) মোহাম্মদ হোসেন বলেন, ‘দুই ধাপে বিদ্যুতের দাম ৪-৫ শতাংশ বাড়ানো হতে পারে— একবার রমজানের, আরেকবার ঈদের পরে। এ পদক্ষেপে বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকি ১৫ হাজার কোটি টাকা কমতে পারে।’ বিপিডিবির তথ্যানুসারে, ভর্তুকি পুরোপুরি তুলে নিলে বিদ্যুতের দাম ৭৮-৮১ শতাংশ বাড়তে পারে। তাই সংস্থাটি ধীরে ধীরে দাম বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে, যাতে জনসাধারণের অতিরিক্ত বোঝা না হয়ে যায়।
ফলে চলতি বছর একাধিক দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হতে পারে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, ‘সরকার যদি বিদ্যুৎ খাতে ক্যাপাসিটি চার্জ বাতিল না করে শুধু বিদ্যুতের দাম বাড়ায়, তাহলে তা টেকসই সমাধান দেবে না। বরং বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সঙ্গে ক্যাপাসিটি চার্জ চুক্তি বাতিল করে এবং প্রতিযোগিতামূলক সমন্বিত বিদ্যুতের বাজার তৈরি করে সরকার ভর্তুকি না দিয়েও জনগণকে কম খরচে বিদ্যুৎ সরবরাহ দিতে পারবে।’
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমও একই মত দিয়েছেন। অর্থ মন্ত্রণালয়ে সূত্রমতে, ২০২২-২৩ সালে বিদ্যুৎ খাতে সরকার ৪৩ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা ভর্তুকি বরাদ্দ করেছিল, যার বড় একটি অংশ ব্যয় হয়েছে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে। বিপিডিবির তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ সালে ক্যাপাসিটি চার্জের জন্য প্রায় ১৭ হাজার ১৫৫.৮৬ কোটি টাকা ছাড় করা হয়েছে। জাতীয় সংসদে গত বছর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, গত ১৪ বছরে ৮২টি বেসরকারি এবং ৩২টি রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ মোট ১ লাখ ৪ হাজার ৯২৬ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেন, বিশেষ করে ক্যাপাসিটি চার্জ-সংক্রান্ত অব্যবস্থাপনার কারণে সরকার বিদ্যুতে ভর্তুকি দিতে বাধ্য হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘সরকার ১৭-১৮ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদার জায়গায় ৩০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ক্যাপাসিটি তৈরি করে ফেলেছে। চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎকেন্দ্র বেশি করে ফেলেছে, যার ফলে অনেক কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও সেগুলোকে বসিয়ে বসিয়ে বিশাল অঙ্কের ক্যাপাসিটি চার্জ দিচ্ছে সরকার। আগামী ১-২ বছরের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ৪০ হাজার মেগাওয়াট হবে, তখন আরও বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে।’ ইজাজ হোসেন আরও বলেন, সরকার আইএমএফের কথামতো বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে, অথচ আইএমএফের কথামতো ডিজেলসহ অন্যান্য জ্বালানির দাম কমাচ্ছে না।
ডিজেলের বর্তমান দাম আন্তর্জাতিক দামের চেয়ে অনেক বেশি। সরকারের এ ধরনের দ্বৈত নীতির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নিম্ন-আয়ের মানুষ। সরকারের বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনার সমালোচনা করে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অযৌক্তিক ও অপব্যয় রোধে সরকারের নজর দেয়া উচিত।
তিনি বলেন, ‘বিদ্যুতের দাম বাড়লে তা সাধারণ মানুষের ওপর অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে প্রভাব ফেলবে। এর কারণ হলো বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল সব উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের পণ্যের দামও বাড়বে। শেষ পর্যন্ত এর বোঝা বহন করতে হবে মূল্যস্ফীতিতে জর্জরিত সাধারণ মানুষকে।’ শামসুল আলম বলেন, মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুতের দাম বাড়ালে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। তবে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, সরকারের পরিকল্পিত বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি নিম্ন-আয়ের গ্রাহকদের ওপর প্রভাব ফেলবে না।
তিনি বলেন, ‘আমরা এমনভাবে সিদ্ধান্ত নেব, যাতে এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করা গ্রাহকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।’ বিদ্যুতের দাম বাড়ালে আবাসিকের পাশাপাশি দেশের শিল্প খাতগুলোতেও উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে।
নিট পোশাক প্রস্তুতকারক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘পর্যাপ্ত গ্যাস না পাওয়ার কারণে উৎপাদন এমনিতেই অর্ধেকে নেমে এসেছে। শিপমেন্ট শিডিউল ফেইল করার কারণে ক্রেতাদের অনেকে এয়ার শিপমেন্টের জন্য চাপ দিচ্ছে, কেউ ডিসকাউন্ট দাবি করছে। কোনো কোনো ক্রেতা ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে অর্ডার বাতিলের কথা বলে দিয়েছে। এ অবস্থায় বিদ্যুতের দাম বাড়লে সেটার বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে উৎপাদনে।’
বিদ্যুৎ খাতে দেনা ৪৪ হাজার কোটি টাকা: বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি যত বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে, তার সব বিদ্যুৎ এবং আমদানির অংশ একক ক্রেতা হিসেবে কিনে নেয় বিপিডিবি। সংস্থাটি কেনা দামের চেয়ে কম দামে সেই বিদ্যুৎ বিক্রি করে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছে। বাকি টাকা ভর্তুকি দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ।
তবে চলমান ডলার সংকট ও যথেষ্ট রাজস্ব আদায় হচ্ছে না বলে অর্থ বিভাগ বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির টাকা যথাসময়ে দিতে পারছে না। বিপিডিবির কাছে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র, ভারতের আদানি গ্রুপ, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন ও শেভরনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মোট প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকা পাওনা রয়েছে।
১৪ বছরে ১২১ শতাংশ বেড়েছে বিদ্যুতের দাম: বিপিডিবির তথ্য অনুসারে, গত ১৪ বছরে ১২ দফা মূল্যবৃদ্ধিতে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম অন্তত ১২১ শতাংশ বেড়েছে। ২০০৯ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। সে সময় বিদ্যুতের খুচরা দাম ছিল প্রতি ইউনিট ৩.৭৩ টাকা। গত ১৫ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে হয়েছে ২৯ হাজার ১৭৪ মেগাওয়াট। প্রতি ইউনিটের খুচরা দাম বেড়ে হয়েছে ৮.২৫ টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিপিডিবির প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় ছিল ১১.৩৩ টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা ছিল ৮.৮৪ টাকা।
নয়া শতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ