শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৩ পৌষ ১৪৩১

অনিশ্চয়তায় বই উৎসব

প্রকাশনার সময়: ২৯ নভেম্বর ২০২৩, ০৮:০৯

বছরের শুরুতে বাংলাদেশে স্কুল পড়ুয়া সব শিশুর হাতে নতুন বই তুলে দিয়ে ‘বই উৎসব’ পালন বিশ্বে অনন্য। ২০১০ সাল থেকে ব্যতিক্রমধর্মী ‘বই উৎসব’ পালিত হয়ে আসছে বাংলাদেশে। এরপর থেকে কোভিড-১৯ বাদে বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রাথমিক গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্তৃক প্রতি বছর ১ জানুয়ারি নতুন শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিনে সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে উৎসব করে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণের মাধ্যমে এ উৎসব পালন করা হয়।

এ উৎসব ইতোমধ্যেই বিশ্বব্যাপী প্রশংসা কুড়িয়েছে। এর পেছনে রয়েছে দেশের সব শিশু-কিশোরদের শিক্ষামুখী করা এবং তাতে উৎসাহিত করার বর্তমান সরকারের এক সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা। তবে এ কার্যক্রমে ছেদ পড়া শুরু হয়েছে গত বছর থেকে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড এবারও যথাসময়ে নতুন বই তুলে দিতে পারবে কি না তা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। মোট ৩১ কোটি নতুন বইয়ের মধ্যে প্রাথমিক স্তরের সব শ্রেণির বই ছাপা প্রায় শেষ। ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণির বই সময়মতো ছাপা নিয়ে বিপাকে এনসিটিবি। ষষ্ঠ-সপ্তমের দুটি বইয়ের পন্ডুলিপি এখনো ছাপাখানায় দেয়া হয়নি। মাত্র শুরু হয়েছে অষ্টমের বই ছাপা। নবম শ্রেণির কোনো বইয়ের পান্ডুলিপি এখনো ছাপাখানায় পাঠানোই সম্ভব হয়নি।

পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বলছে, বই ছাপার কাজের চুক্তির জন্য অর্থছাড় মিলছে না। ফলে ছাপাখানার মালিকদের টাকা দেয়াও সম্ভব হয়নি। ছাপাখানা কর্তৃপক্ষ কাগজ কিনতে পারছে না। সব মিলিয়ে টাকার অভাবেই থমকে আছে নবম শ্রেণির বই ছাপা। বিভিন্ন শ্রেণির আরও কয়েকটি বই ছাপার কাজও একই কারণে বন্ধ। ছাপাখানার মালিক ও কর্মীরা জানান, বই ছাপার ক্ষেত্রে নিয়ম অনুযায়ী-৫০ দিন সময় বেঁধে দিয়ে চুক্তি করে এনসিটিবি। অথচ বছর শেষ হতে বাকি আছে আর অল্প কিছুদিন। এ সময়ের মধ্যে কোনো ছাপাখানা প্রতিষ্ঠানই এত বই ছাপিয়ে শেষ করতে পারবে না। টেন্ডার, কাজের চুক্তি, বিল পরিশোধ যথাসময়ে না করায় বই ছাপা নিয়ে হিমশিম অবস্থায় পড়েছে এনসিটিবি।

এদিকে যথাসময়ে বই ছাপা নিয়ে যে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে, তার জন্য বোর্ড চেয়ারম্যান ও কর্মকর্তাদের অযোগ্যতাকে দায়ী করছেন মুদ্রণশিল্প সমিতির নেতারা। তাদের অভিযোগ, পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে অনিয়ম-দুর্নীতি বেড়েছে। টেন্ডার শিডিউলের নিয়ম ভেঙে নানা কাজ করছেন বোর্ড চেয়ারম্যানসহ অন্য কর্মকর্তারা। বই ছাপার কাজের চুক্তি ও প্রতিষ্ঠান বাছাইয়ে তারা নিজেদের পছন্দ গুরুত্ব দিচ্ছেন। নিজেদের অনিয়ম ও অযোগ্যতা ঢাকতে এখন অর্থছাড় না হওয়া এবং কাগজ সংকটের মতো ‘অজুহাত’ দেখাচ্ছেন।

এনসিটিবি সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ধরা হয়েছে তিন কোটি ৮১ লাখ ২৭ হাজার ৬৩০ জন। তাদের জন্য বই ছাপা হচ্ছে মোট ৩০ কোটি ৭০ লাখ ৮৩ হাজার ৫১৭টি। প্রথম, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য ছাপা হচ্ছে ৫ কোটি ৩৮ লাখ ৩ হাজার ৪২৩ কপি বই। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির বই সংখ্যা ৩ কোটি ৩৬ লাখ ১ হাজার ২৭৪টি। প্রাক-প্রাথমিকের জন্য ৬১ লাখ ৯৩ হাজার ৮৭৮ কপি বই ছাপা হবে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ৬ কোটি ৪৫ লাখ ৪৮ হাজার ৩০৮ কপি, সপ্তম শ্রেণির ৪ কোটি ৪৫ লাখ ৫৭ হাজার কপি, অষ্টম শ্রেণির জন্য ৫ কোটি ৩৪ লাখ ৮৪ হাজার ২৭১ কপি এবং নবম শ্রেণির জন্য ৫ কোটি ছয় লাখ ৮৪ হাজার ৫৭৩ কপি বই ছাপা হচ্ছে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর (পাঁচটি ভাষায় রচিত) শিশুদের জন্য এবার মোট দুই লাখ পাঁচ হাজার ৩১ কপি বই ছাপা হচ্ছে। অন্য বইয়ের মধ্যে পাঁচ হাজার ৭৫২ কপি ‘ব্রেইল’ বই ছাপা হবে।

তবে ছাপাখানা মালিকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ মুদ্রণশিল্প সমিতি’র নেতাদের তথ্যমতে, এখনো প্রায় ১৫ কোটি বই ছাপা বাকি। এর মধ্যে অষ্টম ও নবম শ্রেণিরই প্রায় ৯ কোটি। ডিসেম্বরে এত সংখ্যক বই ছাপার কাজ শেষ করা সম্ভব হবে না। ১ জানুয়ারি বই উৎসব করতে হলে এনসিটিবিকে গোঁজামিলের আশ্রয় নিতে হবে। শিক্ষার্থীদের হাতে তিন-চার বিষয়ের বই ধরিয়ে দিয়ে কোনোমতে উৎসবের উদ্বোধন করিয়ে নিতে হবে। হয়তো জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে ছাপার কাজ শেষ হবে। তখন পর্যায়ক্রমে বাকি বিষয়ের বইগুলো শিক্ষার্থীদের দেয়া যাবে। মুদ্রণশিল্প সমিতির সভাপতি শহীদ সেরনিয়াবাত বলেন, এবার পহেলা জানুয়ারি সব শিক্ষার্থীকে শতভাগ বই দিতে পারবে না এনসিটিবি। তিনি বলেন, সরকারের একটা সফল উদ্যোগ বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে বই তুলে দেয়া।

এ উদ্যোগ গত বছর থেকে মুখ থুবড়ে পড়েছে। গত বছরও সব শিক্ষার্থীর হাতে বই দেয়া সম্ভব হয়নি। এবারও হবে বলে মনে হয় না। এজন্য বোর্ডের অযোগ্যতা, অদক্ষতা ও দুর্নীতিকে দায়ী করেন তিনি।

তবে নিয়ম মেনেই টেন্ডার শিডিউল ও কাজের চুক্তি হয়েছে বলে দাবি করেছেন এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহাম্মদ ফরহাদুল ইসলাম। তিনি বলেন, যথাসময়ে বই ছাপার সব উদ্যোগই নেওয়া হয়েছিল। অষ্টম শ্রেণির বইয়ের কাজ চলছে।

তবে নবম শ্রেণির বইগুয়ের কাজ স্থবির হয়ে রয়েছে। এখন সমস্যা হয়ে গেছে টাকার। অর্থছাড় পেতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন জানিয়ে পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে আমি এটা জানিয়েছি। শিক্ষা সচিবকেও জানিয়েছি। টাকাটা পেলেই আমরা কাজ শুরু করে দেব। আশা করি, যথাসময়ে সব বই ছাপা হয়ে যাবে।

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ