চট্টগ্রাম নগরীর বাণিজ্যিক খ্যাত আগ্রাবাদ ব্যাংক পাড়ায় আখতারুজ্জামান সেন্টার থেকে পূর্বদিকের সড়ক ধরে এগুতেই চোখে পড়বে ফুটপাতে সাজিয়ে রাখা রঙ-বেরঙয়ের জুতার দোকান।
এসব দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ডানপাশে তাকাতেই চোখে পড়বে গলির দুপাশে সাজিয়ে রাখা আরও কয়েক ডজন জুতার দোকান। হাতেগোনা কয়েকটি স্থায়ী দোকান ছাড়া এখানকার প্রায় সব দোকানই ভাসমান।
তবে অভিযোগ রয়েছে, বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রামের প্রাণকেন্দ্র আগ্রাবাদে টাকা দিলেই পথের পাশে মেলে দোকান করার জায়গা। অস্থায়ী এসব দোকান থেকে আদায় করা টাকা প্রশাসন ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ভাগাভাগিও হয়।
নগরীর একমাত্র ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারটিও অবস্থিত এই আগ্রাবাদে। আছে ব্যাংক-বীমাসহ সরকারি-বেসরকারি নানা সংস্থার প্রধান কার্যালয়। এখান থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয় আমদানি-রপ্তানিসহ কোটি কোটি টাকার ব্যবসা-বাণিজ্য।
এলাকাটি হকারমুক্ত থাকার কথা থাকলেও পরিণত হয়েছে হকারের নিরাপদ ব্যবসার স্থলে। এতে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন সরকারি-বেসরকারি অফিসে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সেবাগ্রহীতারা।
শনিবার (১০ জানুয়ারি) দুপুরে সরেজমিনে দেখা গেছে, আগ্রাবাদ কমার্স কলেজ সড়কের দুই পাশে ভ্যানগাড়িতে শার্ট, প্যান্টসহ নতুন পোশাকের পসরা সাজিয়ে বসেছেন হকাররা। আগ্রাবাদ বাদামতলা থেকে নৃতাত্তিক জাদুঘর হয়ে আগ্রাবাদ হোটেলগামী সড়কটিরও একই অবস্থা। তার পাশে আখতারুজ্জামান সেন্টারের পেছনের সড়টির দুপাশ বন্ধ করে জুতার দোকান বসানো হয়েছে। ওই এলাকার অন্য সড়কগুলোরও একই অবস্থা।
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ওমর হাজ্জাজ বলেন, দুপুর না হতেই হকাররা সড়কের দুই পাশ দখল করে ভ্যানগাড়ি নিয়ে বসে যান। তারা এমনভাবে দোকান বসান, অফিস থেকে বের হয়ে রাস্তায় ওঠার জায়গা পর্যন্ত থাকে না। তার অভিযোগ, বিষয়টি বেশ কয়েকবার প্রশাসনকে জানালেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
স্থানীয়দের তথ্যানুযায়ী, নগরীতে আগ্রাবাদের ব্যাংক পাড়ায় এটাই সবচেয়ে বড় ভাসমান জুতার বাজার। চট্টগ্রাম শহরের নানা নামিদামি ব্র্যান্ডের বাইরে অপেক্ষাকৃত কম দামে টেকসই হরেক-রকমের জুতা মেলে এখানে। তাই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থেকে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয় এই জুতার বাজার। সাধারণ সময়ে ক্রেতার সংখ্যা তুলনামূলক কম থাকলেও রমজান এবং আসন্ন ঈদকে ঘিরে বেড়েছে ক্রেতা সাধারণের ভিড়।
এখনও মাস দুয়েক বাকি থাকলেও ঈদের আগের ঝামেলা এড়াতে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন ক্রেতারা। তাতেই জমজমাট আগ্রাবাদ ব্যাংকপাড়ার এই জুতার বাজার।
শনিবার বিকেলে সরেজমিননে ব্যাংকপাড়া ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন ধরনের জুতার পসরা সাজিয়ে বসেছেন ভাসমান বিক্রেতারা। তাদের ঘিরে দেখা গেছে নানা বয়সী ক্রেতার উপচে পড়ে ভিড়। পছন্দের জুতা নিয়ে ক্রেতাদের সঙ্গে দর-কষাকষি করছেন তারা।
তাদের একজন এজেন্ট কর্মচারী আলমগীর। তিনি জানান, ঈদের সময় ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড় হয় এখানে। তাই আগেভাগেই পরিবারের সবার জন্য জুতা ঘুরে ঘুরে দেখছেন তিনি।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী রাকিব কয়েকবছর ধরে এই বাজার থেকেই ব্যবহারের জুতা কিনছেন। তিনি নয়া শতাব্দীকে বলেন, আমি পড়াশোনার পাশাপাশি দুই বছর ধরে এখানে একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। চাকরি শুরুর পর থেকে এখান থেকেই নিয়মিত জুতা কিনি। শহরের অন্যান্য মার্কেটের চাইতেও এখানে বাছাই করে নিতে পারলে কম দামে ভালো জুতা পাওয়া যায়।
এ সময় ভাসমান এই জুতার বাজারে কয়েকজন বিক্রেতার সঙ্গে কথা হয় নয়া শতাব্দীর প্রতিনিধির। তারা জানান, প্রতিদিন সকাল নয়টা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত খোলা থাকে এসব দোকান।
জানা গেলো, এখানকার প্রধান ক্রেতা শিক্ষার্থী ও নিম্ন আয়ের মানুষ। অধিকাংশ জুতার দামও তিনশো থেকে হাজারের মধ্যে। তবে বেশি দামের জুতাও রাখেন কিছু কিছু বিক্রেতা।
ভাসমান এই বাজারে বিভিন্ন নামিদামি ব্র্যান্ডের লোগো বা স্টিকার সম্বলিত জুতাও দেখা যায়। আসল নকল বোঝার খুব একটা সুযোগ না থাকলেও ক্রেতাদের ধারণা এসব জুতা নকল। তবে বিক্রেতাদের দাবি, সত্যিকারের ব্র্যান্ডের জুতা সিইপিজেডের বিভিন্ন কারখানা থেকে সংগ্রহ করেন তারা। তাই অনেকটা কম দামে বিক্রি করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিক্রেতা বলেন, মূলত বিভিন্ন কারখানা নামিদামি ব্র্যান্ডের জুতা তৈরি করে বিদেশে রপ্তানি করে। এরমধ্যে মধ্যে কিছু কিছু জুতা তৈরির পর বিভিন্ন কারণে বাতিল হয়। সেসব বাতিলকৃত জুতাই সংগ্রহ করে আগ্রাবাদের ভাসমান বাজারে বিক্রি করা হয়।
তবে কোনো কোনো বিক্রেতা বাইরে থেকে সংগ্রহ করা জুতায় নকল লোগো বা স্টিকার লাগিয়ে বিক্রি করেন বলেও জানান তিনি।
সাইফুল ইসলাম নামের এক বিক্রেতা বলেন, এখানে আমি ৭ বছর ধরে ব্যবসা করছি। প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ জোড়া জুতা বিক্রি হয়। তবে সবচেয়ে জমজমাট হয় ঈদের আগে। কারণ কম দামে এখানে ভালো জুতা পাওয়া যায় বলে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ নতুন জুতা কিনতে এখানে ছুটে আসেন। এখানকার জুতা টেকসই বলে অনেক ধনী ব্যক্তিও মাঝেমধ্যে এখানে জুতা কিনতে আসেন।
আবু বক্কর নামের আরেক বিক্রেতা বলেন, কম দামে ভালো জুতার জন্য এই এলাকাটা বেশ জনপ্রিয় এবং বিখ্যাত। নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ক্রেতারা জুতার জন্য এই এলাকায় আসেন। এখানে তিনশ থেকে শুরু করে আড়াই হাজার টাকার জুতাও পাওয়া যায়।
তবে নগরীর আগ্রাবাদ ব্যাংক পাড়ায় সবচেয়ে বড় এই ভাসমান জুতার দোকান থেকে জুতা কেনার আংশিক ঝুঁকিও রয়েছে। বাছাই করে নিতে না পারলে এই বাজার থেকে জুতা কিনে ঠকতে হয় বলে ধারণা অনেকের। আপন নামের এক ক্রেতার অভিযোগ, এখান থেকে জুতা কিনে ঠকেছেন তিনি।
বিক্রেতারা বিক্রির সময় বেশ সুনাম করলেও কেনার কয়েকদিন পরেই ছিঁড়ে গেছে তার জুতা। ব্যবসায়ীদের দাবি, অধিকাংশ জুতাই টেকসই, অভিযোগ যৎসামান্য। তাদের বিক্রি করা অধিকাংশ জুতাই আসে ভারত আর চীন থেকে। তবে স্থানীয় কারখানায় তৈরি জুতাও রাখেন কেউ কেউ। ওই এলাকায় মোট ৯০ থেকে ১০০ জনের মত ভাসমান জুতা ব্যবসায়ী রয়েছেন বলেও জানান তারা।
নয়াশতাব্দী/ডিএ/একে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ