ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

সুনসান সদরঘাট 

প্রকাশনার সময়: ১৭ নভেম্বর ২০২৩, ০৭:৩৫

অবরোধ আর তফসিল মিলিয়ে মানুষের মাঝে বিরাজ করছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। এর প্রভাব পড়েছে রাজধানীর সদরঘাটে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিকাল সাড়ে তিনটা পর্যন্ত চাঁদপুরের উদ্দেশে ছেড়ে গেছে দুটি লঞ্চ। ভোলার দিকে ছেড়ে গেছে দুটি। যাত্রী সংকটে দুই থেকে তিন ঘণ্টা পরপর ছাড়ছে লঞ্চ।

গতকাল বৃহস্পতিবার সদরঘাট ঘুরে দেখা যায়, চাঁদপুর ও ভোলাগামী লঞ্চঘাটে যাত্রীদের ভিড় নেই। যাত্রী না থাকায় হাঁকডাক করছেন লঞ্চ শ্রমিকরা। ফলে নির্দিষ্ট সময়সূচি ভেঙে করে লঞ্চ চালাতে হচ্ছে মালিকদের। সকাল থেকে যে কয়টি লঞ্চ ছেড়েছে সেগুলো অর্ধেক যাত্রীবোঝাই করে গেছে।

ইমাম হাসান-৫ লঞ্চের কেবিনবয় শফিকুল ইসলাম বলেন, অবরোধ থাকলেও এ কয়েকদিন মোটামুটি যাত্রী ছিল। লঞ্চের ডেক ভরে যেত। গত বুধবার তফসিলের পর থেকে যাত্রী একদম কম। তাই সময় অনুযায়ী লঞ্চ ছাড়ছে না।

তিনি জানান, সকাল ৬টায় একটি ও ৮টায় একটি লঞ্চ চাঁদপুরের উদ্দেশে ছেড়ে গেছে। এখন ঘাটে যেটি অবস্থান করছে সেটি কখন ছাড়বে তা অজানা। এরপর যাত্রী থাকা সাপেক্ষ আবার হয়তো ২টার পর লঞ্চ চলতে পারে।

ইমাম হাসান লঞ্চের টিকিট কাউন্টারের জামিল হোসেন বলেন, সকাল থেকে হালকা বৃষ্টি ছিল। যাত্রী নেই বললেই চলে। চাঁদপুর দিয়ে নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনীর যাত্রী ছিল। জেলা শহরগুলো থেকে মানুষ কীভাবে বাড়ি পৌঁছাবে সেই আতঙ্ক রয়েছে সবার মাঝে।

সদরঘাটের হকাররা জানিয়েছেন, যাত্রী সংকটে তাদের বেচাকেনায় ভাটা পড়েছে। ফল বিক্রেতা কবির বলেন, প্রতিদিন যে ফল নিয়ে আসতাম বিক্রি করে চলে যেতাম। এখন আর তা সম্ভব হয় না। সকাল-দুপুর-রাত সদরঘাটের যাত্রীর অবস্থা একই রকম।

লঞ্চমালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, যাত্রী না থাকলে আমরা তো আগের মতো আধাঘণ্টা-একঘণ্টা পর লঞ্চ চালাতে পারি না। যাত্রী সংকটের কারনে শিডিউল ভাঙতে হয়েছে। কিছু করার নেই।

পদ্মা সেতুর ফলে দক্ষিণ অঞ্চলের নৌযোগাযোগ খাতে ধস নেমেছে। লোকসানের ‘অজুহাত’ দেখিয়ে বরিশাল-ঢাকা নৌপথে রোটেশনে (পালা) লঞ্চের সংখ্যা কমিয়ে দুটিতে নামিয়ে এনেছেন মালিকরা। তবে পর্যাপ্ত লঞ্চ চলাচল না করায় যাত্রীদের দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

বিশেষ করে কেবিনের টিকিট মিলছে না। লঞ্চ-সংকটের সুযোগ নিয়ে কেবিনের টিকিট কালোবাজারে বিক্রির অভিযোগ উঠেছে। একেকটি টিকিট ২০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। গত ১৮ আগস্ট রোটেশন প্রথা চালু করেন লঞ্চ মালিকরা। নতুন এ নিয়মে প্রতিদিন বরিশাল নৌবন্দর থেকে দুটি এবং ঢাকার সদরঘাট থেকে বরিশালের উদ্দেশে দুটি লঞ্চ চলাচল করছে।

নৌযোগাযোগ খাত নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) মনে করছে, বর্তমানে যে সংখ্যক যাত্রী হচ্ছে, তাতে আরও একটি লঞ্চ চালানো সম্ভব। সেবা বাড়লে যাত্রীসংখ্যা আরও বাড়বে। বিআইডব্লিউটিএর তথ্যমতে, পদ্মা সেতু চালুর আগে দৈনিক ছয়-সাতটি লঞ্চ ঢাকা-বরিশাল রুটে চলত। প্রায় ৯০০ যাত্রী ধারণক্ষমতা সম্পন্ন একেকটি লঞ্চে সে সময়ে দৈনিক গড়ে ১ হাজার জন নেওয়া হতো। কেবিন ছিল ছয়টি লঞ্চে কমপক্ষে ১ হাজার ৮০০টি। বর্তমানে চলাচল করা দুটি লঞ্চে গড়ে দৈনিক ১ হাজার ৩০০ যাত্রী যাতায়াত করছেন। এ দুটি লঞ্চে কেবিনের সংখ্যা ৬০০; যা চাহিদার তুলনায় কম।

বিআইডব্লিউটিএর বরিশালের পরিদর্শক কবির হোসেন বলেন, ‘রোটেশন অনুযায়ী দৈনিক দুটি লঞ্চ চলে এ পথে। আগে দৈনিক ছয়-সাতটি চলত। গত সপ্তাহ থেকে রোটেশনের বাইরে কুয়াকাটা-২ নামের আরও একটি চলছে। ছুটির দিনে প্রায় ৬০০ যাত্রী হয় প্রতিটি লঞ্চে। সে ক্ষেত্রে দুটির স্থলে আরও একটি লঞ্চের চাহিদা রয়েছে। এখন কেবিনের সংকট বেশি।’

নৌবন্দর ঘুরে দেখা গেছে, কালোবাজারিরা একজনের (সিঙ্গেল) কেবিন ১ হাজার টাকার স্থলে ১ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করছেন। আর দুজনের (ডাবল) কেবিন বিক্রি করছে ২ হাজারের পরিবর্তে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকায়। মাসুদ আহমেদ নামের এক যাত্রী বলেন, লঞ্চ কম চলাচল করায় কেবিন-সংকট দেখা দিয়েছে। কালোবাজারিরা এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেড় গুণ বেশি দামে টিকিট বিক্রি করছেন। বরিশাল চেম্বার অব কমার্সের সহসভাপতি আমিনুর রহমান ঝান্ডা বলেন, লঞ্চ খাতকে বাঁচিয়ে রাখতে সেবার মান বাড়াতে হবে। লঞ্চ আরও একটি বাড়িয়ে কেবিন বাড়ানো গেলে শীতে লঞ্চে বিলাসীযাত্রী বাড়ত।

জানতে চাইলে এমভি কুয়াকাটা-২-এর মাস্টার মানিক হোসেন বলেন, ‘রোটেশন প্রথা মালিকদের ব্যক্তিগত ইচ্ছায় সৃষ্টি। আমাদের লঞ্চটি রোটেশনের বাইরে চালানো হয়। একটি চক্র লঞ্চ কম থাকার সুযোগে কালোবাজারে বেশি দামে টিকিট বিক্রি করছে। এর সঙ্গে জড়িত লঞ্চের হকাররা। দালালদের এমন তৎপরতায় লঞ্চ খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।’

লঞ্চমালিক সমিতির সহ-সভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, ‘আমরা বর্তমানে বরিশাল-ঢাকা পথে দুটি লঞ্চ চালাচ্ছি। শীত মৌসুমে যাত্রী চাহিদা থাকলে তিনটি করে লঞ্চ চালানোর চিন্তাভাবনা আছে। তবে কেবিনের টিকিট কালোবাজারে বিক্রির অভিযোগ আমার কাছেও এসেছে।’

সাইদুর রহমান রিন্টু আরও বলেন, ‘বরিশাল নৌবন্দরের কালোবাজারি লেদু, ইমামসহ কয়েকজন এ কাজ করে। আমি আমার কাউন্টারে টিকিট বিক্রির সময় মোবাইল ফোন নম্বর লিখে রাখার নির্দেশ দিয়েছি।’

বিআইডব্লিউটিএর বরিশালের বন্দর কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক ভূঁইয়া বলেন, ‘আমাদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী তিনটি লঞ্চ চলাচল করলেও যাত্রী-সংকট হবে না। কিন্তু লঞ্চমালিকরা লোকসানের অজুহাত দেখাচ্ছেন।’

বরিশাল নৌযাত্রী ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক আব্দুর রশিদ নিলু বলেন, ‘এর আগেও লঞ্চে রোটেশন করায় আমরা আন্দোলনের মাধ্যমে সেই প্রথা প্রত্যাহার করিয়েছিলাম। হয়রানি বন্ধ করে যদি লঞ্চের সংখ্যা এবং সেবার মান বাড়ানো হয়, তাহলে যাত্রী আরও বাড়বে। তবে টিকিট কালোবাজারির দৌরাত্ম্য বন্ধের বিকল্প নেই।’

নয়াশতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ