ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

রুদ্ধ হয়নি পথ

প্রকাশনার সময়: ৩০ নভেম্বর ২০২৩, ০৯:৩৫

এগিয়ে আসছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ। তবে এখনো সমঝোতা হয়নি দেশের বড় দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে। এদিকে নির্বাচনে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে টানা তিনবারের ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। দলটি ইতোমধ্যেই ৩০০ আসনে তাদের প্রার্থী বাছাই করে ২৯৮ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। প্রার্থীরও এলাকামুখী হয়েছে, নিতে শুরু করেছে নির্বাচনের প্রস্তুতি। তবে এখনো নিজেদের অবস্থানে অনড় মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি।

ফলে নির্বাচন যতই কাছে আসছে সংঘাতের শঙ্কা ততই বাড়ছে। তবে এখনো সমঝোতার পথ রুদ্ধ হয়নি বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। সেক্ষেত্রে দুই দলকেই ছাড় দিয়ে আলোচনার টেবিলে বসে সংলাপের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করার পরামর্শ তাদের। জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘সমঝোতার সুযোগ সব সময়ই থাকে। যুদ্ধক্ষেত্রেও সমঝোতার সুযোগ থাকে। যেমন ইসরাইল-হামাস যুদ্ধেও সমঝোতার মাধ্যমে যুদ্ধ বিরতি হয়েছে। তবে প্রশ্নটা হলো স্বদিচ্ছার। আমরা যদি সম্মিলিত আত্মহত্যা করতে না চাই তাহলে সমঝোতা হওয়া উচিত।

তিনি আরও বলেন, ‘২০১৪ সালে যেটা হয়েছে সেটা হলো একতরফা নির্বাচন। সিটিকরপোরেশন যেগুলো হয়েছে সেগুলোও একতরফা নির্বাচন। আর এখন যেটা হচ্ছে সেটা হলো নিয়ন্ত্রিত একতরফা নির্বাচন। এ নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন আবার অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যেতে পারে। ফলে সারা দেশে সংঘাত ছড়াতে পারে। কিছু নিরহ মানুষের প্রাণহানি হতে পারে। তাই দেশের স্বার্থে এবং জনগণের স্বার্থে সমঝোতা হওয়া উচিত।

আওয়ামী লীগ সূত্রগুলো বলছে, গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির আন্দোলনে ব্যর্থতার পর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙা হয়েছে। এখন আর তারা বিএনপিকে পাত্তা দেয়ার মতো কিছু আছে বলে মনে করছেন না। বিএনপি যেই হারে আলোচনা সৃষ্টি করেছিল সেই হিসেবে মাঠ পর্যায়ে কিছুই করতে পারেনি তারা। পরবর্তীতে বিএনপি ধারাবাহিকভাবে হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি দিলেও তাদের নেতাকর্মীদের মাঠে দেখা যাচ্ছে না। এছাড়া তাদের আন্দোলনে জনজীবনে তেমন প্রভাব পড়ছে না। সবকিছুই স্বাভাবিকভাবে চলছে। আওয়ামী লীগ মনে করে, বিএনপির আন্দোলনে জনগণের অংশগ্রহণ নেই। তাদের মোটিভেটেড কিছু কর্মীরাই আন্দোলন করছে। আর আন্দোলনের জনগণের সম্পৃক্ততা না থাকলে সে আন্দোলন সফল হয় বলেও মনে করছে না আওয়ামী লীগ। যে কারণে তারা বিএনপির আন্দোলনের চেয়ে নির্বাচনকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।

এছাড়াও সংলাপেও তেমন আগ্রহ নেই আওয়ামী লীগের। বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যেই দলটির নেতারাও প্রকাশ্যে কথা বলেছেন। নেতারা বলছেন, ‘বিএনপি আসলে সন্ত্রাসী দল। তারা অগ্নিসন্ত্রাস করে, মানুষ হত্যার রাজনীতি করে। তারা গাড়িতে আগুন দেয়। পুলিশকে পিটিয়ে হত্যা করে। যানবহানে অগ্নিসন্ত্রাস করে। ফলে আওয়ামী লীগের মতো একটি গণতান্ত্রিক দল বিএনপির মতো সন্ত্রাসী দলের সঙ্গে সংলাপে বসতে পারে না।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রহমান বলেন, ‘গত ২৮ তারিখ বিএনপি তাদের কফিনের শেষ পেরাকটি মেরে ফেলেছে। বিএনপি যেভাবে অগ্নিসন্ত্রাস করে মানুষ হত্যা করছে— এতে তাদের জনপ্রিয়তা আরও কমেছে। তারা যদি সন্ত্রাসীর পথ পরিহার না করে তাহলে তারা এক সময় হারিয়ে যাবে।

বিএনপির সূত্রগুলো বলছে, ‘২০১৪ সালে একতরফা নির্বাচন করে বিনা ভোটে সরকার ক্ষমতায় এসেছে। এরপর ২০১৮ সালে তারা আওয়ামী লীগকে বিশ্বাস করে ঠকেছে। আগের রাতেই সরকার ভ্যালটবাক্স ভরে ফেলেছে। এ সরকার বিনা ভোটের সরকার। তাই এ সরকারকে তারা আর বিশ্বাস করে কোন ফাঁদে পা দিতে চান না। দলটির নেতারা বলছেন, ‘নির্বাচন সামনে রেখে বিচারের নামে প্রশসন করে সরকার দ্রুতগতিতে বিএনপির নেতাকর্মীদের সাজা দিচ্ছে। বিএনপির সিনিয়ন নেতাদের জেলের মধ্যে অন্যায়ভাবে আটকে রেখেছে। এমন পরিস্থিতিতে এ সরকারের সঙ্গে সংলাপ বা সমঝোতার কোনো সুযোগ দেখছে না দলটি।

জানতে চাইলে বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য নিলোফার চৌধুরী মনি বলেন, ‘এই ফ্যাসিবাদি সরকারের সঙ্গে কিসের সমঝোতা। তারা আমাদের হাজার হাজার নেতাকর্মীদের জেলের মধ্যে অন্যায়ভাবে আটক করে রেখেছে। তারা আমাদের যতই অত্যাচার করুক— আমরা আন্দোলনের মাঠ ছেড়ে যাব না। আমরা এ ফ্যাসিবাদি সরকারের পতন ঘটিয়েই মাঠ ছাড়ব।’

তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশ ও জনগণের স্বার্থে দুই দলকেই ছাড় দিয়ে আলোচনার টেবিলে বসে সমস্যার সমাধান করা উচিত। তবে সেটা হতে হবে শর্তহীন। শর্ত দিয়ে কখনো সংলাপ হতে পারে না। বিএনপির দাবি— সরকারের পদত্যাগ। তারা এ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না। এটা মানা সরকারের জন্য রাজনৈতিক পরাজয়। ফলে এ দাবি সরকার কখনো মানবে না। আবার সরকার চায়— তাদের অধীনে নির্বাচন করতে। এটিও মানা বিএনপির জন্য রাজনৈতিক পরাজয়।

তাই বিএনপি সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না। তাই এক্ষেত্রে দুই দলকেই তাদের শর্তে ছাড় দিতে হবে। এক্ষেত্রে বিএনপি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল থেকে প্রতিনিধি নিয়ে একটা সর্বদলীয় সরকার গঠনও হতে পারে সমাধান বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তবে সেক্ষেত্রে উভয় দলকেই ছাড় দিয়ে আলোচনার টেবিলে বসে সমঝোতা করতে হবে।

জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং লেখক অধ্যাপক ড. সুলতান মাহমুদ নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘সমঝোতার পথ সব সময়ই খোলা আছে। তফসিল হলেই যে সমঝোতার পথ বন্ধ হয়ে যায় তা নয়। নির্বাচনের দশদিন আগেও সমঝোতা হতে পারে। এবং নতুনভাবে নির্বাচনের তারিখ, রি-শিডিউল হতে পারে। আর এ সমঝোতার উদ্যোগ নিতে পারে মূলত নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশনের আগ্রহটা বেশি থাকতে হবে। আর সরকার যেহেতু নির্বাচনমুখী তাই আওয়ামী লীগ তো চাইবেই নিজেদের শক্তি ধরে রেখে কীভাবে নির্বাচন করা যায সেই চেষ্টা চালাবে। কিন্তু বিএনপি যেহেতু এখনো নির্বাচনে যাচ্ছ না এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অনড় রয়েছে। আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। সেজন্য আমি মনে করি বিএনপিকে একধাপ বেশি এগিয়ে আসতে হবে। কারণ বিএনপি যেহেতু ক্ষমতার বাইরে রয়েছে সেক্ষেত্রে তাদের এ নির্বাচনে আসার একটা গুরুত্ব রয়েছে।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব রয়েছে, নির্বাচন কমিশনেরও দায়িত্ব রয়েছে এ রকম একটি বড় দলকে কীভাবে নির্বাচনমুখী করা যায়। এটার জন্য বিএনপিকে যেমন এগিয়ে আসতে হবে তেমনই নির্বাচন কমিশনকেও একটু আগ্রহ দেখাতে হবে। সেসঙ্গে সরকারকেও একটু নমনীয় হতে হবে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিও বড় দুই দলকে রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে ঢাকতে পারেন বলে মনে করেন তিনি।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘আমি মনে করি সমঝোতার সুযোগ এখনো আছে। তবে সুযোগ কেউ কাজে লাগাবে কিনা বা লাগানো হবে কিনা সেটা হচ্ছে বড় কথা। আর শর্ত দিয়ে কখনো সমাধান হবে না। এখন আর সেই পর্যায়ে নেই। এটা যে কোনো পক্ষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে। তিনি বলেন, ‘বিবাধমান পক্ষগুলো পর্দার অন্তরালেও নিজেরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে নিজেরাই সমস্যার সমাধান করতে পারে। সব কিছু সবার সামনে করতে হবে বিষয়টা এমনও না। তাছাড়া এখন আর লাইট-ক্যামেরার সামনে সমাধান করার মতো অবস্থায়ও নাই।

অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘কোনো একটা পক্ষ নির্বাচনে না এলে নির্বাচন সুন্দর হবে না। আর এটার দায় এককভাবে কোনো পক্ষের ওপর চাপানো ঠিক হবে না। সেটা কার দায় সেটা লোকে হিসাব করুক। কারণ যদি এমন দাবি আমি করি— যেটা নন-নেগোশিয়েবল। তাহলে তো সেটা একক।’

নয়াশতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ