রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরীতে সগিরা মোর্শেদ হত্যা মামলার রায় ঘোষণার জন্য আগামী ২০ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করেছেন আদালত।
এ মামলায় রায় ঘোষণার জন্য আজ বৃহস্পতিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) দিন ধার্য ছিল। কিন্তু রায় প্রস্তুত না হওয়ায় ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৩ এর বিচারক মোহাম্মদ আলী হোসাইনের আদালত রায় ঘোষণা পিছিয়ে নতুন দিন ধার্য করেছেন।
বাদীপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহমেদ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এর আগে গত ২৫ জানুয়ারি একই আদালত রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে এ মামলায় রায়ের জন্য ৮ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করেন।
মামলার আসামিরা হলেন- সগিরা মোর্শেদের ভাসুর ডা. হাসান আলী চৌধুরী, জা সায়েদাতুল মাহমুদা ওরফে শাহিন, শ্যালক আনাছ মাহমুদ রেজওয়ান, মারুফ রেজা ও মন্টু মণ্ডল।
রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল থেকে মেয়েকে আনতে গিয়ে খুন হয়েছিলেন সগিরা মোর্শেদ। বলা হচ্ছিলো, ছিনতাইকারীর হাতে খুন। কিন্তু ৩০ বছর পর অনুসন্ধানে উঠে আসে এ মামলার অজানা রহস্য। জানা যায় পারিবারিক বিরোধের জেরে হয় এই হত্যাকাণ্ড।
১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই। রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরীতে ভিকারুননেসা স্কুলে মেয়েকে আনতে গিয়ে খুন হন সাগিরা মোর্শেদ। সেদিন রাতেই রমনা থানায় হত্যা মামলা করেন তার স্বামী সালাম চৌধুরী। প্রথমে ছিনতাই মামলা হলেও ২০১৯ সালের ২০ জুন আদালতে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়, যা পরে হাইকোর্টের নজরে আনেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু। পরে সে সূত্র ধরে পাল্টে যায় পুরো ঘটনা, পিবিআই প্রধান জানান, এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।
২০২০ সালের ১৬ জানুয়ারি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পুলিশ পরিদর্শক রফিকুল ইসলাম আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
তদন্ত কর্মকর্তা অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেন, সগিরা মোর্শেদের পরিবারের সঙ্গে আসামি শাহীনের বিভেদ তৈরি হয়েছিল। এছাড়া সগিরাকে অনেক অপছন্দ করতেন এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে সগিরা-শাহীনের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। সম্বোধন করা নিয়েও পারিবারিক দ্বন্দ্ব ছিল।
সগিরার কাজের মেয়েকে মারধর করে আসামি ডা. হাসান আলী চৌধুরী। এ নিয়ে পারিবারিক বৈঠকে শাহীন সগিরাকে দেখে নেয়ার হুমকি দেয়। আসামিরা নিজেদের বাসায় বসে সগিরাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ডা. হাসান আলী তার চেম্বারে অপর আসামি মারুফ রেজার সঙ্গে ২৫ হাজার টাকায় হত্যার চুক্তি করে।
তদন্তের পর এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ৪ জনকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই। গ্রেপ্তারকৃতরা আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে উঠে আসে সগিরা মোর্শেদকে কীভাবে হত্যা করা হয়।
ডা. হাসান আলী চৌধুরী আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে বলেন, তিনি ইস্কাটনে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতেন। আসামি মারুফ রেজা তার রোগী ছিলেন। সে শহরে মাস্তানি করতো। সগিরা মোর্শেদকে শায়েস্তা করার জন্য তিনি তাকেই ঠিক করেন। তার সঙ্গে ২৫ হাজার টাকায় চুক্তি হয় এ কাজের জন্য। কিন্তু সে সগিরা মোর্শেদকে চিনতেন না। এজন্য তার শ্যালককে দায়িত্ব দেন সগিরা মোর্শেদকে চিনিয়ে দেয়ার জন্য।
১৯৮৯ সালের ২৪ জুলাই সগিরা মোর্শেদের মেজো বোন আমেরিকা থেকে ঢাকায় আসেন। এজন্য সগিরা মোর্শেদ ও আব্দুস সালাম তাদের রাজারবাগের বাসায় অনুষ্ঠান করেন। সেখানে সগিরা মোর্শেদের ভাই ডা.গওজ নেওয়াজ উপস্থিত হতে পারেননি। গওজ নেওয়াজকে খাবার পৌঁছে দেয়ার জন্য সগিরা মোর্শেদ ২৫ জুলাই বড় মেয়েকে ভিকারুননিসা নূন স্কুলে নামিয়ে দিয়ে মেঝ মেয়ে ও ছোট মেয়েকে নিয়ে ধানমন্ডি বাবার বাসায় যান।
ওইদিনই বিকেল ৪টার দিকে সগিরা মোর্শেদ বাবার বাসা থেকে রাজারবাগে স্বামীর বাসায় ফিরে আসেন। সগিরা মোর্শেদের বড় মেয়ে সিদ্ধেশ্বরী ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ডে শিফটে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়তো। তার স্কুল ছিলো দুপুর সোয়া একটা থেকে। মা বড় মেয়েকে নিয়মিত রিকশায় স্কুলে আনা নেয়া করতো।
বিষয়টি ডা. হাসান আলী চৌধুরী, তার স্ত্রী শাহিন এবং শ্যালক আনাস মাহমুদ জানত। ২৫ জুলাই হাসান আলী চৌধুরী দুপুর দেড়টা থেকে দুইটার মধ্যে আনাসকে মৌচাকে গিয়ে মারুফ রেজাকে যেন সগিরা মোর্শেদকে চিনিয়ে দেয় সে ব্যাপারে বলেন। হাসান আলী চৌধুরীর কাছ থেকে বিস্তারিত টেলিফোনে জেনে মোহাম্মদপুরের বাসা থেকে বের হয়ে প্রথমে বাসে, পরে টেম্পুতে করে বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে মৌচাক পৌঁছান। আনাস পৌঁছানোর প্রায় ১৫/২০ মিনিট পর মারুফ রেজা মোটরসাইকেলে মৌচাক পৌঁছান। মোটরসাইকেলে করে তারা দুই জন ভিকারুননিসা নূন স্কুলের দিকে চলে যায়। তারা ভিকারুননিসা নূন স্কুলের গেটের একটু দূরে মোটরসাইকেলে বসে সগিরা মোর্শেদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
বিকেল পৌনে ৫টার দিকে সগিরা মোর্শেদ বড় মেয়েকে নিয়ে স্কুল থেকে আনার জন্য বাসা থেকে বের হন। চার টাকায় ছালাম মোল্লা নামে এক রিকশাচালকের রিকশা ভাড়া করে স্কুলের দিকে রওনা দেন। মালিবাগ মোড় পেট্রোল পাম্পের সামনে গিয়ে মৌচাকের গলির ভিতর দিয়ে সগিরা মোর্শেদের রিকশাটি সিদ্ধেশ্বরীর মাঝামাঝি অতিক্রমকালে আগে থেকে অপেক্ষারত আনাস মাহমুদ আঙ্গুল দিয়ে মারুফ রেজাকে ‘এটা সগিরা মোর্শেদ’ বলে চিনিয়ে দেয়। মারুফ রেজা তাৎক্ষণিকভাবে মোটরসাইকেলে রিকশা কিছুক্ষণ ফলো করে। পরবর্তীতে রিকশার সামনে গিয়ে মোটরসাইকেল দিয়ে ব্যারিকেড দিয়ে দাঁড় করায়। তারা দুজন মোটরসাইকেল থেকে নেমে পড়ে।
পরে মারুফ রেজা সগিরা মোর্শেদের হাতের ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। স্বর্ণ টানা হেঁচড়া করতে থাকেন। সগিরা মোর্শেদ সামান্য চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকে। মারুফ রেজা তাকে থ্রেট করে। সগিরা মোর্শেদ ওই সময় আনাস মাহমুদকে চিনে ফেলে। বলে, ‘তুমি তো রেজওয়ান, তোমাকে আমি চিনি। তুমি এখানে কেন।’ এই কথা বলার পরপরই মারুফ রেজা কোমরে থাকা রিভলভার বের করে এক রাউন্ড গুলি করে। প্রথম গুলিটি সগিরা মোর্শেদের ডান হাতের কনুইয়ের নিচে লাগে। আনাস মারুফ রেজাকে গুলি করতে নিবৃত্ত না করলে মারুফ আরেক রাউন্ড গুলি করে। দ্বিতীয় গুলি সগিরা মোর্শেদের বুক ভেদ করে সোজাসুজি পিঠ দিয়ে বের হয়ে রিকশার হুড ছিদ্র হয়ে যায়।
নয়াশতাব্দী/আরজে/একে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ