অভিজ্ঞতাহীন, অপরিপক্ব এবং দ্বৈত নাগরিকত্বধারীসহ নানা অসামঞ্জস্যতা সম্পন্ন কর্মকর্তাদের নাম ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ডিপিডিসি) দুটি শীর্ষ পদে নিয়োগ প্রদানে সুপারিশ করা হয়েছে। এমনকি ডিপিডিসি’র তিনজন অভিজ্ঞ এবং সফল কর্মকর্তা আবেদন করলেও নির্বাহী পরিচালক (টেকনিক্যাল) পদে তাদের একজনকেও সুপারিশের তালিকায় না রাখায় নানা ধরনের গুঞ্জন উঠেছে। পাশাপাশি প্রশ্ন উঠেছে তাহলে নির্বাহী পরিচালক (টেকনিক্যাল) পদে আসলেই কি ডিপিডিসিতে কোনো অভিজ্ঞ কর্মকর্তা নেই!
ডিপিডিসি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও নির্বাহী পরিচালক (টেকনিক্যাল) দুই পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রায় সম্পন্ন। দুটি পদেই এরইমধ্যে তিনজন করে প্রার্থীর নাম সুপারিশ করা হয়েছে। তবে সুপারিশকৃত এসব প্রার্থীদের অনেকের সংশ্লিষ্ট পদের প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতা নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। এমন কর্মকর্তাদের ডিপিডিসি’র গুরুত্বপূর্ণ এসব পদে দায়িত্ব প্রদান করা হলে সংস্থাটির দীর্ঘদিনের গ্রাহক সেবার সুনাম ও মান ক্ষুণ্ন হতে পারে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
জানা গেছে, ডিপিডিসি’র পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ও বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও নির্বাহী পরিচালক (টেকনিক্যাল) শূন্য পদে নিয়োগ প্রদানে ১৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি নিয়োগ কমিটি গঠন করা হয়। ডিপিডিসি’র বোর্ড সভার সিদ্ধান্তের পর আবেদনকারী প্রার্থীদের মধ্য থেকে যাচাই-বাছাই শেষে গত ২২ জানুয়ারি এমডি এবং ২৪ জানুয়ারি নির্বাহী পরিচালক (টেকনিক্যাল) পদে নিয়োগ পরীক্ষার জন্য আবেদনকারীদের ডাকা হয়। এর মধ্যে এমডি পদে ১৭ জন আবেদন করলেও যাচাই-বাছাই শেষে নিয়োগ পরীক্ষায় ১৬ জনকে ডাকা হয়। আর নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন ১৩ জন। এর মধ্য থেকে তিনজনের নাম সুপারিশ করা হয়। এখান থেকে একজনকে এমডি পদে নিয়োগ প্রদানে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নির্ধারণ করবেন।
সূত্রমতে, এমডি পদে সুপারিশকৃতরা হলেন- (১) ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক আইসিটি অ্যান্ড প্রকিউরমেন্ট এবং জিটুজি প্রকল্পের পিডি (প্রকল্প পরিচালক) ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল্লাহ নোমান, (২) ডিপিডিসির সাবেক প্রধান প্রকৌশলী ও জিটুজি প্রকল্পের সাবেক পিডি মাহবুবুর রহমান ও (৩) ডিপিডিসির সাবেক নির্বাহী পরিচালক ইঞ্জিনিয়ারিং মো. গিয়াস উদ্দিন জোয়ারদার। এই তিনজনের মধ্যে তৃতীয় স্থানে থাকা ডিপিডিসির সাবেক নির্বাহী পরিচালক ইঞ্জিনিয়ারিং মো. গিয়াস উদ্দিন জোয়ারদার ছিলেন মেধাবী ও দক্ষ সফল কর্মকর্তা। তার সময়কালে তিনি গ্রাহকদের নিকট সাড়ে আট লাখ প্রি-পেইড মিটার স্থাপন করেছেন। ৩২টি সাবস্টেশন করেছেন। তাছাড়া জিটুজি প্রকল্পের কাজগুলো তার সময় শুরু হয়।
এ ছাড়া স্মার্ট মিটার, স্মার্ট গ্রিড প্রকল্প তার সময়কালে নেয়া। কর্মরত অবস্থায় তিনি বহু পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। শিক্ষা জীবনে সর্বত্রই তিনি ফার্স্ট ক্লাস, গোল্ড মেডেল এবং বুয়েট ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছেন।
অপরদিকে তালিকায় দুই নম্বরে থাকা দ্বৈত নাগরিক ডিপিডিসির সাবেক প্রধান প্রকৌশলী ও জিটুজি প্রকল্পের পিডি মাহবুবুর রহমানকে নিয়ে রয়েছে নানা ধরনের সমালোচনা ও গুঞ্জন। এমনকি ডিপিডিসি’র এই এমডি’র নিয়োগ পেতেও তিনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে ১২ কোটি টাকা লেনদেন করেছেন বলে গুঞ্জন ভেসে বেড়াচ্ছে।
সদ্য সমাপ্ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দ্বৈত নাগরিকত্বের জন্য যেখানে অনেকের প্রার্থিতা বাতিল হয়ে গেল সেখানে কিভাবে একজন দ্বৈত নাগরিক ডিপিডিসি’র এমডি পদে নিয়োগের জন্য সুপারিশকৃত হন, এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সর্বমহলে।
ডিপিডিসির নিয়োগ বোর্ডের চেয়ারম্যান ও বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. হাবিবুর রহমান বলেন, দ্বৈত নাগরিকের নিয়োগ পাওয়ার সুযোগ আছে কিনা তা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। তাছাড়া এখনো নিয়োগ চূড়ান্ত হয়নি। তবে একটু বলতে পারি মাহবুব চুড়ান্ত তালিকায় থাকছে না। এটাই ফাইনাল কথা। যোগ্যতা বিবেচনা করে নিয়োগ দেয়া হবে।
এ ব্যাপারে ডিপিডিসি’র নির্বাহী পরিচালক (অ্যাডমিন ও এইচআর) সোনামনি চাকমার মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। অপরদিকে, নির্বাহী পরিচালক (টেকনিক্যাল) পদে ১৫ জন আবেদন করলেও নিয়োগ পরীক্ষার জন্য ডাকা হয় ১১ জনকে। আর পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন আটজন প্রার্থী।
এর মধ্য থেকে তিনজনের নাম সুপারিশ করা হয়। এখান থেকে একজনকে নির্বাহী পরিচালক (টেকনিক্যাল) পদে নিয়োগ প্রদানে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নির্ধারণ করবেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। সূত্রমতে, নির্বাহী পরিচালক (টেকনিক্যাল) পদে সুপারিশকৃতরা হলেন- (১) পিজিসিবি’র প্রকৌশলী কিউ এম শফিকুল ইসলাম, (২) বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানির সৈয়দ আকরাম উল্লাহ ও (৩) ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের প্রধান প্রকৌশলী (উন্নয়ন) মোহাম্মদ শরিফুল ইসলাম।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, নির্বাহী পরিচালক (টেকনিক্যাল) পদে সুপারিশকৃত এই তিনজন প্রকৌশলীর মধ্যে কেউই টেকনিক্যাল অভিজ্ঞ সম্পন্ন নয়। এই তিনজনের মধ্যে প্রথম দুইজন হলো ডেভেলপমেন্ট ওয়ার্কে এক্সপার্ট। আর নির্বাহী পরিচালক টেকনিক্যাল পদে কাজগুলো হলো- গ্রাহককে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেয়াসহ গ্রাহকের অন্যান্য সেবাগুলো প্রদান ও রাজস্ব আদায় নিশ্চিত করা। অর্থাৎ ডিস্ট্রিবিউশন ও অপারেশন পরিচালনা করা।
তাছাড়া সুপারিশকৃতদের এই পদসংশ্লিষ্ট কার্যক্রমে তৃণমূলেও কাজের তেমন কোনো অভিজ্ঞতা নেই। এ ছাড়া তালিকায় থাকা তৃতীয় ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মেয়ে জামাতাকে ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে চাকরি দেয়ার সুবাদে এ তালিকায় ঠাঁই পেয়েছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। এমন কর্মকর্তাদের নির্বাহী পরিচালক (টেকনিক্যাল) পদে নিয়োগ দিলে ডিপিডিসি’র বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থায় যে কোনো সময় সিস্টেম ভেঙে যেতে পারে বলে সূত্রের দাবি।
সূত্রের আরও দাবি, এমডি পদে চুক্তিবদ্ধ প্রার্থীকে নিয়োগের বিষয়টি ক্ষীণ বুঝতে পেরে সংশ্লিষ্ট চক্র পরিকল্পিতভাবে সংস্থাকে দুর্বল ও ব্যর্থ করতে ডিপিডিসির অভিজ্ঞ কর্মকর্তাগণকে বাদ দিয়ে নির্বাহী পরিচালক (টেকনিক্যাল) পদে সংস্থাটির বাইরের আবেদনকারী অনভিজ্ঞদের নাম নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিপিডিসি সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সফল ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কর্মকর্তা হলেও ডিপিডিসিতে দুই প্রধান প্রকৌশলীসহ তিনজনের নাম নির্বাহী পরিচালক (টেকনিক্যাল) পদে সুপারিশের তালিকা থেকে পরিকল্পিতভাবে বাদ দেয়া হয়েছে। এর ফলে ডিপিডিসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে।
এ ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর সভাপতি এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ হলে তিনি তদন্তে নির্দোষ প্রমাণিত না হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সেই ব্যক্তিকে নিয়োগ বা পদোন্নতি কিংবা বদলি প্রক্রিয়ার তালিকায় রাখা অন্যায়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অপরাধের মোটিভ আড়াল করাও আরেকটি অপরাধ।
পাশাপাশি এটি অপরাধীকে পৃষ্ঠপোষকতার শামিল। এ ধরনের কাজ কখনই প্রতিষ্ঠানের কোনো মঙ্গল বয়ে আনে না। এ ব্যাপারে ডিপিডিসি নিয়োগ বোর্ডের সদস্য ও বিদ্যুৎ বিভাগের উপসচিব এরাদুল হক বলেন, নিয়মনীতি মেনেই নিয়োগ চূড়ান্ত করা হবে। নিয়ম অনুসরণ করেই প্রক্রিয়া চলছে। চূড়ান্ত হলেই জানতে পারবেন।
উল্লেখ্য, আগামীকাল রোববার অথবা পরের দিন সোমবার দুই পদেরই নিয়োগকৃত কর্মকর্তার নাম ঘোষণা হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
নয়া শতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ