ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

সেবা দেন ‘মৃতরা’

প্রকাশনার সময়: ২৩ নভেম্বর ২০২৩, ০৭:১৯

কেউ চাকরিচ্যুত, কেউ অবসরে আবার কেউবা গেছেন মারা। তবুও তারা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) হয়ে নগরবাসীকে সেবা প্রদান করছেন! সেবা প্রদানকারী হিসেবে নগর ভবনের সম্মুখে সাঁটানো নাগরিক সনদ বোর্ড তেমনটাই প্রমাণ করে। নাগরিক সনদের বিশাল বোর্ডে সেবা প্রদানকারী হিসেবে রয়েছে এমনসব ব্যক্তিদের নাম। যা নিয়ে সেবাপ্রত্যাশী নাগরিকদের অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন দক্ষিণ সিটিতে মৃত ব্যক্তিরাও দিচ্ছেন নাগরিক সেবা!

তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ অনুযায়ী তথ্য সরবরাহ করা, সড়ক খনন, ডিএসসিসি মালিকানাধীন কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া, বহুতল (আবাসিক/বাণিজ্যিক) ভবন/বৃহদায়তান বা বিশেষ প্রকল্পের অনাপত্তিপত্র প্রদান, হোল্ডিং নম্বর প্রদান, হোল্ডিংয়ের নামজারী, ট্রেড লাইসেন্স প্রদান, দোকানের নামজারি, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনসহ বিবিধ সেবা প্রদান করে মর্মে নাগরিক সনদ উল্লেখ করে বিশাল দুটি বিলবোর্ড সাঁটিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। মূল ভবনে উঠতেই ডান ও বাম পাশে বৃহদাকারে বোর্ড নং-১ এবং বোর্ড নং-২ হিসেবে এ দুটি দেয়ালের সঙ্গে সাটানো রয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ভোগান্তীহীনভাবে নগরবাসী বোর্ডে উল্লেখিত সেবাগুলো পাচ্ছেন তো? নাকি অনেকটাই লোক দেখানো বা বলার জন্য করা। কারণ মৃত কিংবা চাকুরিচ্যুত বা অবসরপ্রাপ্তরাও কীভাবে এসব সেবা দিচ্ছেন, এমনটাই অভিযোগ নগরবাসীর।

ডিএসসিসির নাগরিক সনদ বোর্ডে দেখা যায়, বিভিন্ন ছকে ৬টি কলাম করে আলাদা আলাদাভাবে প্রথমে সেবার নাম, ২য়টিতে সেবা প্রদান পদ্ধতি, ৩য় কলামে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র এবং প্রাপ্তিস্থান, ৪র্থ দফায় সেবার মূল্য এবং পরিশোধ পদ্ধতি, ৫ম কলামে সেবা প্রদানের সময়সীমা আর সর্বশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (নাম, পদবি, ফোন নম্বর ও ই-মেইল) উল্লেখ করে বিবরণ দেয়া রয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে লালবাগ এলাকার একজন সেবাপ্রত্যাশী জানান, ডিএসসিসিতে নাগরিক সেবা প্রদান প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ নাগরিক সনদের বোর্ডে উল্লেখিত দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অনেকেই ওইসব দায়িত্বে নেই। এমনকি বোর্ডে উল্লেখিত সেবা প্রদানকারী দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কেউ চাকুরিচ্যুত, কেউ অবসরপ্রাপ্ত এমনকি কেউ কেউ আবার মারা গেছেন।

কীভাবে এসব ব্যক্তিরা ডিএসসিসিতে এখন সেবা দিচ্ছেন। তাছাড়া বোর্ডে উল্লেখিত এসব সেবা যদি প্রকৃতপক্ষে দেয়াই হয় তাহলে কারা দিচ্ছেন এসব সেবা, কেনইবা সেবা প্রদানকারী সেসব কর্মকর্তা তাদের নাম বোর্ডে উল্লেখ করাচ্ছেন না, মাসের পর মাস এমন জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় ভুল থাকতে পারে না, এর পেছনে আসল রহস্যটা কি এতসব জিজ্ঞাসা তার। তিনি বলেন, এসব কারণে সেবা প্রত্যাশীদের প্রাপ্ত সেবার মান কিংবা কতটুকু হয়রানিমুক্ত তা স্বাভাবিকভাবেই অনুমেয়।

এখন তো ডিএসসিসির ওয়েবসাইটে সব বিভাগের কর্মকর্তাদের না সঠিকভাবে উল্লেখ রয়েছে তাহলে এ বোর্ড দেখে নগরবাসী কেন বিভ্রান্ত হবেন প্রশ্নের জবাবে সেবাপ্রত্যাশী ওই ব্যক্তি বলেন, ডিএসসিসিতে যারাই সেবা নিতে আসেন তারা অধিকাংশই নিম্ন আয়ের মানুষ। এদের অনেকেরই স্মার্ট ফোন নেই আবার যাদের রয়েছে তারা অধিকাংশ লোকই ওয়েব সাইটে ঢুকে সেবা প্রদানকারী কর্মকর্তার নাম খুঁজে বের করতে পারেন না। আধো আধো পড়ালেখা এসব মানুষ নাগরিক সনদের এ বোর্ড দেখেই ডিএসসিসি থেকে সেবা নেয়ার চিন্তা করেন। কিন্তু সেখানেও নগরবাসীকে হয়রানির স্বীকার হতে হচ্ছে বলেন দাবি তার।

নাগরিক সনদের বোর্ড বিশ্লেষণে দেখা যায়, বোর্ড নং-১ এ জন্ম ও মৃত্যু সেবা প্রদানকারী দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নামের তালিকায় প্রথমে ডা. সানজিদা ইসলামের নাম উল্লেখ থাকলেও তিনি অবসরে গিয়েছেন। তাছাড় ডা. ফাহমিদা মনির চাকরি ছেড়েছেন অনেক আগেই। এছাড়া সহকারি স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে ডা. ফজলে শামসুল কবিরের নাম উল্লেখ থাকলেও তিনি বর্তমানে ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন। আবার ডা. নিশাত পারভীনকে সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে উল্লেখ করা হলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি দক্ষিণ সিটির স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

অপরদিকে বোর্ড নং-২ এ শুধু বহুতল (আবাসিক/বাণিজ্যিক) ভবন/বৃহদায়তান বা বিশেষ প্রকল্পের অনাপত্তিপত্র প্রদানে দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে উল্লেখকৃত মো. নজরুল ইসলাম যথাযথ স্থানে থাকলেও অন্যান্য সেবা প্রদানকারী কর্মকর্তাদের কেউই নেই। এদের মধ্যে ডিএসসিসি মালিকানাধীন কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া প্রদানকারী দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সহকারী সমাজকল্যান কর্মকর্তা হিসেবে মো. রোকনুজ্জামানের নাম উল্লেখ করা হলেও তিনি সচিব দপ্তরেসহ সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

এছাড়া সহকারী সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা হিসেবে মো. আফজালুল আজম রেজা ও মেহেদী হাসান খানের নাম উল্লেখ করা হলেও তারা উভয়েই রাজস্ব বিভাগে উপ-কর কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন। আবার তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ অনুযায়ী তথ্য সরবরাহ করা দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে উত্তম কুমার রায়ের নাম উল্লেখ থাকলেও তিনি মারা গেছেন। তিনি ভান্ডার কর্মকর্তা হিসেবে মারা গেলেও তাকে জনসংযোগ কর্মকর্তা উল্লেখ রয়েছে।

এছাড়া সড়ক খনন সেবা প্রদানকারী কর্মকর্তা হিসেবে অনেক আগেই সংস্থা থেকে চাকরিচ্যুত তানভীর আহম্মদের নাম বোর্ডে রয়েছে বহাল তবিয়তে। বোর্ডের তালিকায় রয়েছে অনেক আগেই মারা যাওয়া প্রকৌশলী মুন্সী মো. আবুল হাসেমের নাম। এছাড়া পুরকৌশলের নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে মো. খায়রুল বাকের, মোহাম্মদ তাওহীদ সিরাজ, কাজী মো. বোরহান উদ্দিনের নাম উল্লেখ থাকলেও এদের প্রত্যেকেই নির্বাহী নয় তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আর এ তিনজনের কেউই পুরকৌশলে দায়িত্ব পালন করছেন না।

বিষয়টি নিয়ে ডিএসসিসির সচিব আকরামুজ্জামানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হয়নি।প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলামের মোবাইল ফোনে এ ব্যাপারে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। ডিএসসিসির প্রধান সমাজকল্যান ও বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা আকন্দ মোহাম্মদ ফয়সাল উদ্দিন বলেন, বিষয়টি নিয়ে বলার জন্য আমি যথার্থ নই, এ ব্যাপারে সচিব দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।

বিষয়টি নিয়ে সংস্থাপন শাখার সহসচিব মো. রোকনুজ্জামান বলেন, নাগরিক সনদ সংবলিত এ বিলবোর্ডের দায়িত্ব আইসিটি বিভাগের। ফলে এ ব্যাপারে সিস্টেম এনালিস্ট ভালো বলতে পারবেন, তার সঙ্গে যোগাযোগ করুন। এ ব্যাপারে ডিএসসিসির সিস্টেম এনালিস্ট মো. আবু তৈয়ব রোকন বলেন, কোনো ধরনের বিলবোর্ড নয় আইসিটি বিভাগের দায়িত্ব শুধু অনলাইন ভার্সন তদারকি করা।আর সেটি যথাযথভাবে হালনাগাদ করা রয়েছে। দক্ষিণ সিটির ওয়েব সাইটে যে কেউ প্রবেশ করলেই তা দেখতে পাবেন।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার এ ব্যাপারে বলেন, এ জাতীয় সংস্থায় জনগণকে সেবা দেয়ার জন্যই যে তাদের নিয়োগ দেয়া হয় সেসব বোধ-ই যেন নেই। এসব নাগরিক সনদ বোর্ড যেন করার খাতিরে করা হয়। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের (সেটা কেন্দ্রীয় সরকার কিংবা স্থানীয় সরকারের কর্মকর্তা হতে পারে) জনগণকে সেবা দেয়াই যে কাজ এ দায়বদ্ধতা দুর্ভাগ্যবশত সেই বোধই আমাদের দেশে অনুপস্থিত।

নয়াশতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ