ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

পদ্মার পানিতে মিটবে তৃষ্ণা 

প্রকাশনার সময়: ১১ নভেম্বর ২০২৩, ০৭:৫০

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সঙ্গে যুক্ত ১৬টি ইউনিয়ন এলাকায় গঠন করা হয়েছে ৩৬টি ওয়ার্ড। এ এলাকাগুলো মূল ঢাকা শহরের আশপাশের এলাকা নিয়ে গঠিত। ঢাকা শহরের এসব বর্ধিত এলাকার অধিবাসীদের চাহিদা মেটাতে পদ্মা নদীর পানি সরবরাহ করবে সরকার। এ উদ্দেশ্যে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার যশলদিয়ায় ‘পদ্মা পানি শোধনাগার’ নির্মাণ কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে।

জানা গেছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিন ৪৫ কোটি লিটার বিশুদ্ধ খাবার পানি ৩৫ লাখ মানুষের মাঝে সরবরাহ করা সম্ভব হবে। এখান থেকেই মূলত পানি নিয়ে ঢাকার বর্ধিত এলাকায় সরবরাহ করা হবে। তবে যতদিন প্রকল্পটি শতভাগ বাস্তবায়ন না হবে, ততদিন ভূগর্ভস্থ পানি সরবরাহ করা হবে। এজন্য ৪ হাজার ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘বর্ধিত ঢাকা পানি সরবরাহ রেজিলিয়েন্স’ প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে সরকার। ঢাকা উওর সিটি করপোরেশনের অধীন বেরাইদ, বাড্ডা, ভাটারা, সাতারকুল, হরিরামপুর, উত্তরখান, দক্ষিণখান এবং ডুমনি ইউনিয়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে।

অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অধীন দনিয়া, শ্যামপুর, মাতুয়াইল, ডেমরা, সারুলিয়া, দক্ষিণগাঁও, নাসিরাবাদ এবং মান্ডা ইউনিয়নেও প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, বসিলা, হাজারীবাগ, ঢাকা উদ্যান, মিরপুরের একাংশ অন্তর্ভুক্ত হবে প্রকল্পের আওতায়। এ প্রকল্পে ৩ হাজার ৪২৯ কোটি টাকা ঋণ দেবে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। জুলাই ২০২৪ থেকে জুন ২০২৯ মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে।

স্থানীয় সরকার বিভাগের মহাপরিচালক (পরিকল্পনা, পরিবীক্ষণ, মূল্যায়ন ও পরিদর্শন অনুবিভাগ) ড. মো. সারোয়ার বারী বলেন, ঢাকার চারপাশ প্রতিনিয়ত সম্প্রসারিত হচ্ছে। সেই ধারাবাহিকতায় ঢাকার আশপাশের ১৬টি ইউনিয়ন দুই সিটির আওতায় এসেছে। সম্প্রসারিত ঢাকার বাসিন্দাদের সুপেয় পানি পদ্মা নদী থেকে সরবরাহ করা হবে। আমরা সারফেস ও গ্রাউন্ড ওয়াটারের ব্যবস্থা করেছি প্রকল্পের আওতায়।

স্থানীয় সরকার বিভাগ জানায়, পদ্মা পানি শোধনাগারের উৎপাদিত পানি ঢাকায় সরবরাহের জন্য ৪০ কিলোমিটার পাইপ ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক স্থাপন করা হবে। পাইপের মোট ব্যাস ৪০০ মিলিমিটার থেকে ১৮০০ মিলিমিটার পর্যন্ত। ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক স্থাপনের মাধ্যমে ঢাকা শহরের উত্তর-পশ্চিম অংশে পানি সরবরাহ করা হবে। ৫০ দশমিক ৯ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় যাবে এ পানি। এ লক্ষ্যে ডিস্ট্রিক্ট মিটার্ড এরিয়ার (ডিএমএ) আওতায় ১ হাজার ৫৭৫ কিলোমিটার ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক স্থাপন ও পুনর্বাসন করা হবে। ৪০ কিলোমিটার ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক স্থাপন, ১ হাজার ৫৭৫ কিলোমিটার ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক স্থাপন ও পুনর্বাসন করা হবে।

এছাড়া ১৭০টি গভীর নলকূপও স্থাপন করা হবে। প্রশিক্ষণ-পরার্মশক প্রতিষ্ঠানসহ ভূমি অধিগ্রহণে ব্যয় করা হবে। জানা গেছে, ভূগর্ভস্থ পানির উৎসের ওপর চাপ কমাতে ৩ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা খরচ করে ওয়াসা এই পানি পরিশোধনাগার নির্মাণ করেছে। ২০১৯ সালের জুনে এর উদ্বোধন হয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ওয়াসার এসব উচ্চাভিলাষী কিন্তু প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ প্রকল্পগুলোর কারণেই পানির দাম ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি ওয়াসা আবাসিক সংযোগে ও বাণিজ্যিক সংযোগের ক্ষেত্রে দাম বাড়িয়েছে।

সূত্র মতে, ভূগর্ভস্থ পানির উৎসের ওপর নির্ভরতা কমাতে কয়েকটি পানি পরিশোধনাগার নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে ওয়াসা। তবে একইসঙ্গে সংস্থাটি গভীর নলকূপের সংখ্যা বাড়িয়েছে। স্ট্যান্ডবাই নলকূপসহ ওয়াসার মোট নলকূপের সংখ্যা এখন ১ হাজার ২৯টি। ২০০৯ সালে গভীর নলকূপের সংখ্যা ৫৬০ ছিল।

নাম না প্রকাশের শর্তে ওয়াসার এক কর্মকর্তা জানান, পদ্মার পরিশোধনাগার প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে ঢাকায় পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে বর্তমান অবকাঠামোকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। ৫২৩ কোটি টাকার নতুন পাইপলাইন নেটওয়ার্ক তৈরির এ প্রকল্পের অর্থায়নের জন্য এখনো বিদেশি তহবিল খুঁজছে ওয়াসা।

২০২০ সালের মে মাসে প্রকাশিত ঢাকার মাসিক পানি-উৎপাদন প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই পরিশোধনাগারের গড় উৎপাদনের পরিমাণ ছিল দিনে ১৪ কোটি ৮০ লাখ লিটার। আবার ২০২১ সালের নভেম্বরের প্রতিবেদনে দেখা যায়, উৎপাদনের পরিমাণ বেড়ে ২৭ কোটি লিটার হয়েছে। তবে এই সময়ের মধ্যে সরবরাহ লাইনে উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নয়ন হয়নি।

এদিকে বিশেষজ্ঞদের মতে, জশলদিয়া থেকে পুরান ঢাকা পর্যন্ত বিস্তৃত পাইপলাইনটির ব্যাস ২ মিটার। লাইনটিকে সায়দাবাদ পানি পরিশোধনাগারের পাইপলাইনের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। তবে এ পাইপলাইনের ব্যাস মাত্র ৬০০ মিলিমিটার। ফলে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ কারণেই মূলত সক্ষমতার তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ পানি সরবরাহ হচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা জানান।

ওয়াসার ঠিকাদার রফিকুল ইসলাম খান বলেন, ‘ছোট ব্যাসের পাইপলাইনের কারণে এক-তৃতীয়াংশের চেয়ে বেশি পানি সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। মোহাম্মদপুর হয়ে মিটফোর্ড থেকে শ্যামলী পর্যন্ত প্রস্তাবিত ২ মিটার ব্যাসের বণ্টন লাইন নির্মাণ হলে আমরা পূর্ণ সক্ষমতার উৎপাদন পাব।’

ঢাকা ওয়াসার পরিচালক (টেকনিক্যাল) এ কে এম শহীদ উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ওয়াসার পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত তথ্যকে সমর্থন করে জানান, বিদেশি তহবিলের অভাবে তারা মূল সরবরাহ লাইনের কাজ এখনো শুরু করতে পারেননি।

তিনি জানান, শিগগির পানি উৎপাদনের পরিমাণ দৈনিক ২৯ কোটি লিটারে উন্নীত হতে পারে, কারণ ইতোমধ্যে মিটফোর্ড থেকে ইংলিশ রোডের মাঝে ৫টি পৃথক জায়গার পুরোনো পাইপলাইনের সংযোগ স্থাপিত হয়েছে। শহীদ উদ্দিন জানান, এই পাইপলাইনের ব্যাস ৬০০ মিলিমিটার থেকে ১ মিটারের মধ্যে। তিনি আরও জানান, পুরোনো ঢাকার পাইপলাইনগুলো প্রতিস্থাপন করে উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। প্রকৃত সক্ষমতা অনুযায়ী পানি সরবরাহ করাই ওয়াসার লক্ষ্য বলে জানান তিনি।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, ‘ওয়াসার অনেক প্রকল্প উচ্চাভিলাষী। যেহেতু কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো দিতে পারছে না, বাসিন্দারাও এসব প্রকল্পের পূর্ণ সুফল পাচ্ছেন না।’

তিনি বলেন, সরকারের উচিত প্রকল্পগুলোর ওপর কড়া নজরদারি বজায় রেখে সেগুলোর উপযোগিতা যাচাই করা। রাজধানীর আশপাশে ৪-৫টি নদী থাকা সত্ত্বেও ওয়াসা পদ্মা ও মেঘনা নদী থেকে পানি আনছে। এ কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন এই পরিকল্পনাবিদ।

তিনি বলেন, ‘ওয়াসার উচিত বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা ও অন্যান্য কাছের নদীগুলোর দিকে নজর দেওয়া। এতে খরচ কমবে এবং নদীগুলো থেকে দূষণ কমাতে বাধ্য হবে সরকার।’

তিনি আরও বলেন, ‘ওয়াসার অভ্যন্তরে প্রচুর দুর্নীতি রয়েছে, যার ছাপ পড়েছে প্রকল্পে এবং এর ফলে প্রকল্পগুলোতে মাত্রাতিরিক্ত খরচ দেখানো হচ্ছে। সরকারকে এ ধরনের দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। তাতে অন্তত ২০ শতাংশ খরচ কমবে বলে মনে করেন তিনি।’ নয়াশতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ