বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে রাজধানীর পথে পথে চেকপোস্ট বসিয়েছে পুলিশ। সেখানে তল্লাশি করা হচ্ছে সবাইকে। বিশেষ করে টার্মিনাল এলাকায় পুলিশের এ ধরনের কার্যক্রম বেশি দেখা গেছে। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবিরোধী অভিযানের তকমা লাগানো হলেও মূলত আগামী ১০ ডিসেম্বর বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় মহাসমাবেশ উপলক্ষে এ ধরনের কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছে সাধারণ মানুষ। একইসঙ্গে সন্দেহভাজনদের আটকও করা হচ্ছে। যদিও এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি পুলিশের ঊর্ধ্বতনরা। তবে তাদের দাবি ১৫ দিনের বিশেষ অভিযানের অংশ হিসেবে এই কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
সরেজমিনে রাজধানীর প্রবেশ পথ উত্তরার আবদুল্লাহপুর, কমলাপুর রেলস্টেশন, লঞ্চঘাট, গাবতলী, পোস্তগোলা ব্রিজ, বাবুবাজার ব্রিজ, সদরঘাট, পূর্বাচল ৩০০ ফিট, কাঁচপুর ব্রিজসহ বেশকিছু পয়েন্টে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নজরদারি দেখা যাচ্ছে। একইসঙ্গে ডিএমপির থানাগুলোতেও বাড়ানো হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা। তিনজনকে এক সঙ্গে দেখলেই থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। সন্তোষজনক ব্যাখ্যা না পেলে নেয়া হচ্ছে থানাতে। এরপর তাদের ব্যবহৃত মোবাইল চেক করে সন্দেহজন কিছু পেলেই আটক দেখানো হচ্ছে বলে পুলিশের একটি সূত্র দাবি করেছে। এ ধরনের অভিযানে মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে ২৫৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
কমলাপুর রেলস্টেশনের কয়েক যাত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ট্রেন থেকে নেমে বের হওয়ার প্রধান গেটে আসার পর তল্লাশি করা হচ্ছে। একইসঙ্গে ঢাকায় আসার উদ্দেশ্য সম্পর্কেও জানতে চাওয়া হচ্ছে। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে সাধারণ যাত্রীদের। একই চিত্র দেখা গেছে রাজধানীর বাস ও লঞ্চ টার্মিনালগুলোতেও। এ সময় অনেকেই সরকারের ওপর ক্ষোভ ঝাড়তে দেখা গেছে।
জানা গেছে, প্রতিটি জোনের সব থানাকে ১০-১২ জন করে অফিসার ও কনেস্টেবল নিয়ে আলাদা আলাদাভাবে কয়েকটি টিম করে পাড়া-মহল্লায় তল্লাশি ও অভিযানের নামে মোটরসাইকেলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের সহায়তায় বিএনপির নেতাকর্মীদের বাসায় বাসায় তল্লাশি চালানো হচ্ছে। তবে পুলিশের এ ধরনের তৎপরতার কারণে অনেক আগে থেকেই ঘর ছেড়েছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। তারা বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের বাসায় অবস্থান নিয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে চেকপোস্টে দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ওপরের নির্দেশে তারা রাজধানীর প্রবেশ পথগুলোতে চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি করছেন। তারা জানান, বিভিন্ন জেলা থেকে যেন জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কোনো মানুষ ঢাকায় প্রবেশ করতে না পারে সেই দিক খেয়াল রাখা হচ্ছে। এটা মূলত ১০ ডিসেম্বর কেউ যেন সমাবেশের নামে নাশকতা করতে না পারে সেজন্য নিরাপত্তা বাড়ানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে পুলিশ সদর দফতর থেকে।
সাব্বির নামের একজন বলেন, গাবতলী প্রবেশেই আমিন বাজারের সামনে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। সেখানে তল্লাশিসহ কী কারণে ঢাকায় প্রবেশ করা হচ্ছে সেগুলো জিজ্ঞাসা করা হয়। চেকপোস্টে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা জানান, ১০ ডিসেম্বর যেন কোনো ধরনের নাশকতা করতে গ্রাম থেকে কেউ আসতে না পারে সেজন্য বিভিন্ন জেলা থেকে আসা গাড়ির ভেতরে চেক করা হচ্ছে। যাতে কেউ সমাবেশের নামে নাশকতা করতে না পারে।
তবে পুলিশের একটি সূত্রমতে, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চালানো তকমা লাগানো হলেও মূলত বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের বাসায় তল্লাশি চালানো হয়েছে। এছাড়া শিবির ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা অবস্থান করে এমন মেসেও চালানো হয় অভিযান। এর আগে গত ২৯ নভেম্বর পুলিশ সদর দফতরের অপারেশন শাখার এক আদেশে দেশের সব পুলিশ ইউনিটের প্রধান ও সব জেলার পুলিশ সুপারদের এ বিশেষ অভিযান চালাতে বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ঢাকার আদালত থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় সৃষ্ট পরিস্থিতিকে বিবেচনায় এই অভিযান পরিচালনা করতে হবে।
এছাড়া মহান বিজয় দিবস, বড়দিন এবং থার্টিফার্স্ট নাইট উদ্যাপনের নিরাপত্তা নিশ্চিতও এই অভিযানের অংশ। ধারণা করা হচ্ছে আবাসিক হোটেল, মেস, হোস্টেল, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, কমিউনিটি সেন্টারে অপরাধীরা লুকিয়ে থাকতে পারে। এ কারণে এসব স্থানে ১ ডিসেম্বর থেকে ১৫ তারিখ বিশেষ অভিযান চালানো হবে। এছাড়া সন্দেহভাজন বিভিন্ন স্থানেও অভিযান চালানোর পাশাপাশি জঙ্গি, সন্ত্রাসী, মাদকসেবী ও চোরা কারবারি, অবৈধ অস্ত্রধারী, ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি গ্রেফতার, মাদক ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করারও তাগিদ দেয়া হয়েছে ওই নির্দেশনায়।
জানা গেছে, চলমান অভিযানে বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করলেও মূলত বিএনপির সমাবেশকে ঘিরে এই তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। এ বিষয়ে গত মাসের শুরুর দিকে একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদন জমা পড়ে পুলিশ সদর দফতরে। সেখানে বলা হয় ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় অরাজকতার সৃষ্টি করতে পারে বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সারাদেশে এই অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। যদিও বিএনপি সমাবেশের জন্য নয়া পল্টনে আবেদন করলেও পুলিশ ২৬ শর্তে তাদের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুমতি দেয়। কারণ বড় মাঠে পুলিশের পক্ষে নজরদারি করা সম্ভব। কিন্তু নয়া পল্টনের বিএনপি পার্টি অফিসের আশপাশের গলিসহ জনবহুল এলাকায় কোনো ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হলে পুলিশের পক্ষে তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না বলেও গোয়েন্দা প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়।
এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি নয়া পল্টনে সমাবেশের বিষয়ে অনড় অবস্থানে রয়েছে। এ কারণে ঢাকার বিভিন্ন মেস, আবাসিক হোটেলে অভিযানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। গত সপ্তাহের শেষের দিকে পুলিশের মাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভায়ও এ বিষয়টি ছিল আলোচনার কেন্দ্রে। ওই সভায় দেশের সব ইউনিট ও পুলিশ সুপাররা ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন। সেখানে অভিযান চালানোর বিষয়ে সবাই একমত হন। এরপর ২৯ নভেম্বর এ বিষয়ে লিখিত আকারে নির্দেশনা জারি করা হয়।
নয়া শতাব্দী/আরআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ