২০১৭ সালের জানুয়ারিতে উত্তরায় ডিসকো এবং নাইন স্টার গ্রুপের দ্বন্দ্বে নিহত হয় কিশোর আদনান কবির। তার পরের মাসে তেজকুনি পাড়ায় দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বে খুন হয় কিশোর আজিজুল হক। ঢাকার বাইরে থেকেও প্রায়ই কিশোর গ্যাংয়ের দ্বন্দ্বে খুনখারাবির খবর পাওয়া যায়।
বরগুনার নয়ন বন্ড তার ০০৭ গ্রুপ নিয়ে জনসম্মুখে রিফাত শরিফকে কুপিয়ে হত্যা করে। এ হত্যার জন্য ১১ কিশোরকে কারাদণ্ড দিয়ে বরগুনার আদালত বলেছেন, ‘সারা দেশে কিশোর অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে। গডফাদাররা এই কিশোরদের ব্যবহার করছে।’ দেশজুড়ে বাড়ছে কিশোর অপরাধ। রাজনৈতিক দলের ব্যানারে পাড়া-মহল্লার নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বেপরোয়া কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। জমিসহ বিভিন্ন দখল বাণিজ্য ও এলাকায় আধিপত্য ধরে রাখতেই ব্যবহার করা হয় কিশোর গ্যাং সদস্যদের।
প্রতিপক্ষের ওপর হামলা ও মারধরেও কিশোর গ্যাং সদস্যরা জড়িত। প্রায়ই ঘটছে হামলা, সংঘর্ষের মতো ঘটনা। এমনকি হত্যার মতো নৃশংস ঘটনাও ঘটছে কিশোর গ্যাং সদস্যদের হাতে। কোনো কোনো কিশোর-তরুণ গ্যাং কাজ করছে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের হয়ে। দেশেজুড়ে গড়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং। হত্যা-ধর্ষণের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে তারা। কিন্তু এর নেপথ্যে কী?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক এ বিষয়ে বলেন, আমাদের দেশে কিশোর অপরাধ নানাবিধ কারণে বাড়ছে। দেশে যখন নির্বাচন ঘনিয়ে আসে তখন একটি পক্ষ এদের দিয়ে অপরাধ সংঘটিত করে নানা ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করে।
আমাদের দেশে এটা নিয়ন্ত্রণের দরকার কিশোর কারাগারের বিষয়ে আমাদেরও চিন্তা করতে হবে। মূলত ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মাঝে আমরা কিশোর গ্যাংয়ের মূল হোতাদের খুঁজে পাই। তাদের ব্যবসায়িক বা রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য তাদের দিয়ে ব্যবহার করছে। কিশোর গ্যাংয়ের মূলহোতাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না।
কিশোর গ্যাংয়ের খুন, ধর্ষণসহ নানা অপকর্ম ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। এ গ্যাং গড়ে তোলার নেপথ্যে রয়েছে অন্তত দুই ডজন মূল কারণ— এমনটি মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, অস্ত্র ও মাদকের দৌরাত্ম্য, ভিনদেশি কালচারের অনুপ্রবেশ, বিশৃঙ্খল পারিবারিক পরিবেশ, কর্মহীনতা এবং হতাশা বোধ থেকে কিশোররা জড়িয়ে পড়ছে ‘গ্যাং কালচারে’। এছাড়া একাকিত্ব, অভিভাবকের সান্নিধ্য না পাওয়া, শিক্ষকদের অতিমাত্রার শাসন, খারাপ ফলাফল, সহপাঠীর মাধ্যমে বিদ্রুপ এবং স্কুলের ম্যানেজমেন্টের অব্যবস্থাপনার ও পাঠদান প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ার বিষয়গুলো উসকে দিচ্ছে গ্যাং কালচার।
কো-এডুকেশনে হিরোইজম, খারাপ সাহচর্য, আড্ডাবাজি, অপরাধ জগতে যুক্ত হওয়ার মানসিকতা থেকে অনেকে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য হচ্ছে। পাশাপাশি রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার হাতছানি, অল্প বয়সে যৌন আসক্তি, হীনমন্যতা থেকে ব্যক্তি সত্তা প্রমাণের চেষ্টা, দস্যুপনা, দুরন্তপনা ও চরমপন্থা মনোভাব থেকেও গ্যাংয়ে যোগ দেওয়ার প্রবণতা তৈরি হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, সারা দেশেই কিশোর গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রক বা পৃষ্ঠপোষক রয়েছে। রাজধানীতেই আছে শতাধিক নিয়ন্ত্রক। পর্দার আড়ালে থেকে রাজনৈতিক অভিমত, একই সমাজ ব্যবস্থার ভেতর যখন দরিদ্র শ্রেণি ও উচ্চবিত্তের বসবাস থাকে তখন উচ্চবিত্তের জীবনযাত্রা দেখে দরিদ্র শ্রেণির সন্তানরা নিজেদের ভাগ্যবঞ্চিত মনে করে।
তাদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা তৈরি হয়। এ হতাশা থেকে কিশোর গ্যাংয়ের সৃষ্টি হতে পারে। সমাজে অস্ত্র ও মাদকের দৌরাত্ম্য গ্যাং কালচারকে উসকে দেয়। সমাজে যখন একটি গ্যাংয়ের অস্তিত্ব থাকে তখন তার বিপরীতে আরেকটি গ্যাং তৈরি হতে পারে। একে অপরকে দেখে অনেকে গ্যাং সদস্য হতে উৎসাহী হয়। সিনিয়ররা যখন জুনিয়রদের নিরাপত্তা দিতে না পারে তখন জুনিয়ররা গ্যাং কালচারে জড়িয়ে পড়ে। ভিনদেশি কালচারের অনুপ্রবেশে কিশোররা সহিংসতা সম্পর্কে জানতে পারে। সহিংসতায় আকৃষ্ট হয়ে ওই কালচার রপ্ত করতে চায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, পারিবারিক বিশৃঙ্খল অথবা বিচ্ছিন্ন পরিবারের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়। অনেক নেশাগ্রস্ত পরিবার আছে। সেখানে মাদক বা নেশাজাতীয় দ্রব্যের আসর বসে। কোনো পরিবারের কেউ গ্যাং সদস্য থাকলে পরিবারের অন্য সদস্য এতে যুক্ত হতে পারে।
পরিবারের কোনো সদস্য বা পিতা-মাতা রোল মডেল হতে ব্যর্থ হলে বা পিতা-মাতার কর্ম অদক্ষতা ও বেকারত্বের ফলে আর্থিক উপার্জনের জন্য সন্তানদের মধ্যে গ্যাং সদস্য হওয়ার প্রবণতা দেখা দিতে পারে। আবার কখনো কখনো কর্মজীবী বা ব্যবসায়ী পিতা-মাতার পক্ষে সন্তানকে সময় দেয়া দুরূহ হয়ে পড়ে। এতে সন্তানের মধ্যে একাকিত্ব ও হতাশা তৈরি হয়।
কোনো পরিবারে একাধিক বিয়ে থাকলে সৎভাই-বোনদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত তৈরি হয়। যেখানে পারিবারিক অশান্তি থাকে সেখানে পিতামাতার দ্বন্দ্ব-সংঘাত লেগেই থাকে। তখন সন্তানের প্রতি মা-বাবার কন্ট্রোল থাকে না। এ সুযোগে সন্তানরা বখে যায়। একপর্যায়ে যোগ দেয় গ্যাংয়ের সঙ্গে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) এক কর্মকর্তা বলেন, রাজধানীতে শতাধিক কিশোর গ্যাংয়ের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। প্রত্যেক গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রক রয়েছে। এদের বেশির ভাগই হোয়াইট কালার ক্রিমিনাল। কেউ কেউ রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। তাদের ধরতে শিগগিরই অভিযান চালানো হবে। তাই কৌশলগত কারণে এ মুহূর্তে তাদের নাম প্রকাশ করা যাচ্ছে না।
সূত্রমতে, রাজধানীতে ডিসকো বয়েস, বুলেট গ্রুপ, আব্বা গ্রুপ, জাউরা গ্রুপ, ডি কোম্পানি ও জাহাঙ্গীর গ্রুপ, বড় ভাই, ভাইয়া, অ্যাকশন, ডিসকো, ডিজে, লাভার বয়স, পাওয়ার বয়েজ, টাইগার, লায়ন, বিগ বস, নাইন স্টার, নাইন এমএম বয়েজ, এনএনএস, জিইউ, এফএইচবি, ক্যাকরা, কে-নাইন, পোলাপান, কঠিন ভয়েস গ্রুপ সহ আরও নানা নামে রয়েছে এসব গ্যাং। এসব গ্যাংয়ের সদস্য প্রায় সাতশ।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মো. হাবিবুর রহমান বলেন, যেসব সন্তানের ওপর অভিভাবকদের নিয়ন্ত্রণ নেই তারা সহজেই গ্যাং কালচারে জড়িয়ে পড়ছে। অল্প বয়সিদের মধ্যে সহজেই হিরো হওয়ার প্রবণতা এবং মাদক সেবনে জড়িত হওয়া গ্যাং কালচারের গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
ডিএমপি কমিশনার বলেন, ডিএমপিতে কিশোর গ্যাংয়ের তালিকা আগে থেকেই আছে। নতুন করে কোনো গ্যাং তৈরি হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে প্রত্যেক অপরাধ বিভাগের ডিসিদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী তালিকা হালনাগাদ করা হচ্ছে।
এছাড়া অপরাধ বিভাগের উপ-কমিশনারের কার্যালয় এবং থানা পুলিশের মাধ্যমে মোটিভেশনাল কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, কোনো বড় ধরনের অপরাধ হলে মামলা হয়। তখন কিশোর অপরাধীদের ধরে আইনের আওতায় আনি। কিন্তু কিশোররা অহরহ ছোটখাটো অপরাধ করছে। বিষয়টি কেউ আমলে নিচ্ছে না। পুলিশকেও জানাচ্ছে না। তাই ছোটখাটো অপরাধে অভ্যস্ত হওয়ার পর তারা বড় ধরনের অপরাধে জড়াচ্ছে বলে ডিএমপি কমিশনার জানান।
ডিএমপির সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, রাজধানীতে থাকা কিশোর গ্যাংগুলোর নিয়ন্ত্রকদের মধ্যে রয়েছে নাফিজ আলম ডন (পাওয়ার বয়েজ), সেতু বিন সাত্তার (ডিসকো বয়েস), আক্তারুজ্জামান ছোটন (বিগ বস), রাজু ওরফে তালাচবি রাজু (নাইন স্টার), নাঈম কমিশনার (নাইন এমএম বয়েজ), সাদাত বিন জাকির (এনএনএস), জাহিদুল ইসলাম জুইস (জিইউ), জিহান (এফএইচবি), পোঁটলা বাবু ওরফে আব্দুল্লাহ (ক্যাকরা), জুয়েল (কে-নাইন), হাফিজুল ইসলাম বাবু (মিরপুর, কাফরুল, ভাষানটেক) বিহারি রাসেল, বাবু ওরফে পিচ্চি বাবু, সাইফুল, সাব্বির গ্যাং, রাজন, তেজগাঁয়ের মাঈনুদ্দিন, কাফরুলের নয়ন, উত্তরার শান্ত, আটিপাড়ার শান্ত ও মেহেদী, বংশালের জুম্মন, মুগদার চান-জাদু প্রমুখ।
এছাড়া মিরপুর-১ নম্বরের শাহ আলী মাজার এলাকায় সোহেলের নেতৃত্বে একটি গ্যাং ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত থাকে। এ গ্যাংয়ের সদস্যদের মধ্যে রয়েছে আকাশ, তুফান, ইসলাম, রাফি, আলী, হাসান মামুন, রাব্বি প্রমুখ। স্থানীয়দের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এ গ্যাং সদসদের শেলটারদাতা বা নিয়ন্ত্রক হলো নাবিল খান।
সারা দেশের প্রত্যন্ত এলাকাতেও এখন কিশোর গ্যাং সক্রিয়। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা তাদের ব্যবহার করেন। আর সেই ক্ষমতায় গ্যাংগুলো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। হত্যা ছাড়াও ধর্ষণ, মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
কিশোর গ্যাং যে কত ভয়াবহ হয়ে উঠেছে তা ২০২১ সালে ১১ জানুয়ারি তৎকালীন পুলিশের আইজি বেনজীর আহমেদের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘পুলিশের জন্য এ কিশোর গ্যাং বা কিশোর অপরাধীরাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।’ তবে এ কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে পরিবারের ভূমিকাকেই সবচেয়ে বড় বলে মনে করেন পুলিশের সাবেক এ প্রধান।
কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের তথ্যমতে, যে কিশোররা ওইসব কেন্দ্রে আছে তাদের ২০ শতাংশ হত্যা এবং ২৪ শতাংশ নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার আসামি। ১৪ থেকে ১৬ বছর বয়সের কিশোররাই বেশি অপরাধে জড়াচ্ছে। কিশোররা, চুরি, ছিনতায়ের মতো অপরাধেও জড়িয়ে পড়ছে বলে কেন্দ্রের তথ্যে জানা যায়।
পুলিশের সাবেক আইজি নূর মোহাম্মদ জানান, পরিস্থিতি যে ভয়াবহ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে তিনি মনে করেন, ‘এখানে পুলিশ সব কিছু করতে পারবে না। পরিবার ও সমাজকে দায়িত্ব নিতে হবে। আর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোরও দায়িত্ব আছে। প্রত্যেক থানায় সমাজসেবা অধিদপ্তরের একজন করে কারেকশন অফিসার আছেন তারাও দায়িত্ব পালন করেন না।’
পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদ গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে ১৮ বছরের নিচে বয়স হলে শিশু বিবেচনা করা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। নূর মোহাম্মদও মনে করেন, মানসিক বয়সও বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। কারণ পুরোপুরি পরিকল্পনা করে ফৌজদারি অপরাধ করার সক্ষমতা যার আছে তার সাধারণ বয়স ১৮-এর নিচে হলেও মানসিক বয়স বেশি।
নয়া শতাব্দী /আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ