রাশেদুল ইসলাম। নির্বাহী প্রকৌশলী, কাজলা ডিভিশন, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি)। দুর্নীতি আর স্বেচ্ছাচারিতাই যেন তার মূল কাজ। আর এসব করেই তিনি হয়েছেন বিশাল বিত্ত বৈভবের মালিক। ফলে ডিপিডিসির চাকরিটা তার কাছে যেন একটা টাকার মেশিন, এমনটাই মনে করছেন অপরাধ বিশ্লেষকরা।
অভিযোগে জানা যায়, প্রকৌশলী রাশেদুল ইসলাম অবৈধভাবে টাকা আয়ের জন্য নানা অজুহাতে প্রতিনিয়ত সাধারণ গ্রাহকদের হয়রানি করছেন। তার অত্যাচারে গ্রাহকরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। অবৈধভাবে টাকা আয় যেন তার নেশা ও পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব করতে তিনি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ইচ্ছেমাফিক যা খুশি তাই করছেন। বৈধ পন্থায় কেউ বিদ্যুতের সংযোগ নিতে প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্র জমা দিলেও লোড নাই কিংবা ট্রান্সফর্মার সংস্কার হবে তার আগে সংযোগ দেয়া যাবে না এমন সব কল্পনাপ্রসূত মনগড়া অজুহাত দিয়ে গ্রাহককে হয়রানি করা হয়। আবার অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে কিংবা ঘুষ দিলে মুহূর্তেই সংযোগ দেয়া হয়, তাতে যদি প্রয়োজনীয় কাগজপত্রে ঘাটতিও থাকে। এভাবে তিনি ডিপিডিসির কাজলা ডিভিশনে অনিয়ম-দুর্নীতির যেন এক অভয়ারণ্য গড়ে তুলেছেন প্রকৌশলী রাশেদুল ইসলাম।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এরইমধ্যে প্রকৌশলী রাশেদুল ইসলামের বিরুদ্ধে হওয়া অভিযোগপত্রটি ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপকের (এমডি) দপ্তর থেকে অ্যাডমিন দপ্তরে প্রেরণ করা হয়েছে। এরপরই অভিযুক্ত প্রকৌশলী রাশেদুল ইসলাম উক্ত দপ্তরে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন বলে সূত্রের দাবি।
বিষয়টি নিয়ে ডিপিডিসির এমপ্লয়ী ম্যানেজমেন্ট অ্যাডমিন অ্যান্ড এইচআর ডিভিশনের উপ-মহাব্যবস্থাপক নিহার রঞ্জন সরকারের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়টা এমপ্লয়ী রিলেশন্স অ্যান্ড ডিসিপ্লিন ডিভিশনের উপ-মহাব্যবস্থাপক নূর কামরুন নাহার দেখেন। এ ব্যাপারে তিনি ভালো বলতে পারবেন।
ডিপিডিসির এমপ্লয়ী রিলেশন্স অ্যান্ড ডিসিপ্লিন ডিভিশনের উপ-মহাব্যবস্থাপক নূর কামরুন নাহারের কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি অসুস্থতার জন্য বেশ কিছুদিন ধরে ছুটিতে রয়েছেন বলে জানান। বিষয়টি নিয়ে ডিপিডিসির কাজলা ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদুল ইসলামের সঙ্গে মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তাছাড়া তাকে এ ব্যাপারে খুদেবার্তা পাঠালেও তার কোনো উত্তর তিনি দেননি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রকৌশলী রাশেদুল ইসলাম প্রথমে ২০০৮ সালের ৩০ জুন ডিপিডিসির এনওসিএস কমলাপুর ডিভিশনে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার পদে যোগদান করেন। এরপর তিনি দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ায় তাকে গ্রিড (সাউথ) এ দীর্ঘদিন সংযুক্ত করে রাখা হয়। পরবর্তীতে উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী পদে ২০১৪ সালের ২ মার্চ কোম্পানি সেক্রেটারিয়েটে বদলি করা হলেও পরের দিনই ফের একই পদে গ্রিড-১ এ বদলি করা হয়। এভাবে কয়েক দফা বিভিন্ন দপ্তরে বদলির পর ২০১৮ সালের ২১ জুন নির্বাহী প্রকৌশলী পদে পদোন্নতি হলে ট্যারিফ অ্যান্ড এনার্জি অডিট ডিভিশনে তাকে বদলি করা হয়। সেখানে ১৩ দিন চাকরির পর ২০১৮ সালের ৫ জুলাই ফের তাকে প্রজেক্ট-২ এর ৩৩/১১ কেভি সাব স্টেশন অ্যান্ড লাইন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে বদলি করা হয়।
এরপর ২০২০ সালের ১৮ নভেম্বর ডেভেলপমেন্ট ডিভিশনে বদলি করা হয় তাকে। পরবর্তীতে ২০২৩ সালের ১৩ আগস্ট নির্বাহী পরিচালক অপারেশনস ডিভিশনে নির্বাহী প্রকৌশলী পদে তাকে বদলি করা হলে তিনি সেখানে অনেক কাঠখড় পুড়ে একই বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর এনওসিএস কাজলা ডিভিশনে নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে বদলি করিয়ে নেন।
আর এরপরই তার দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার মাত্রা আর বেড়ে যায় বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ব্যাপারে দুদক সাবেক চেয়ারম্যান ড. ইকবাল মাহমুদ বলেন, আমি মনে করি, দেশে সুশাসন দরকার। চারপাশজুড়ে থাকা দুর্নীতি বন্ধ না হলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। কাজ করতে গিয়ে আমাদের যেসব ব্যর্থতা ছিল, চলমান কমিশন তা থেকে শিক্ষা নিয়ে কাজ করবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘দুর্নীতি রোধে দুদক দুই ধরনের কার্যক্রম করে থাকে। প্রতিকারমূলক ও প্রতিরোধমূলক। প্রতিকারমূলক কার্যক্রম হিসেবে তারা যে কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানকে সুপারিশ করতে পারেন। আর সংশ্লিষ্ট সংস্থার কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেবে। এটা দুদক প্রত্যাশা করতে পারে।
তবে শুধু সুপারিশ করা খুব একটা যৌক্তিক নয়।’ তিনি বলেন, ‘দুর্নীতির উৎস অনুসন্ধান ও সুপারিশ করেই দুদকের কাজ শেষ হয়ে যায় না। অধিকতর অনুসন্ধান করে কারা এ অনিয়ম, দুর্নীতির সঙ্গে যে বা যারা জড়িত সেটাও বের করা উচিত। সংশ্লিষ্ট সবাইকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত। তাহলে দুদকের এ ধরনের কার্যক্রম সফলতা পাবে, মানুষেরও আস্থা ফিরবে।’
বিশ্লেষকদের মতে, দুর্নীতি নির্মূলের ব্যাপারে প্রতিটি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানকে ‘জিরো টলারেন্স (শূন্য সহিষ্ণুতা)’ নীতিতে অটল থাকতে হবে। দুর্নীতি থাকলে দেশে সুশাসন থাকবে না। এখন ভাবতে হবে কোনটা আমরা বেছে নেব। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, দেশের বিদ্যমান দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে কতগুলো পদ্ধতির সংস্কার করা দরকার। দুদকের আইনে কোনো ঘাটতি আছে কি না, তাও দেখতে হবে।
দুদক যেসব সুপারিশ করেছে, তা বাস্তবায়ন করা জরুরি বলে মনে করি। তিনি বলেন, আমি মনে করি, দুর্নীতির নেপথ্যে রুই-কাতলা থাকে। রাঘববোয়াল থাকে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, প্রত্যেক দপ্তরগুলোয় একজন প্রধান আছেন।
আমি মনে করি, নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি বন্ধে ওই বিভাগের প্রধানকে প্রথমে জবাবদিহির আওতায় আসতে হবে। তিনি জবাবদিহি করতে বাধ্য হলে তার অধীন সবাই এক কাতারে আসবে। এতে পুরো প্রতিষ্ঠান শুদ্ধাচারের আওতায় আসবে। সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোয় যারা দুর্নীতি করে, তাদের তাৎক্ষণিক বিচারের ব্যবস্থা থাকা দরকার। এর জন্য যত দ্রুত সম্ভব তদন্ত শেষ করতে হবে। কাউকে দুর্নীতি-অনিয়মের জন্য যেমন শাস্তি দেবেন; ঠিক যারা ভালো কাজ করেন, তাদেরও পুরস্কৃত করা দরকার। তিনি বলেন, দুদক এককভাবে সব দুর্নীতি বন্ধ করতে পারবে- এমনটি আমি মনে করি না।নয়া শতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ