ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ২ মাঘ ১৪৩১, ১৫ রজব ১৪৪৬

‘জনপ্রত্যাশায় ‘দুরবস্থা’

প্রকাশনার সময়: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৮:৪৭

জাতীয় নির্বাচনের পর বাজারে স্বস্তি ফেরার আশা করলেও উল্টো বেশির ভাগ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে। এর মধ্যে বেশ কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। মিলেনি জনপ্রত্যাশার প্রতিফলন। ভোটের পরই যেন তেতে উঠেছে নিত্যপণ্যের বাজার। চাল-আটাসহ বেশির ভাগ পণ্যের দাম বেড়েছে। মাংস ও সবজির দাম বেড়েছে তুলনামূলক বেশি। এ পরিস্থিতিতে বাজারে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন ক্রেতা।

দাম বাড়ার জন্য চিরাচরিত নিয়মে ব্যবসায়ীরা নানা যুক্তি দাঁড় করাচ্ছেন। কেউ বলছেন উৎপাদন খরচ বেড়েছে, কারও দাবি সরবরাহ কম। আবার কেউ কেউ বলছেন, কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছতে প্রতিটি পণ্য কয়েকটি হাতবদল হয়ে আসে। প্রতিটি স্তরের ব্যবসায়ীরা কমবেশি মুনাফা করেন। এভাবেই পণ্যের দাম বেড়ে যায়। তবে ভোক্তারা বলছেন, ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামতো দাম বাড়ালেও সরকারের তদারকি নেই। ভোক্তারা যেন জিম্মি। শুধু নিম্নবিত্ত নয়, মধ্যবিত্তরাও এখন কেনাকাটা কমাতে বাধ্য হচ্ছেন।

এদিকে দ্রব্যমূল্যের লাগাম টেনে ধরতে সরকার মাঠে নেমেছে জানিয়ে জনগণকে ‘আস্থা’ রাখার অনুরোধ করেছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন, বিএনপির কথা তারা আমলে নিচ্ছেন না, তাদের ভাবনা এখন দ্রব্যমূল্য নিয়ে। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বলেন, ‘ইনশাআল্লাহ দ্রব্যমূল্য অচিরেই নিয়ন্ত্রণে আসবে।’

অপরদিকে সম্ভবত ডামি ভোট বর্জনের কারণে জনগণকে শায়েস্তা করতে এই সরকার দেশের মানুষকে মুনাফাখোর, সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের হাতে নতুন করে সমর্পণ করেছে বলে অভিযোগ করে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ডামি সরকারের শপথের পরদিনই চালসহ কিছু নিত্যপণ্যের দাম হঠাৎ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে শুরু করা অভিসন্ধিপ্রসূত। ভরা মৌসুমে শীতকালীন সবজির দাম বেড়ে তিন গুণ হয়েছে। প্রতিদিন কোনো না কোনো পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হচ্ছে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষ চরম কষ্টে দিন পার করছে বলে জানিয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, দেশে চারদিকে হাহাকার। দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আওয়ামী সিন্ডিকেটকবলিত দ্রব্যমূল্যের চরম ঊর্ধ্বগতিতে দিশাহারা সাধারণ মানুষ। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন দেশের মানুষ। ধারদেনায়ও সংসার চালাতে পারছেন না। কাঁচামরিচ থেকে স্বর্ণ, সব কিছুর দর আকাশ স্পর্শ করেছে মন্তব্য করে রিজভী বলেন, গ্যাস সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। গ্যাসের অভাবে একদিকে বাসাবাড়িতে চুলায় আগুন জ্বলছে না, অপরদিকে একের পর এক শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

লোডশেডিং সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আবার নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনো ব্যবস্থাই কাজ করছে না বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জি এম) কাদের। তিনি বলেন, নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে কষ্টে থাকায় ভিতরে ভিতরে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। জিনিসপত্রের দাম লাগামহীনভাবে বাড়ছে। সরকারের কোনো ব্যবস্থাই কাজ করছে না।

কৃষি বিপণন আইন অনুযায়ী, সবজিতে উৎপাদন, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে মুনাফা যথাক্রমে সর্বোচ্চ ৪০, ২৫ ও ৩০ শতাংশ করা যাবে। সেই হিসাবে এক কেজি শিম কৃষক থেকে ভোক্তার কাছে আসা পর্যন্ত সর্বোচ্চ দাম হতে পারে ১৫ টাকা ৬৫ পয়সা। অথচ বিক্রি হচ্ছে এর থেকে ৬ গুণ বেশি দামে। অন্যান্য সবজিও উৎপাদন খরচের চেয়ে ৫ থেকে ৬ গুণ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।

বাংলাদেশ কাঁচামাল আড়ত মালিক সমিতির সভাপতি ইমরান মাস্টার বলেন, ‘কৃষকদের কীটনাশক, বীজ, সারের দাম এবং শ্রমিকের মজুরি বেড়েছে। এতে তাদের উৎপাদন খরচ আগের তুলনায় অন্তত ২০ শতাংশ বেড়েছে। সে জন্য মাঠ পর্যায়ে দাম কিছুটা বেশি। ক্ষেত থেকে খুচরা বাজারে আসা পর্যন্ত কয়েকটি হাত বদল হয়। পরিবহন খরচও বাড়তি। রাস্তায় ও মার্কেটে নানারকম টুকিটাকি খরচ আছে। সব মিলিয়ে খুচরা বাজারে এর প্রভাব পড়ে।’

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘সবজির দর নিয়ন্ত্রণে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের দেখভাল করার কথা। কিন্তু মাঠে ভোক্তা অধিদপ্তর ছাড়া কারও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। তবুও আমরা সর্বোচ্চ তদারকির চেষ্টা করছি।’

সপ্তাহ ব্যবধানে আবারও দাম বেড়ে ১০০ ছুঁই ছুঁই করছে পেঁয়াজ। আমদানি ঘাটতির অজুহাত ব্যবসায়ীদের। কেজিতে এক থেকে দেড়শ’ টাকা বেড়েছে দেশি সব ধরনের মাছের দাম। বেড়েছে মুরগির দামও। বর্তমান বাজারে সব ধরনের পণ্যের দামই রয়েছে ঊর্ধ্বমুখী। কম দামে পণ্য পাওয়া যায় হাতেগোনা কয়েকটি। এমন চলতে থাকা শীতকালীন বাজারে সবজির দামও নিয়ন্ত্রণহীন। কখনো বাড়ছে আবার কখনো কমছে। কমলেও থাকছে ক্রেতা সাধারণের নাগালের বাইরে। একদিকে দাম বাড়াতে ছুতো খুঁজে বেড়ান ব্যবসায়ীরা, অন্যদিকে চাপে পড়ছেন সাধারণ মানুষ।

ক্রেতাদের অভিযোগ, কেবল দাম বাড়ানোর ধান্ধায় থাকেন ব্যবসায়ীরা। অপরদিকে ব্যবসায়ীদের যুক্তি হলো, কাঁচা সবজির দাম অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে, তাই এটা ওঠানামা করবেই। গতকাল শুক্রবার মিরপুর ১ নম্বর কাঁচাবাজারসহ রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে সরজমিন এমন পরিস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।

পেঁয়াজের ঝাঁজে মাঝে মাঝেই অতিষ্ঠ ক্রেতা। চাহিদার চেয়ে বেশি উৎপাদনের পরও নানা কারণে টান পড়ছে পণ্যটির। তা সামলাতে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। ক’দিনের বাড়তি দামের মধ্যে আবারও বেড়েছে এ নিত্যপণ্যটির দাম। আড়তদারদের বিরুদ্ধে কৃত্রিম সংকট তৈরির অভিযোগ তুলছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা।

বাজারে দেখা গেছে, শিম ৬০ থেকে ৮০, শালগম ৫০, টমেটো ৭০, পেঁয়াজকলি ৪০, মটরশুঁটি ১০০, সাদা মুলা ৪০, লাল মুলা ৫০, দেশি গাজর ৫০, লম্বা বেগুন ১০০, সাদা গোল বেগুন ৯০, কালো গোল বেগুন ৯০, শসা ৯০, ক্ষিরাই ৭০, উচ্ছে ১০০, পেঁপে ৫০, মিষ্টিকুমড়া ৪০, ঢেঁড়স ১০০, চিচিঙ্গা ৮০, ধুন্দল ৭০, বরবটি ১০০, কচুর লতি ৮০, কচুরমুখী ১০০, কাঁচামরিচ ৮০ থেকে ১০০ ও ধনেপাতা ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

এদিকে প্রতিটি লাউ ১০০ টাকা, ফুলকপি ৫০, বাঁধাকপি ৫০ ও ব্রকলি ৬০ করে বিক্রি হচ্ছে। বেশ কিছু সবজির দাম বেড়েছে ১০ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত। এর মধ্যে পেঁপের দাম বেড়েছে ১০ টাকা ও উচ্ছের দাম বেড়েছে ৩০ টাকা।

দাম কমাতে ভুলে যান ব্যবসায়ীরা

বাজারে দ্রব্যমূল্য প্রতিনিয়তই ওঠানামা করতে থাকে। তবে কোনো পণ্যের যে পরিমাণ দাম বাড়ে, কমানোর ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের থাকে নানা যুক্তি। এতে পণ্যের দাম ধীরে ধীরে বাড়তেই থাকে। বাজার করতে আসা ক্রেতারা বলছেন, কোনো একটা কিছু দাম হুট করে ২০ থেকে ৩০ বাড়িয়ে তারপর হয়তো সেটা পাঁচ টাকা কমানো হয়। এতে কি আসলে দাম কমে? দাম বাড়ানোর সময় ব্যবসায়ীরা তৎপর, কিন্তু কমানোর বেলায় ভুলে যান। এভাবেই চলছে আমাদের বাজার পরিস্থিতি।

বাজার করতে আসা বেসরকারি চাকরিজীবী হারুনুর রশিদ বলেন, সবজির দাম তো কমছে না। ৩০ টাকা বাড়িয়ে ৫ টাকা কমানোকে তো দাম কম বলা যায় না। গত সপ্তাহে উচ্ছে কিনেছি ৭০ টাকায়, আজ সেটা ১০০ টাকা। পেঁপে কিনেছি ৪০ টাকায়, আজ ৫০ টাকা। কাঁচাবাজারে এই দামদরের কোনো নিয়ন্ত্রণই নেই।

বৃষ্টির অজুহাত বিক্রেতাদের

সবজি বিক্রেতা আবু হানিফ বলেন, কাঁচামালের দাম কখনো এক জায়গায় স্থির থাকে না। এটা ওঠানামা করবেই নানা কারণে। আরেক বিক্রেতা বলেন, গত দুদিনের বৃষ্টির কারণে সবজির দাম বেড়ে গেছে। এখানে আমাদের কোনো হাত নেই।

ক্রেতারা বলছেন উসিলা

বৃষ্টিতে সবজির দাম বেড়েছে, এ প্রসঙ্গে বাজার করতে আসা রফিকুল ইসলাম বলেন, ব্যবসায়ীরা আসলে দাম বাড়ানোর উসিলা খোঁজেন। কতক্ষণ বৃষ্টি হয়েছে গত দুদিনে যে সবজির দাম বেড়ে গেল? সব এলাকায় তো বৃষ্টিই হয়নি! এ ছাড়া গতকাল লাল ও সাদা আলু ৪০ টাকা, দেশি রসুন ২৬০-২৮০ টাকা, চায়না রসুন ২২০ টাকা, ভারতীয় আদা ২২০, চায়না আদা ২২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আলু-পেঁয়াজ বিক্রেতা মো. হালিম বলেন, পেঁয়াজের দাম হয়তো আরও বেড়ে যাবে। তবে আলুর দাম কমার সম্ভাবনা হয়েছে। আলু কিনতে এসে এক ব্যক্তি বলেন, সিজনে আলুর দাম থাকার কথা ১৫ টাকা কেজি, সেটা কিনতে হচ্ছে ৪০ টাকায়।

দাম বেড়েছে মাছ-মাংসের

এ ছাড়া আজকের বাজারে ইলিশ ওজন অনুযায়ী ১২০০ থেকে ২০০০ টাকা, রুই ৪০০ থেকে ৭০০, কাতল ৪৫০ থেকে ৫০০, কালিবাউশ ৪০০ থেকে ১২০০, চিংড়ি ৭০০ থেকে ১২০০, কাঁচকি ৪৫০, কৈ ২৫০ থেকে ১৫০০, পাবদা ৪০০ থেকে ৭০০, শিং ৪০০ থেকে ১২০০, বেলে ৬০০ থেকে ১২০০, টেংরা ৬০০ থেকে ৮০০, মেনি ৫০০ থেকে ৮০০, কাজলি ১১০০ থেকে ১২০০, বোয়াল ৬০০ থেকে ১২০০, রূপচাঁদা ১০০০ থেকে ১২৫০ ও শোল ৯০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

ব্রয়লার মুরগি ১৯০ থেকে ২০০ টাকা, কক ২৬৫ থেকে ২৮০, লেয়ার ২৮০ টাকা, দেশি মুরগি ৫০০ ও গরুর মাংস ৭৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। মুরগির লাল ডিম ১৩৫ টাকা এবং সাদা ডিম ১৩০ টাকা প্রতি ডজন বিক্রি হচ্ছে।

স্বাভাবিক মুদিপণ্যের দাম

গতকাল শুক্রবার মুদি দোকানে সব পণ্যের দাম রয়েছে অপরিবর্তিত। ছোট মসুর ডাল ১৩৫, মোটা মসুর ডাল ১১০, মুগডাল ১৭৫, খেসারি ডাল ১১০, বুটের ডাল ১০০, ছোলা ১১০, প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৭৩, প্যাকেটজাত চিনি ১৪৫, খোলা চিনি ১৪০, দুই কেজি প্যাকেট ময়দা ১৫০, আটা দুই কেজির প্যাকেট ১৩০ এবং খোলা সরিষার তেল প্রতি লিটার ১৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

নয়া শতাব্দী/এসএ

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ