ঢাকা, রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৪ পৌষ ১৪৩১, ২৬ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

নিজেই যেন ‘সংক্রমিত’

প্রকাশনার সময়: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৭:৪৬

দেশে সংক্রামক রোগের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ বিশেষায়িত চিকিৎসা কেন্দ্র মহাখালীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল। ১০০ শয্যার বিশেষায়িত হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠার পর গত পঞ্চাশ বছরে আর সম্প্র্রসারণ করা হয়নি। লাগেনি আধুনিকতার বিন্দুমাত্র ছোঁয়াও। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জায়গা দখল, ময়লা-আবর্জনা, লোকবল সংকট, মাদকসেবীদের আনাগোনায় হাসপাতালটি নিজেই যেন নানা রোগে ‘সংক্রমিত’। প্রতিদিন চিকিৎসা নিতে আসা পাঁচ থেকে ছয়শ রোগীর হাসপাতালটি ভুগছে চিকিৎসক সংকটেও। বিপুল পরিমাণ রোগীর বিপরীতে হাসপাতালটিতে চিকিৎসা দিচ্ছেন মাত্র ২০ জন চিকিৎক। এত কম জনবলে রাতদিন মানুষকে সেবা দিতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে চিকিৎসকদের।

সরেজমিনে দেখা গেছে, মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে ১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হাসপাতালটির মূল ফটকের আশপাশে নোংরা ও আবর্জনার স্তূপ। রোদ, বৃষ্টি ও স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে জমে থাকা ময়লা-আবর্জনার স্তূপ থেকে ছড়াচ্ছে মারাত্মক দুর্গন্ধ। হাসপাতালটির ভেতর ও চারপাশে সামান্য বৃষ্টিতেই হাসপাতালে প্রবেশের রাস্তায় হাঁটুপানি জমে যায়।

ভবনের দেয়াল চুইয়ে বৃষ্টির পানি মেঝেতে পড়ছে। এছাড়া হাসপাতালের চারপাশ ঘিরে চলা মাদক ব্যবসায়ী ও সেবনকারীদের আনাগোনায় পুরো জায়গাটি যেন পরিণত হয়েছে অপরাধীদের অভয়ারণ্যে। সাততলা হাসপাতাল ভবনের অভ্যন্তর কিংবা আশপাশের চরম অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশ দেখলে যে কেউ চমকে উঠবেন। হাসপাতালের এ নোংরা পরিবেশই নানা সংক্রামক ব্যাধির উৎসস্থল। চিকিৎসাসেবা প্রদানের ন্যূনতম পরিবেশ নেই। পানি নিষ্কাশনের জন্য নেই ড্রেনেজ ব্যবস্থা। ফলে একটু বৃষ্টি হলেই হাসপাতালের সামনে পানির সঙ্গে ময়লা-আবর্জনা মিশে একাকার হয়ে যায়।

অভিযোগ রয়েছে, আশেপাশে সাততলাসহ কয়েকটি বস্তি থাকায় হাসপাতালটির ভিতরে-বাইরে মাদকসেবীদের আনাগোনা রয়েছে। হাসপাতালের কয়েক কর্মকর্তা-কর্মচারী জানান, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু কর্মকর্তা সেখানকার মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা পেয়ে থাকেন। এ কারণে সেখানে নিরাপদে মাদক ব্যবসা চলে। এ রকম পরিস্থিতিতে হাসপাতালে আগত রোগী ও তাদের আত্মীয়স্বজন চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। সন্ধ্যার পর হাসপাতালে যাতায়াত করার সময় অনেকে ছিনতাইয়ের শিকার হন।

সবচেয়ে ভয়াবহ তথ্য হলো, হাসপাতালের ৩৫ একর জায়গার মধ্যে বেশির ভাগই বেদখল হয়ে আছে। হাসপাতালের ২৫-একর জায়গার ওপর যে অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে, সেখানে প্রায়ই আগুন লাগে। এতে যারা ভাড়া দিয়ে সেখানে থাকেন, সেসব সাধারণ মানুষ নিঃস্ব হয়ে যান। এসব জায়গায় অবৈধভাবে কয়েকশ ঘর উঠিয়ে ভাড়া দেয়া হয়েছে। এসব বস্তি ঘরে অবৈধ গ্যাস-পানি-বিদ্যুৎ সবই আছে।

বস্তি সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, অবৈধ এসব সংযোগের বিল পান তিতাস ও বিদ্যুতের একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী। কিছু অবৈধ ঘরের মালিক খোদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী। এ কারণে গত ৪৯ বছরে বহুবার অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের আদেশ এলেও তা বাস্তবায়ন হয় না। সরকার বদল হয়ে দখলদার বদল হয়, কিন্তু হাসপাতাল দখলমুক্ত হয় না। বেদখল হওয়া এসব জায়গা থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি চক্র। এ টাকার ভাগ পান স্থানীয় রাজনৈতিক দলের একশ্রেণির নেতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণির সদস্য এবং মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, রোগীদের বিনামূল্যে বিতরণের জন্যে দেয়া জলাতঙ্ক, এইচআইভি, আইজি ও অন্যান্য মূল্যবান ভ্যাকসিন অবৈধ পন্থায় বাইরে বিক্রি করার জন্য একটি চক্র গড়ে উঠেছে। এ চক্রে সক্রিয় রয়েছেন হাসপাতালের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী। গত ১৮ সেপ্টেম্বর এমন অভিযোগে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে অভিযান চালায় দুদক। এ সময় হাসপাতালের পাশাপাশি আশপাশের ফার্মেসিতে অভিযান চালিয়ে কিছু ওষুধ জব্দ করা হয়।

দুদক এনফোর্সমেন্ট টিমের সহকারী পরিচালক মোহাম্মাদ শহীদ চৌধুরীর নেতৃত্বে দুর্নীতি দমন কমিশন ও ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সমন্বিত টিম আকস্মিক অভিযান চালায়। অভিযানকালে সমন্বিত টিম ড্রাগ লাইসেন্সবিহীন একটি ফার্মেসির সন্ধান পায় এবং ফার্মেসিটি দুদক টিমের উপস্থিতিতে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর কর্তৃক সিলগালা করে দেয়া হয়।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, মহাখালী সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে আগতদের মধ্যে কুকুর, বিড়াল ও শিয়ালের কামড় খাওয়া রোগী বেশি। এছাড়া জন্ডিস, ধনুষ্টংকার, জলবসন্ত, ডিপথেরিয়া, এনফেলোকাইটিস, ভাইরাল হেপাটাইটিস, এআরভি ভ্যাকসিনের প্রতিক্রিয়া ঘটা রোগীরাও এখানে চিকিৎসা নিতে আসেন। এইচআইভির (এইডস) মতো মারাত্মক রোগীসহ নিউমোনিয়া, টাইফয়েড, হাম, মামস-জাতীয় রোগের চিকিৎসাও দেওয়া হয় এখানে। রোগ নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন প্রোগ্রাম ও গবেষণা হয় সেখানে।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, এ হাসপাতালে অফিস টাইম সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত। এ সময়ের পরও রোগী এলে তাকে ভর্তি রাখা হয়। হাসপাতালে পরের দিন সকাল আটটার সময় তাকে টিকা দেওয়া দেয়। এখানে ১০০ শয্যার হাসপাতালে জলাতঙ্ক রোগীদের জন্য আলাদা ওয়ার্ড রয়েছে। সার্বক্ষণিক চিকিৎসার জন্য এখানে চিকিৎসক আছেন ২০ জন। এর মধ্যে ১৭ জন মেডিকেল অফিসার ও ৩ জন কনসালটেন্ট। এছাড়া নার্স আছেন ৬০ জন, তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী ১০ জন, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ২১ জন। চতুর্থ শ্রেণির পরিছন্নতাকর্মীর ২৬টি পদের মধ্যে ২৩টি পদ শূন্য রয়েছে।

হাসপাতালটির মেডিকেল অফিসার ডা. শ্রীবাস পাল বলেন, আমাদের হাসপাতালের বহির্বিভাগের প্রতিদিন প্রাণীর কামড়ে আহত হয়ে পাঁচশ থেকে ছয়শ রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। আর জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতি বছরে ৩০ থেকে ৩৫ জন রোগী ভর্তি হয়। এছাড়া কোনো মাসে দুয়েকজন অথবা কোনো মাসের চার থেকে পাঁচজন রোগীও ভর্তি হয়। যেহেতু এ রোগ সংক্রমণ হয় তাই রোগী ও চিকিৎসক দুপক্ষই ভয় পায়। রোগীদের কাছ থেকেও এ রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু আমাদের চিকিৎসকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ২০১০ সাল থেকে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে আসছে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করার জন্য সিটি করপোরেশনকে বার বার বলা হলেও তারা উদ্যোগ নেয় না। হাসপাতালের জমি দখলমুক্ত করার বিষয়ে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে ওপরের নির্দেশ না এলে আমাদের কিছুই করার নেই।

সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, আমরা রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার (সিডিসি) মেইন স্টেকহোল্ডার। জলাতঙ্ক রোগ নিয়ন্ত্রণ প্রোগ্রামের আওতায় ২০১০ সাল থেকে আমাদের কার্যক্রম চালু আছে। আমাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক, সেবিকা এবং কনসালটেন্টদের সমান্বয়ে এ কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। এখানে জনবলের অনেক ঘাটতি আছে। আমাদের যে অরগানোগ্রাম সেই অরগানোগ্রামের যথেষ্ট ঘাটতি আছে।

বিভিন্ন পদ সৃজন করা দরকার। আমরা একটা জনবল নিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছিলাম ২০১৪ সালে। পরে আমি যোগদানের পরে এটাকে রিভাইসড করে দিই। সেটা এখন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। সেখানে অনেক পদ সৃজনের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছিল। আমাদের অ্যাডজাস্টিং পদ ১৮৫টির বিপরীতে আরও ৪৮টি পদ সৃজনের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। সেটার এখনো কোনো ফিডব্যাক পাইনি। এটা অনগোয়িং প্রসেস। চেষ্টা করছি এখানের জনবল বাড়ানোর জন্য।

নয়াশতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ