জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন বিএনপির সাত সংসদ সদস্য। গতকাল রোববার বেলা ১১টার দিকে জাতীয় সংসদ সচিবালয়ে গিয়ে সশরীরে পদত্যাগপত্র জমা দেন ৫ এমপি।
তারা হলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনের মো. আমিনুল ইসলাম, বগুড়া-৪ আসনের মো. মোশাররফ হোসেন, বগুড়া-৬ আসনের গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ, ঠাকুরগাঁও-৩ আসনের জাহিদুর রহমান এবং সংরক্ষিত নারী আসনের রুমিন ফারহানা। বিদেশে থাকায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য হারুন অর রশিদ এবং অসুস্থতার কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের সংসদ সদস্য আবদুস সাত্তার সশরীরে উপস্থিত হননি। তাদের পক্ষে স্পিকারের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা। তবে হারুন অর রশিদ ও আবদুস সাত্তার এমপি সশরীরে উপস্থিত না থাকায় তাদের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেননি স্পিকার। সংবিধানের ৬৭ (২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ সদস্যদের পদত্যাগ করতে সশরীরে উপস্থিত হওয়ার বিধান রয়েছে।
সংবিধানের ৬৭(২) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘কোনো সংসদ সদস্য স্পিকারের নিকট স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে স্বীয় পদত্যাগ করিতে পারিবেন এবং স্পিকার কিংবা স্পিকারের পদ শূন্য থাকিলে বা অন্য কোনো কারণে স্পিকার স্বীয় দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হইলে ডেপুটি স্পিকার যখন উক্ত পত্র প্রাপ্ত হন, তখন হইতে উক্ত সদস্যের আসন শূন্য হইবে।’ এদিকে, গত সন্ধ্যায় পদত্যাগকারী ৫ এমপি আসন শূন্য ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। এর আগে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে জাতীয় সংসদ ভবন থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন বিএনপির এমপিরা। তারা বলেন, সংসদে জনগণের পক্ষে কথা বলার কোনো সুযোগ নেই। এজন্য সরকার পতনের আন্দোলন জোরদার করতেই একাদশ জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছেন।
এর আগে শনিবার বিকেলে রাজধানীর গোলাপবাগে দলের ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ থেকে বিএনপির দলীয় সাত এমপির পদত্যাগ করবেন বলে ঘোষণা দেন। গণসমাবেশে বিএনপির এমপিরা ধারাবাহিকভাবে বক্তব্য দিয়ে পদত্যাগ করার ঘোষণা দেন। তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য মো. হারুন অর রশিদ অস্ট্রেলিয়ায় থাকায় তিনি গণসমাবেশে উপস্থিত ছিলেন না।
যা লেখা হয়েছে পদত্যাগপত্রে: পদত্যাগপত্রে বলা হয়েছে, ‘বর্তমানে বাংলাদেশে চরম স্বৈরশাসন চলছে। বর্তমান সরকারের গণতন্ত্র ও গণবিরোধী কার্যকলাপে গণতন্ত্রহীনতা, বিরোধী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ওপর দমনপীড়ন, গণগ্রেপ্তার, গুম, হত্যা এবং মত প্রকাশ ও বাকস্বাধীনতা হরণ, ভোটাধিকার ও মানবাধিকার হরণ সর্বোপরি মহান জাতীয় সংসদকে অকার্যকর করার প্রতিবাদে এই পদত্যাগ।
‘জনস্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণকারী এই সংসদের সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করে এই সংসদ বাতিলের গণদাবির সঙ্গে একমত পোষণ করছি এবং দলীয় সিদ্ধান্তের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে স্বেচ্ছায়, সুস্থ শরীরে, স্থির মস্তিষ্কে, অন্যের বিনা প্ররোচনায় গভীরভাবে চিন্তা ও বিবেচনার পর অদ্য ১০ ডিসেম্বর ২০২২ সংসদে যার যার আসন থেকে পদত্যাগ করলাম।’
পদত্যাগ দিয়েই আন্দোলনের শুরু— রুমিন ফারহানা: ‘এই পদত্যাগ আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করছে’ দাবি করে জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনের বিএনপির এমপি রুমিন ফারহানা বলেছেন, আগামী ২৪ ডিসেম্বর সব রাজনৈতিক দল নিয়ে আমরা যে যুগপৎ আন্দোলনের ডাক দিয়েছি, তার লক্ষ্য এই সরকারের পদত্যাগ। পদত্যাগের এক দফা আন্দোলন আমাদের।
ঢাকার বিভাগীয় জনসভা থেকে ১০টি দাবি তুলে ধরা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারা প্রথমটিতে সংসদ ভেঙে দেয়া এবং সংসদ থেকে পদত্যাগ করার কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের কাছে ক্ষমতা দেয়ার কথা। ওই জনসভায় সংসদ ভেঙে দেয়ার যে দাবি আমাদের দলের সেই দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে আমাদের দলের সাতজন সংসদ সদস্য সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছি। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে ফোনে কথা হয়েছে উল্লেখ করে বিএনপির এই সংসদ সদস্য বলেন, ব্যক্তিগতভাবে আমি ফোন করে জানিয়েছি, আমরা বিএনপির সংসদ সদস্যরা পদত্যাগ করেছি।
বিএনপি এমপিদের এই পদত্যাগে সংসদে কোনো সংকট তৈরি হবে কিনা প্রশ্নে রুমিন বলেন, সংকট তৈরি হবে কী হবে না, সেটা তো আপনারা দেখবেন। সত্যিকারের বিরল বলতে যদি কিছু বোঝা যায় সেটা হচ্ছে বিএনপি। সেটা দেশের মানুষ যেমন জানে সরকারও খুব ভালো করে জানে। সংকট যে তৈরি হবে সেটা বোঝা যায়, যখন সরকার প্রথমেই বলে, সংকট তৈরি হবে না।
বিএনপির সংসদে আসার সিদ্ধান্ত কি ভুল ছিল— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একদমই ভুল ছিল না। আমরা বলেছিলাম যে সীমিত সুযোগ আমরা পাব, সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার আমরা করব, তিন সাড়ে তিন বছরে আপনারা দেখেছেন। আমরা আমাদের সর্বোচ্চটা দিয়েছি। সুযোগ পাইনি, সময় পাইনি, মাইক অফ করে দেয়া হয়েছে। তার মধ্য থেকেও যতটুকু সম্ভব আমরা আমাদের কাজ চালিয়ে গেছি।
বিএনপির অপর এমপি জি এম সিরাজ বলেন, বিশাল জনসমাবেশে জনগণকে সাক্ষী রেখে আমরা পদত্যাগ করেছি। গতকাল ই-মেইলের মাধ্যমে স্পিকারের কাছে পদত্যাগপত্র দিয়েছি। আজ সশরীরে আসছি স্পিকারের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিতে।
এই সংসদের ৩৫০ সদস্যের মধ্যে সাতজনের কথা জনগণ শুনত দাবি করে তিনি বলেন, বাকি ৩৪৩ জনের কথা দেয়ালগুলো শুনত। আওয়ামী লীগ ও তাদের বি-টিম জাতীয় পার্টি সংসদে কথা বললে মানুষ টেলিভিশনের চ্যানেল অন্যটায় ঘুরিয়ে দিত।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গড়ে ভোটে অংশ নিয়েছিল। সেই নির্বাচনে বিএনপির ছয়জন বিজয়ী হন, পরে সংরক্ষিত নারী আসনের একটি পায় দলটি। নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ তুলে শুরুতে বিএনপি জানিয়েছিল, তারা সংসদে যাবেন না। পরে সিদ্ধান্ত বদলে শপথ নেন দলটির সংসদ সদস্যরা।
বিএনপির পাঁচজনের পদত্যাগপত্র গ্রহণ হয়েছে— স্পিকার: পদত্যাগপত্র জমা দেয়া পাঁচ এমপির পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। তিনি বলেন, তারা (বিএনপির এমপি) স্ব স্ব স্বাক্ষরযুক্ত আমার কাছে সাতজনের আবেদন জমা দিয়েছেন। পাঁচজন সশরীরে ছিলেন তাদেরটা গ্রহণ করা হয়েছে। সংবিধানের ৬৭ (২) অনুযায়ী ওই আসনগুলো শূন্য হয়ে গেছে। বাকি দুইজনের আবেদন যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেবো। বিএনপির সাত সংসদ সদস্যের মধ্যে আব্দুস সাত্তার অসুস্থ থাকায় এবং হারুনুর রশিদ বিদেশে থাকায় অনুপস্থিত রয়েছেন। স্পিকার জানান, এর মধ্যে আব্দুস সাত্তার অসুস্থ থাকায় সংসদ সচিবালয় তার স্বাক্ষর মিলিয়ে দেখবে ও কথা বলবে। সব ঠিক থাকলে তার আবেদনও গৃহীত হবে। তবে ই-মেইলের মাধ্যমে পদত্যাগপত্র দেয়ায় হারুন উর রশীদের আবেদন গ্রহণ হবে না, তাকে পরে এসে জমা দিতে হবে।
স্পিকার বলেন, আসন শূন্য হওয়ার গেজেট প্রকাশের পর তাদের কাছে পাঠানো হবে। সেই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনে পাঠানো হবে। আসন শূন্য হলে ৯০ দিনের মধ্যে উপনির্বাচন হবে জানিয়ে স্পিকার বলেন, আসন শূন্যের এখন গেজেট হবে। পরে অধিবেশন যখন বসবে সেখানেও জানানো হবে।
গেজেট হলে উপনির্বাচনের সিদ্ধান্ত— ইসি আলমগীর: বিএনপির সংসদ সদস্যদের পদত্যাগের কারণে শূন্য হওয়া আসনগুলোতে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আসনগুলো শূন্য ঘোষণা করে সংসদ সচিবালয়ের গেজেট পাওয়ার পরেই ইসি থেকে এসব আসনের উপনির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। নির্বাচন কমিশন থেকে এ তথ্য জানা গেছে। বিএনপির পদত্যাগে শূন্য হওয়া সংসদীয় আসনের উপনির্বাচন প্রশ্নে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, পদত্যাগের কারণে হোক আর যে কোনো কারণেই হোক জাতীয় সংসদের কোনো আসন শূন্য হলে সেখানে উপনির্বাচন হবে।
বিএনপির এমপিদের পদত্যাগে আসন শূন্য ঘোষণা হলে উপনির্বাচন প্রয়োজন পড়বে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ১৮০ দিনের আগে কোনো সংসদীয় আসন শূন্য হলে উপনির্বাচন করতে হবে। চলতি একাদশ সংসদের মেয়াদ এখনও এক বছরের বেশি রয়েছে। কাজেই এখন কোনো আসন শূন্য হলে নির্বাচন কমিশনকে আইনানুযায়ী উপনির্বাচন করতেই হবে।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, আমরা গণমাধ্যমে বিএনপির এমপিদের পদক্ষেপের কথা জেনেছি। এ বিষয়ে কোনো গেজেট নোটিফিকেশন আমরা পাইনি। গেজেট পেলে আমরা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবো। যেদিন পদত্যাগের গেজেট নোটিফিকেশন হবে তার ৯০ দিনের মধ্যে সেই সব আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তিনি বলেন, সংসদ সচিবালয়ের গেজেট নোটিফিকেশন হওয়ার পরেই আমাদের কাজ শুরু হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত পদত্যাগের নির্দেশ গেজেট নোটিফিকেশন হবে না, ততদিন পর্যন্ত ইসির কোনো করণীয় নেই।
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ