পাইকারি বাজার, ভাতের হোটেল, গাড়ি পার্কিং, ঘোড়ার আস্তাবল, অস্থায়ী দোকান, কুঁড়েঘর তৈরি করে চলছে জমজমাট ব্যবসা। অবৈধভাবে দোকান বসিয়ে ভাড়া দেয়া, স্ট্যান্ড থেকে চাঁদাবাজি ও পার্কিং-গ্যারেজ ভাড়া দিয়ে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা।
অবস্থাটা এমন, রাজধানীর ফ্লাইওভার নিচের ফাঁকা জায়গা যেন পুরোটাই টাকার খনি। জড়িত রয়েছেন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, থানা পুলিশ, সিটি করপোরেশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। এসব অস্থায়ী দোকানদারের কাছ থেকে পাওয়া গেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।
জানা গেছে, রাজধানীর মালিবাগ-মৌচাক, কুড়িল ও মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের নিচের ফাঁকা জায়গা যেন টাকার খনি। মাসিক ভাড়া হিসেবে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের নাম ব্যবহার করে অনেকেই এসব ফ্লাইওভারের নিচে জায়গা নিজেদের কবজায় রেখেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কর্তৃপক্ষের অবহেলায় মাদকসেবী, ছিন্নমূল মানুষের আস্তানা আর ব্যবসা কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে ফ্লাইওভারের নিচের খালি জায়গা।
সরেজমিন সোমবার (২৩ আগস্ট) দেখা গেছে, যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা থেকে নিমতলী পর্যন্ত মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের নিচের বিভিন্ন অংশে তিন শতাধিক চা ও ফলের দোকান এবং ভাতের হোটেল গড়ে উঠেছে। এ ছাড়া গুলিস্তানের অংশে রাতে পাইকারি বাজার, মুরগির দোকান, অস্থায়ী জুতার দোকান, মাছের আড়ত গড়ে উঠেছে। বঙ্গবাজার, টিকাটুলীর রাজধানী সুপার মার্কেট ও সায়েদাবাদ এলাকায় ফ্লাইওভারের নিচে ছিন্নমূল মানুষের বাস।
সায়েদাবাদে একটি বড় অংশ ইজারা দেয়া হয়েছে বাসসহ বিভিন্ন যানবাহন রাখার জন্য। এই ফ্লাইওভারের ওয়ারী বিসিসি রোড অংশের চিত্র আরো অদ্ভুত। নিচের পুরো জায়গা রাখা হয়েছে বাস। ফলে জায়গাটি অনেকটাই পরিণত হয়েছে ভাগাড়ে। বঙ্গবাজার ও ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত সড়কের দুইপাশে অবৈধ বাসস্ট্যান্ড।
এতে সড়কে ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। রিকশাভ্যান রাখা হয়েছে এলোমেলোভাবে। এছাড়া ফ্লাইওভারের সড়কের নিচে বিভিন্ন পয়েন্টে ময়লা রাখার ঘরও নির্মাণ করেছে দুই সিটি করপোরেশন। ফ্লাইওভারর নিচে ফলের ব্যবসায়ী তামিরুল ইসলাম নয়া শতাব্দীকে বলেন, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও থানা পুলিশদের খুশি রেখেই ফ্লাইওভারের নিচে দোকান পেতেছেন তারা। ব্যবসা করছেন। মাসিক ৬ হাজার টাকা দিয়েই ব্যবসা করছেন।
তার মতো অনেকেই ফ্লাইওভারের নিচে ব্যবসা করছেন। কেউ বাধা দেয় না। যাত্রাবাড়ী এলাকায় ফ্লাইওভারের নিচে নার্সারি ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিন বলেন, কোথাও বড় পরিসরে জায়গা ভাড়া নেয়ার মতো তার সামর্থ্য নেই। তাই এখানে দোকান বসিয়েছেন তিনি।
বঙ্গবাজারের কাপড়ের শামিয়ানা ও বেড়া দিয়ে ভাতের হোটেল রয়েছে বেশ কয়েকটি। রবিউল ইসলাম হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের কর্মী আল আমিন বলেন, সিদ্দিক বাজারের বাসা থেকে খাবার রান্না করে এখানে বিক্রি করা হয়। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত এই হোটেল চলে। মাসে সাত হাজার টাকায় জায়গা ভাড়া নিয়েছেন মালিক।
একই অবস্থা মালিবাগ-মৌচাক ফ্লাইওভারের নিচের ফাঁকা জায়গা। মালিবাগ ও মগবাজার মোড়ে গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ টেম্পোস্ট্যান্ড। মালিবাগ রেলগেট ও রাজারবাগে রয়েছে সোহাগ ও গ্রিনলাইন কাউন্টার। এ ছাড়া মগবাজার রেলগেটে ফ্লাইওভারের নিচে জায়গা দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ গাড়ি পার্কিং। কাকরাইলে এস এ পরিবহনের কাউন্টার, কর্ণফুলী মার্কেটের সামনে ইউটার্ন ও শান্তিনগর বাজারের সামনে অবৈধ গাড়ি পার্কিংয়ের ফলে ফ্লাইওভার থেকে নেমে যানজটে পড়তে হয় নগরবাসীকে।
এ ছাড়া মালিবাগের বেশকিছু জায়গায় বস্তিঘর তুলে ভাড়া আদায় করছেন অনেকে। ফ্লাইওভারের ফাঁকা জায়গায় বসবাস করছেন ছিন্নমূল মানুষ। শুধু তাই নয়, ফ্লাইওভারের নিচের জায়গা দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে ভাতের হোটেল, চায়ের দোকান, ফলের দোকান থেকে শুরু করে রকমারি ব্যবসা। মোটরসাইকেল চালক বেলাল হোসেন বলেন, দুই থেকে তিন বছর ধরে এখানে অবৈধভাবে ভাড়ায় পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই পার্কিংয়ে সকাল নয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত চলে। মোটরসাইকেল প্রতি ২০ টাকা আর পিকআপ-মাইক্রো প্রতি ৫০ টাকা ভাড়া নেয়া হয়।
কুড়িল ফ্লাইওভারের নিচের অংশ ব্যবহার হয় রিকশার গ্যারেজ হিসেবে। ৩০০ ফুট অংশে ফ্লাইওভারের নিচের অংশ ব্যবহার হয় গাড়ি মেরামতের কাজে।
এ ব্যাপারে নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব নয়া শতাব্দীকে বলেন, আমাদের দেশে ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হলেও সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এগুলো গলার কাঁটায় পরিণত হচ্ছে। নিচের জায়গা দখল করে নরক বানিয়ে ফেলেছে দখলদাররা। ফ্লাইওভারের নিচে ফাঁকা জায়গায় বাগান, ব্যায়ামগার, গ্রন্থাগার, বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্র, বসার জায়গা সহ ভিন্ন রকম কিছু করা যেতে পারে। অথচ কর্তৃপক্ষের অবহেলায় এগুলো গিলে খাচ্ছে দখলদাররা। মাসে মাসে কোটি কোটি টাকা চাঁদা তুলছে।
তিনি বলেন, আমরা অপরিকল্পিত নগরায়ণের শিকার। বিপুল সম্ভাবনা থাকার পরও নগর হিসেবে ঢাকা অনেক পিছিয়ে দিয়েছি। তাই আমাদের উন্নয়ন ভাবনাগুলো প্রকল্পগুলোয় সবার অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে হবে।
জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ নয়া শতাব্দীকে বলেন, ফ্লাইওভারের নিচে গড়ে ওঠা দোকানগুলো অবৈধ। অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। অনেকেই উড়াল সড়কের নিচের অংশ সবুজায়নের কথা বলেছেন।
তিনি বলেন, উড়াল সড়কের নিচের অংশ সবুজায়ন ও সৌন্দর্যবর্ধন করা অনেক ব্যয়বহুল। তা বাস্তবায়নের পর তত্ত্বাবধান করা আরো কঠিন। শিগগিরই মেয়র ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে আলোচনা করে একটি কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
নয়া শতাব্দী/এসএম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ