শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৩ পৌষ ১৪৩১

টেকনাফের ‘যুবরাজ’ মিজানের হাতে মাদক সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ

প্রকাশনার সময়: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২০:২৭ | আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২০:৪১

মাদকের আন্ডারওয়ার্ল্ডে তিনি নতুন ‘যুবরাজ’ হিসেবে পরিচিত। কেউ কেউ বলেন গডফাদার। বর্তমানে তার হাতেই টেকনাফের মাদক সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ। কোস্টগার্ডের সোর্স হিসেবে ক্ষমতা রপ্ত করা এই যুবরাজের ভয়ঙ্কর-কুৎসিত চেহারা বেরিয়ে আসে অনুসন্ধানে।

তার নাম মো. মিজান। তিনি টেকনাফ সদর ইউনিয়নের কেরুনতলীর বাসিন্দা আব্দুর রশিদের ছেলে। সম্প্রতি মিজানের বিষয়ে অনুসন্ধানে নেমে চোখ আটকে যায়।

স্থানীয়রা বলছেন, কোস্টগার্ডের সোর্স হিসেবে পরিচিত মিজানই টেকনাফের ইয়াবা জগতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী। তার ইশারার বাইরে কিছুই হয় না। সীমান্ত জনপদে মাদক আগ্রাসন বন্ধের জন্য তার ইচ্ছাশক্তিই যথেষ্ট।

স্থানীয় একাধিক সূত্র জানান, কোস্টগার্ডের প্রভাব খাটিয়ে সীমান্ত এলাকা থেকে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম সড়কে অনেকটা বিনা বাধায় তার মাদকের চালান পাচার করা হয়। মাঝেমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার মাদকের চালান আটক করতে চাইলেও নানান কারিশমা, অদৃশ্য অপশক্তি ও নানা প্রভাবে তার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন।

একসময় তার নামে মাদক পাচারের অভিযোগ এনে একটি মামলা করে টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ। কিন্তু এতেও তাকে দমানো যায়নি। ফলে প্রশাসনের সাথে পেরে ওঠা এই যুবরাজের সাহস এখন আকাশচুম্বী।

সূত্র জানায়, এই মাদক যুবরাজের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে টেকনাফের মাদক কারবারীরা। তার নেতৃত্বে নাফ নদী সীমান্তের কেরুনতলী, বরইতলী, জাদিমুরা, শাহপরীরদ্বীপ, সেন্টমার্টিনসহ ৫-৬টি স্পটে মিয়ানমার থেকে প্রকাশ্যে আসছে মাদকের চালান। শুধু মাদক কারবারেই ক্ষান্ত নন মিজান; এসব স্পটে মিজানের নেতৃত্বে তার অনুসারীরা মাদকের চালান খালাসে চাঁদা আদায় ও সরবরাহ করছে দাপটের সঙ্গে। এতে চরম উৎকণ্ঠা ও আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে স্থানীয়রা।

আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কক্সবাজার জেলার অনেক কর্মকর্তা বিষয়টি ওয়াকিবহাল নন। তবে কোস্টগার্ডের টেকনাফ দপ্তরের সংশ্লিষ্টরা আদৌ এ যুবরাজ কিংবা তার বাহিনীর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা না নেওয়ায় নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে জনমনে। উল্টো বিভিন্ন প্রশাসনিক দপ্তর ও থানা এলাকায় কোস্টগার্ডের কর্তাব্যক্তিদের নিয়ে প্রকাশ্যে মহড়া দেওয়া, দেন দরবার, বেপরোয়া ঘোরাফেরার বিষয়টি আইন শৃঙ্খলার চরম অবনতি ডেকে আনবে বলে অভিমত সচেতন মহলের।

জানা গেছে, মিজানের নামে টেকনাফ মডেল থানায় রয়েছে মাদক মামলা। ২০১৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ৪ হাজার পিস ইয়াবাসহ পুলিশের হাতে আটক হন তার সহযোগী মো. মোজাম্মেল হোসেন। সঙ্গে মিজান থাকলেও সেদিন কৌশলে পালিয়ে যান তিনি। ওই মামলায় আদালতে মিজান ও মোজাম্মেলকে অভিযুক্ত করে ২০২১ সালে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনও জমা দেয় টেকনাফ থানা পুলিশ।

মিজান মাদক মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি হওয়ার পরেও বীরদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কোস্টগার্ডের সোর্স হিসেবে পরিচিতি থাকায়, তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়না বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

স্থানীয়রা জানান, মিয়ানমার-বাংলাদেশের টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে এবার বাংলাদেশ থেকে পাচার হচ্ছে জ্বালানি তেলসহ নিত্যপণ্য। যুদ্ধবিগ্রহ লেগে থাকায় দেশটি চরম জ্বালানি তেল ও খাদ্য সংকটে ভুগছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মাদক আমদানি করতে কোস্টগার্ডের সোর্স মিজানের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট দেশটিতে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেল ও নিত্যপণ্য পাচারের নকশা এঁকেছে। বিনিময়ে পাচ্ছে সমমূল্যের ইয়াবা কিংবা চলনশীল অন্য কোনো মাদকদ্রব্য।

আর এই ভয়ঙ্কর তেল পাচারকাণ্ডে জড়িত রয়েছে মিজান সিন্ডিকেটের একাধিক জনপ্রতিনিধি, চিহ্নিত মাদক কারবারি এবং সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের শীর্ষ কয়েকজন অসাধু ব্যক্তি। মিজান কোস্টগার্ডের মাইম্যান হিসেবে পরিচিত হওয়ায়, জ্বালানি তেলসহ অন্যান্য জিনিসপত্রের পাচারকাণ্ড দিনের পর দিন আরও বেড়েই চলছে।

জানা গেছে, ২৫ ডিসেম্বর ভোরে টেকনাফ সদর ইউনিয়নের লম্বরি নৌকা ঘাটে কোস্টগার্ড অভিযান চালিয়ে মিয়ানমারের উদ্দেশ্যে যাওয়ার অপেক্ষারত ৫টি নৌকা তল্লাশি চালিয়ে মিয়ানমারে পাচারের উদ্দেশ্যে রাখা ১৫ বস্তা শুকনা মরিচ, ৪০ বস্তা পেঁয়াজ, এক বস্তা তামাক পাতা, ৩ বস্তা টেস্টিং সল্ট, এক হাজার ৮২১ লিটার অকটেন, ৩ হাজার ৭৫২ লিটার সয়াবিন তেল ও ১৩৬ লিটার ডিজেল জব্দ করা হয়। এ সময় ২৪ জন পাচারকারীকে আটক করে কোস্টগার্ড।

পরেরদিন বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে কোস্টগার্ডের টেকনাফ স্টেশন কমান্ডার লে. কমান্ডার এইচএম লুৎফুল লাহিল মাজিদ ১৯ জনকে আটক করেছে বলে প্রচার করে।

সূত্রে জানা যায়, অভিযানে ২৪ জনকে আটক করা হলেও ৫ জনকে ছেড়ে দেয় কোস্টগার্ড। সংবাদ সম্মেলনের পর রাতের আঁধারে কোস্টগার্ড অফিসের পেছনের দরজা দিয়ে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। কোস্টগার্ডের সোর্স নামে পরিচিত মো. মিজানের হাতে প্রতিজন ৮০ হাজার টাকা করে ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা দিলে মুক্তি মেলে তাদের। এসব তথ্য নিশ্চিত করেন টাকার বিনিময়ে মুক্ত হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনরা।

সূত্র বলছে, মিজানের স্পীডবোট চালক ও তার সোর্স হিসেবে কাজ করেন সেন্টমার্টিন ৬নং ওয়ার্ডের মুকল আহমেদের ছেলে সফি ও হোসেন আহমেদ। মিজান তার নিজস্ব আস্তানায় বসে সংগ্রহ করতেন মাদক পাচারকারীর তথ্য। আর কোস্টগার্ডের সাথে অভিযানে পাঠাতো সফি ও হোসেন আহমেদকে। এতে জব্দ করা মাদক সরিয়ে এবং সোর্স ম্যানি হিসেবে কোস্টগার্ড থেকে পাওয়া টাকা তিন ভাগ করতেন তারা।

এভাবে তারা দীর্ঘবছর মাদক পাচার কিংবা জব্দ করে আসলেও সম্প্রতি তাদের ব্যবসায়ীক বন্ধনটি ভেঙে যায়। কারণ হিসেবে জানা যায়, গেল বছরের মার্চ মাসের দিকে একটি মাদকের চালান জব্দ করতে মিজান কোস্টগার্ডের সাথে অভিযানে পাঠায় সফি ও হোসেনকে। এতে ১০ লক্ষ পিস ইয়াবা জব্দ করা হয়। পরে সেখানে অংশ নেন মিজান। জব্দ করা ১০ লক্ষ পিস ইয়াবা থেকে মিজান ৯ লক্ষ ৩০ হাজার ইয়াবা অন্যত্র নিয়ে যায়। পরে কোস্টগার্ড ২ লক্ষ ইয়াবা জব্দ করা হয়েছে বলে প্রচার করে।

কোস্টগার্ডের সাথে মিলে গায়েব করা ৮ লক্ষ ইয়াবার ভাগ দাবি করে সাফি ও হোসেন। এই ঘটনায় তাদের মধ্যে অভন্তরীণ দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এর জেরে মিজান তার নিজস্ব সন্ত্রাসী দিয়ে সাফি ও হোসেনকে সেন্টমার্টিন থেকে তুলে নিয়ে তার আস্তায় নিয়ে যায়। সেখানে তাদের ওপর চালানো হয় নির্মম নির্যাতন। নির্যাতনের এক পর্যায়ে তাদের ৩ লক্ষ ইয়াবাসহ আটক দেখিয়ে তাদের কারাগারে পাঠান মিজান। বর্তমানে তারা কক্সবাজার কারাগারে।

এদিকে এক অনুসন্ধানে জানা যায়, কেরুনতলী ও জাদিমুরা সীমান্ত দিয়ে মায়ানমারে জ্বালানি তেল ও নিত্যপণ্য পাচারে জড়িত সিন্ডিকেটটি স্থানীয় মিজানের নেতৃত্বে চলছে বলে নিশ্চিত করেছে একাধিক সূত্র। তার সিন্ডিকেটের সঙ্গে আরও কাজ করছে- কোস্টগার্ডের কতিপয় সদস্য।

এদের মধ্যে মিজানের নেতৃত্বে রয়েছে ৬টি নৌকা। এসব নৌকা দিয়ে জ্বালানি তেল ও খাবার মায়ানমারে পাচার করা হয়। আর নাফ নদী তীরবর্তী মিজান চক্রের কয়েকটি মুদি দোকান। ওইসব দোকান থেকেই মিজানের মাছ ধরার ট্রলারে জ্বালানি তেল সরবরাহের আড়ালে মায়ানমারে তেলসহ খাদ্যদ্রব্য পাচার করে থাকে। মিজানের এই সিন্ডিকেটে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে থাকেন কোস্টগার্ডের কতিপয় সদস্য। তারা পাচারের জন্য প্রস্তুতকৃত জ্বালানি তেলসহ অন্যান্য জিনিসপত্র পাচারের পূর্ব মুহুর্তে পর্যন্ত পাহারা দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। বিজিবি কিংবা প্রশাসনের প্রবেশ বা চলাচলের পথে মিজানের নেতৃত্বে একটি দল ওৎ পেতে বসে থাকেন। অন্যান্য প্রশাসনের লোকজনের উপস্থিতি টের পেলে সিন্ডিকেটের অপরাপর সদস্যদের সতর্ক করে দেন মিজান। এছাড়াও মিজানের বাড়িতে তেল মজুদ করে রেখে সুযোগ বুঝে পাচার করে বলে জানা যায়।

টেকনাফের বিভিন্ন এলাকার লোকজন বলেন, দেশে প্রতি লিটার অকটেন ১৩৫ ও ডিজেল ১১১ এবং সয়াবিন প্রতি লিটার ১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ সীমান্ত পার করতে পারলেই এসব তেল সোনার দামে বিক্রি করা যাচ্ছে। ফলে কোস্টগার্ডের মাইম্যান হিসেবে পরিচিতি থাকা মিজানের নেতৃত্বে একাধিক সিন্ডিকেট মরিয়া হয়ে উঠেছে। তারা শ্যামলাপুর, কেরুনতলী, জাদিমুরা, বড়ইতলী, লম্বরী, মহেশখালীয়াপাড়া, সাবরাং, শাহপরীর দ্বীপসহ সমুদ্র উপকূলের অন্তত ৮টি পথ ব্যবহার করছে।

অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্যের জন্য মো. মিজানের সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার ফোনে সংযোগ পাওয়া যায়নি। পরে তার হোয়াটসঅ্যাপে ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হলে, তিনি তার এক আত্মীয়ের মাধ্যমে প্রতিবেদককে গুম করার হুমকি দেন। পরবর্তীতে প্রতিবেদককে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন তিনি।

এ বিষয়ে জানতে টেকনাফ কোস্টগার্ডের স্টেশন কমান্ডার লে. কমান্ডার এইচএম লুৎফুল লাহিল মাজিদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনিও ফোন রিসিভ না করায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

তবে মিজানের এইসব অভিযোগের বিষয়ে জানাজানি কিংবা গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর মিজানের সাথে অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অপরাধে কোস্টগার্ডের কয়েকজন সদস্যকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম পূর্ব জোনের জোনাল কমান্ডার ক্যাপ্টেন মো. জহিরুল হক।

তিনি বলেন, ‘মিজান ও কোস্ট গার্ডের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশের টেকনাফ কোস্টগার্ডের একটি গ্রুপকে সরিয়ে নিয়েছি। মিজানকে নিয়েও অনেক কাজ করেছি। মিজানের একটি বিশাল সিন্ডিকেট রয়েছে সেখানে। তার ভয়ে অনেক সোর্স আমাদের সাথে কাজ করতে চায় না। কাজ করতে চাইলে তাদেরকে জীবননাশের হুমকি দেয়। তাই আমরা মিজানকে হঠাৎ করে ছাড়তে পারছি না। তাকে ছাড়লে ক্রাইম বেড়ে যাবে। তাই আমরা তাকে সময় নিয়ে সরিয়ে দেবো’।

নয়াশতাব্দী/ডিএ/এনএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ