ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বাড়ছে শীতজনিত রোগ

প্রকাশনার সময়: ২৯ জানুয়ারি ২০২৪, ০৭:৩৪

প্রবাদ রয়েছে ‘পৌষ গেল, মাঘ আইল-শীতে কাঁপে বুক/দুঃখীর না পোহায় রাতি, হইল বড় দুঃখ।’ প্রকৃতির অমোঘ নিয়মেই ঋতুর পালাবদল ঘটে। প্রকৃতির আচরণ মানুষের অসহায়ত্বকে আরও প্রকট করে তোলে। হিমেল হাওয়া ও তীব্র শৈত্যপ্রবাহ দরিদ্র জনগোষ্ঠী-অধ্যুষিত অঞ্চলে বিরূপ প্রভাব ফেলে। প্রচণ্ড শীতের প্রকোপ থেকে আত্মরক্ষার জন্য হতদরিদ্র অনেক মানুষেরই নেই ন্যূনতম শীতবস্ত্র, খাদ্যদ্রব্য, ওষুধপথ্য, উপযুক্ত আশ্রয় বা বাসস্থান। শীত আসার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়েছে শীতকালীন রোগ বালাইয়ের প্রাদুর্ভাব। দেশের বিভিন্ন স্থানে হাসপাতালে বাড়ছে শীতজনিত রোগীর সংখ্যা। আক্রান্তদের মধ্যে শিশু ও বয়স্কই বেশি। এ সময় গরম কাপড় পরা ও ঠান্ডা-বাসি খাবার না খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।

প্রকৃতিতে অগ্রহায়ণ মাসেই শীতের আমেজ উপলব্ধি করা গেছে। সময় যত গড়িয়ে যাচ্ছে, শীতের তীব্রতা ততই বাড়ছে। গরমের তুলনায় শীত আরামদায়ক হলেও প্রতি বছর এ সময় বেশ কিছু বাড়তি রোগব্যাধি দেখা যায়। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের জন্য এ সময়টা বেশ জটিলতা তৈরি করে। ঠান্ডা থেকে সাধারণ জ্বর-সর্দি-কাশি ছাপিয়ে বাড়তে থাকে ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, অ্যাজমাসহ শ্বাসতন্ত্রের নানা ধরনের রোগ। শীতে হূদরোগীদের ঝুঁকিও বেড়ে যায়। হূদরোগীর ক্ষেত্রে বেশি ঠান্ডা অনেক সময় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় মৌসুমি রোগের ভোগান্তি। রাজধানীসহ জেলা-উপজেলা হাসপাতালগুলোতে বেড়ে যায় রোগীর সংখ্যা। অন্য বয়সিদের তুলনায় বেশি বিপদে পড়তে হয় বৃদ্ধ ও শিশুদের।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে শীতকালীন স্বাভাবিক তাপমাত্রায় বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধি দেখা দেয়। এর মধ্যে সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়া, মধ্যকর্ণের প্রদাহ, সাইনাসের প্রদাহ, ত্রুপ, ডায়রিয়া, হাঁপানি, ইনফ্লুয়েঞ্জা, টনসিলাটাইসিস, ব্রংকিওলাইটিস, সাইনোসাইটিস, বাত, আর্থ্রাইটিস, চামড়ার শুষ্কতা, চিলব্লেইন্স, ঠোঁট ফেটে যাওয়া, সিজনাল এফেক্টিভ ডিস-অর্ডার ইত্যাদি রোগ বেশি হয়ে থাকে। এসব রোগ থেকে সুরক্ষায় শীত এড়িয়ে চলতে হবে। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ এ ব্যাপারে বলেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর শীতের তীব্রতা বেশি। স্বাভাবিক শীতকালীন রোগব্যাধির পাশাপাশি তীব্র শীতে হাইপোথার্মিয়া হতে পারে। বিশেষ করে বয়স্কদের ক্ষেত্রে এটি হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি।

তিনি বলেন, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এমনিতেই মানুষের শরীরের তাপ উৎপাদন ক্ষমতা কমতে থাকে। তীব্র শীতে বয়স্কদের ক্ষেত্রে হাইপোথার্মিয়া হতে পারে। এক্ষেত্রে রোগীর শরীর ধীরে ধীরে ঠান্ডা হয়ে আসে। শরীরে তাপ উৎপাদন কম হওয়ায় হাত-পা কুঁকড়ে যায়। এমনকি শরীর অবশ হয়ে আসতে থাকে। এছাড়া হাঁপানি, ডায়রিয়া, সর্দি-কাশিসহ অন্যান্য রোগ তো আছেই। এসব রোগ থেকে বাঁচতে হলে অবশ্যই শীত এড়িয়ে চলতে হবে।

জানা গেছে, হাসপাতালে প্রতিদিনই বাড়ছে সর্দিকাশি, জ্বর, হাঁপানি-অ্যাজমা, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্তের সংখ্যা। শীতকালে শুকনো মৌসুমে বাতাসে ধুলোবালির পরিমাণ থাকে বেশি। তাই অ্যাজমা রোগীদের জন্য আবহাওয়ার এই পরিবর্তন ঝুঁকিপূর্ণ। ঋতু পরিবর্তনের এই সময়ে নিউমোনিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জা, শ্বাসকষ্ট এবং সর্দি, কাশিসহ জ্বর নিয়ে ঢাকা শিশু হাসপাতালের বহির্বিভাগে বেড়েছে রোগীদের ভিড়। কিছুদিন আগেও যেখানে প্রতিদিন গড়ে ১০০-১৫০ রোগী চিকিৎসা নিতো, সেখানে এখন সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫০-৩০০ জনে। শুধু বহির্বিভাগেই নয়, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যাও বেড়েছে।

শিশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বছর নিউমোনিয়া, অ্যাজমা, হাঁপানি, ক্রনিক শ্বাসকষ্ট ও ডায়রিয়ায় ব্যাপকহারে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। এ সময় গ্রামাঞ্চলে অনেকে শীতের জন্য গোসল করে না। নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকে। এসব কারণে এ রোগের সংক্রমণ বেশি হয়। এমন পরিস্থিতিতে শিশু ও বয়স্কদের জন্য আগামী মার্চ মাস পর্যন্ত আলাদা যত্ন নেয়ার পরামর্শও দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। শীতের সময় অনেকে আগুন পোহায়। বিভিন্ন এলাকায় আগুন পোহাতে গিয়ে অগ্নিদগ্ধ হয়ে অনেকে ঢাকা মেডিকেলর বার্ন ইউনিটে ভর্তি হয়েছেন।

ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. সৈয়দ সফি আহমেদ জানান, শীতজনিত কারণে শিশুরা নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, অ্যাজমাসহ শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ নিয়ে প্রতিদিনই অনেক রোগী হাসপাতালে আসছে। অন্যসব রোগীর সংখ্যা খুবই কমে গেছে। রোগীদের প্রচণ্ড চাপে সিট দেয়া সম্ভব হয় না। তারপরও এদের জরুরি চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে। চিকিৎসা নিয়ে কোনো ধরনের সমস্যা হয় না। আগত শিশুদের মধ্যে নিউমোনিয়ায় আক্রান্তদের হার সর্বাধিক। তাই শীতের সময় শিশুদের জন্য আলাদা যত্ন নিতে হবে অভিভাবকদের।

শিশুকে গরম কাপড় পরিধান করা, হালকা গরম পানি পান করতে হবে। একই সঙ্গে হাত ধুয়ে খাবার খেতে হবে। এই সময়টাতে খুব বেশি প্রয়োজন না হলে শিশুদের ঘর থেকে বের না হওয়াই ভালো। তিনি বলেন, মৌসুম পরিবর্তনের কারণে ভাইরাসজনিত রোগ জ্বর, সর্দি ও কাশিসহ ইনফ্লুয়েঞ্জাও হয়ে থাকে এই সময়ে। ইনফ্লুয়েঞ্জার ভ্যাকসিন পাওয়া যায়। এই ভ্যাকসিন নিলে শিশুসহ বয়স্কদের নিউমোনিয়াসহ শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। আর এ ক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া ভালো।

অধ্যাপক ডা. সৈয়দ সফি আহমেদ বলেন, ছয় মাস পর্যন্ত শিশুদের শীতের মৌসুমে শুধু মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোই ভালো। অভিভাবকরা একটু সচেতন হলে শীতকালীন এসব রোগ থেকে শিশুদের নিরাপদ রাখা সম্ভব।

তাছাড়া রাজধানীর আইসিডিডিআরবিতেও রোটা ভাইরাস বা শীতকালীন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর ভিড় বেড়েছে। প্রতিদিন সেখানে ভিড় করছে গড়ে ৬০০ রোগী, যা দুই সপ্তাহ আগেও ছিল অর্ধেক। আইসিডিডিআরবির তথ্যমতে, শীতের প্রকোপ বাড়ার পর গড়ে প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ জন ডায়রিয়ার রোগী মহাখালীর হাসপাতালে আসছে। এরা মূলত শীতজনিত (রোটা ভাইরাস) ডায়রিয়ায় আক্রান্ত। এদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা গড়ে ৬৫ ও প্রাপ্তবয়স্ক ৩৫ ভাগ। আক্রান্তদের গড়ে ২৪ ঘণ্টা হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

আইসিডিডিআরবির ডায়রিয়ার ডিজিজ প্রধান ড. আজহারুল ইসলাম এ ব্যাপারে বলেন, শীতের তীব্রতা বাড়লে রোটা ভাইরাসজনিত ডায়রিয়া রোগীর প্রকোপ বাড়ে। সাধারণত শিশুরা এতে বেশি আক্রান্ত হয়। তিনি বলেন, যেহেতু এটা এক ধরনের ডায়রিয়া। তাই বিশুদ্ধ পানি পানের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। ঢাকা ক্লিনিকের চিকিৎসক ডা. নুরুল আমিন বলেন, শিশুদের যেন ঠান্ডা না লাগে সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে। বন্ধ করা যাবে না বুকের দুধ খাওয়ানো। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রামণ ও এলার্জির সমস্যা হলে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।

তিনি বলেন, ঋতু পরিবর্তনের এ সময়ে বাড়তি সতর্কতা মেনে রোগ বালাইমুক্ত থাকলে শীতের শুরুর সময়টা হয়ে উঠতে পারে আরও উপভোগ্য। এ সময়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা, মুখে মাস্ক ব্যবহার ও ফলমূল ধুয়ে খেতে হবে। একটু সচেতন হলেই, এসব মৌসুমি রোগ প্রতিরোধ সম্ভব বলে জানান তিনি।

শীতে গরম কাপড়ের অভাবে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকেন কম আয়ের মানুষ। তাদের কষ্ট লাঘবে বিত্তবানদের সহযোগিতার হাত বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন শীতার্ত দরিদ্র জনগোষ্ঠী। জানা গেছে, হিমালয় কাছে হওয়ায় ঋতু পরিবর্তনের এ সময়ে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় শীতের প্রকোপ বরাবরই বেশি। এরই মধ্যে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় এ বছর এ পর্যন্ত সর্বনিম্ন তাপমাত্রা নেমেছে ৫ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।

নয়াশতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ