দলের ভেতর ও বাইরের নানামুখী চাপে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান জি এম কাদের। একদিকে আদালতের নিষেধাজ্ঞা; অন্যদিকে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদপন্থিদের বিরোধী তৎপরতা। বেশ কয়েকদিন ধরে অংশ নিতে পারছেন না পার্টির রাজনৈতিক কার্যক্রমেও।
কাদেরপন্থিরা বলছেন, দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ দেশে ফেরার পর সব দ্বন্দ্ব-বিভেদ মিট মীমাংসা হয়ে যাবে। সমঝোতা করে একসঙ্গে কাজ করবেন দেবর-ভাবি। সেই সঙ্গে আদালতের নিষেধাজ্ঞাও উঠে যাবে। রওশনপন্থিরাও অনেকটাই একই সুরে কথা বলছেন।
তারা বলছেন, জি এম কাদেরের সঙ্গে বৈঠক করবেন রওশন এরশাদ। জাতীয় পার্টির স্বার্থে জি এম কাদেরের সঙ্গে বসবেন তিনি। পার্টির চেয়ারম্যানের সঙ্গে নয়, এ বৈঠক হবে দেবর-ভাবির মধ্যকার। মাড্যাম দেশে ফেরার দু-একদিনের মধ্যে বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আগামী ২৯ তারিখের আগেই এই বৈঠক হবে। কারণ ওই দিন রংপুর সিটি করপোরেশন (রসিক) নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর মনোনয়ন জমা দেয়ার শেষ দিন।
দলীয় সূত্রমতে, দেবর-ভাবির দ্বন্দ্বের শুরু মূলত গত ৩১ আগস্ট থেকে। ওই দিন ভাবি রওশন এরশাদের পক্ষ থেকে ২৬ নভেম্বর জাতীয় পার্টির কাউন্সিল ডাকা ও প্রস্তুতি কমিটি গঠন করে। এতে চটে যান দেবর জি এম কাদের। এর জেরে বিরোধীদলীয় নেতার আসন থেকে সরাতে স্পিকারের কাছে চিঠি দেন কাদেরপন্থিরা।
পরবর্তীতে চিঠি দেয়া নিয়ে মিডিয়ায় কথা বলেন, সংসদের বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গা। পরবর্তীতে তাকে বহিষ্কার করেন জি এম কাদের। এ ছাড়াও জাপার গঠনতন্ত্র ২০ ধারায় জিয়াউল হক মৃধাসহ অনেককে বহিষ্কার করেন জি এম কাদের। এতে জি এম কাদেরের ওপর ক্ষুব্ধ হন রওশন এরশাদ। পরবর্তীতে জি এম কাদেরকে সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতার আসন থেকে সরাতে স্পিকারের কাছে চিঠি দেন রওশনপন্থিরা। তাতেও দমে যায়নি কাদেরপন্থিরা।
উল্টো বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ থেকে রাঙ্গাকে সরাতে চিঠি দেন। তবে শেষ পর্যন্ত কোনো চিঠিই কার্যকর হয়নি। বরং ধীরে ধীরে দেবর-ভাবির বিভেদ-দ্বন্দ্ব গলতে শুরু করে। যার জেরে রওশনপন্থিরা কাউন্সিল স্থগিত করে। এরপর থেকে রাজনৈতিক মহলে আভাস দেবর-ভাবির দ্বন্দ্ব এবার মিটছে। দেশে ফেরার পর আলোচনার টেবিলে বসালেই রওশন ও জি এম কাদেরের মধ্যে সব দ্বন্দ্ব মিটে যাবে বলে মনে করছেন কাদেরপন্থিরা।
রওশনপন্থিরা বলেন, আমরা ম্যাডামের কথায় অনেকটা চুপ হয়েছি। রওশন এরশাদই থাকবেন বিরোধী দলের নেতা। এসব শর্তে আমরা কাউন্সিল স্থগিত করেছি। আর ম্যাডাম আমাদের বলেছেন, আপাতত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে। তিনি দেশে আসার আগ পর্যন্ত বিবাদে না জড়াতে। আগামীকাল (আজ রোববার) প্রেস ব্রিফিংয়ে জাপার চলমান দ্বন্দ্ব নিয়ে তিনি সবকিছু পরিষ্কার করবেন।
এদিকে, দীর্ঘ সাড়ে ৫ মাস ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে আজ রোববার দুপুর সাড়ে ১২টায় দেশে ফিরছেন সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা এবং জাতীয় পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা রওশন এরশাদ। এ সময় তার সঙ্গে দেশে ফিরবেন জাতীয় পার্টি ও বিরোধীদলীয় নেতার মুখপাত্র কাজী মামুনূর রশীদ, পল্লীবন্ধুপুত্র রাহগির আল মাহি সাদ এরশাদ ও তার স্ত্রী মাহিমা সাদ।
দলীয় সূত্রমতে, রওশন এরশাদের দেশে ফেরাকে কেন্দ্র করে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় ও তৃণমূল পর্যায়ে নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত। নেত্রীকে উষ্ণ সংবর্ধনা দিতে নেয়া হয়েছে ব্যাপক প্রস্তুতি। বিশেষ করে রওশনপন্থি নেতারা তাদের প্রিয় নেত্রীকে বরণ করে নিতে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকায় ব্যাপক শোডাউন প্রস্তুতি নিয়েছে। বিমানবন্দর এলাকায় তাকে সংবর্ধনা জানাতে ঢাকা মহানগরসহ সারা দেশ প্রায় ৪ থেকে ৫ হাজার নেতাকর্মী উপস্থিত থাকবে। বিমানবন্দর থেকে গুলশানে হোটেল ওয়েস্টিন পর্যন্ত সড়ক দুপাশে লাগানো হবে রংবেরঙের ব্যানার ফেস্টুন। এ ছাড়া রাজধানীজুড়ে দলীয় নেতাকর্মীদের নামসহ লাগানো হয়েছে নানা রঙের পোস্টার-ব্যানার। গাড়ি ও মোটরসাইকেল বহর নিয়ে বিমানবন্দর থেকে সরাসরি গুলশানের হোটেল ওয়েস্টিন উঠবেন তিনি।
রওশন এরশাদকে সংবর্ধনা জানিয়ে রাজধানীতে ব্যানার-পোস্টার সাঁটানো হয়েছে। এমনকি সংসদ সদস্য হিসেবে বিরোধীদলীয় নেত্রীকে রিসিভ করতে এয়ারেপোর্টে যাবেন এমন আভাস মিলছে। তবে ভিন্ন কথা বলছে কাদেরপন্থিরা।
এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির দফতর সম্পাদক এম এ রাজ্জাক নয়া শতাব্দীকে বলেন, জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের বিমানবন্দরে রওশন এরশাদকে রিসিভ করতে নিষেধ করা হয়েছে। তবে জি এম কাদের ও রওশন এরশাদের মধ্যকার বৈঠক হবে কিনা এ বিষয়ে তিনি কিছু্ জানেন না বলেও জানান। তবে রওশন এরশাদ পন্থিরা বলছেন, জি এম কাদের আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকার কারণেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা।
জানা যায়, বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে বিরোধীদলীয় নেতাকে অভ্যর্থনা জানাবেন জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গা, বিরোধীদলীয় নেতার রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ, পার্টির সিনিয়র নেতা অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন খান, এস এম এম আলম, সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য ফখরুজ্জামান জাহাঙ্গীর, সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট জিয়াউল হক মৃধা, এম এ গোফরান, নুরুল ইসলাম মিলন, পার্টির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ইকবাল হোসেন রাজু ও জাতীয় ছাত্রসমাজের সাবেক সভাপতি মনিরুজ্জামান টিটুসহ অন্যান্য নেতারা।
বিমানবন্দরে নির্ধারিত আনুষ্ঠানিকতা শেষে ভিআইপি লাউঞ্জের গেটে দলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখবেন রওশন এরশাদ। বিশ্ব পরিস্থিতি, বর্তমান রাজনীতি, পার্টির চলমান অস্থিরতা ও তৃণমূল নেতাকর্মীর কাছে পৌঁছানো বিভ্রান্ত তথ্য, নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র প্রসঙ্গে নিজের ও পার্টির অবস্থান পরিষ্কার করবেন। এবং আসন্ন রংপুর সিটি করপোরেশন (রাসিক) নির্বাচনে জাতীয় পার্টির লাঙ্গলের প্রার্থী ঘোষণা করবেন রওশন এরশাদ।
জানতে চাইলে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ বলেন, মসিউর রহমান রাঙ্গা নয়া শতাব্দীকে বলেন, জাতীয় পার্টির মধ্যে চলমান দ্বন্দ্ব দ্রুতই সমাধান হবে। এখন যেটা দেবর-ভাবির সম্পর্ক, এর বেশি অবনতি ঘটবে না। এখন যা চলছে, এটাও মিটে যাবে। তিনি আরও বলেন, রওশন এরশাদ ও জি এম কাদের মধ্যকার আলোচনার বিষয়ে এখনও কোনো কিছু ফাইনালি হয়নি। আগামীকাল ম্যাডাম প্রেস ব্রিফিং করবেন ওখানে সব কিছু পরিষ্কার করা হবে।
এ বিষয়ে জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য ও অতিরিক্ত মহাসচিব এ টি ইউ তাজ রহমান বলেন, নানাভাবে জি এম কাদেরসহ আমরা রওশন এরশাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। তবে তিনি অসুস্থ। টেলিফোনে সব কথা বলা যায় না। দেশে এসে সব কথা বলবেন। আশা করি, একসঙ্গে বসলে মনোমালিন্য ঘুচে যাবে। তিনি আরও বলেন, রওশন-কাদের কেউই বিভক্ত জাতীয় পার্টি চায় না। দলের কার্যক্রমের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা আছে, তাও উঠে যাবে। কেননা রাজনীতিকে কাঠগড়ায় বন্দি করে রাখা যাবে না। রওশন এরশাদের সঙ্গে জি এম কাদের আলাদাভাবে বসবেন। আশা করি, তখন সব ঝামেলা মিটে যাবে।
জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য ফখরুল ইমাম এমপি বলেন, দলে কঠিন সিচুয়েশন চলছে। নতুন ফর্মুলা বের করার চেষ্টা চলছে। রওশন ম্যাডাম দেশে আসার পর হয়তো ঝামেলা মিটে যাবে। সবাই একত্রে কাজ করার চেষ্টা চলছে।
অন্যদিকে, সম্প্রতি বিভিন্ন ইস্যুতে জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের হঠাৎ করেই আটকে গেছেন আইনি জটিলতায়। দল থেকে বহিষ্কৃত সাবেক সংসদ সদস্য জিয়াউল হক মৃধার মামলায় গত ৩১ অক্টোবর জি এম কাদেরের ওপর দলীয় সিদ্ধান্ত নেয়ার অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দেন ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ মাসুদুল হক। শুধু সিদ্ধান্ত নেয়াই নয়, চেয়ারম্যান হিসেবে দলীয় কার্যক্রম থেকেই বিরত থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাকে। নিষেধাজ্ঞার কারণে গত ৩১ অক্টোবর থেকে কার্যত দলীয় কার্যক্রম থেকে বিরত রয়েছেন কাদের। এ কারণেই হয়তো তিনি বিমানবন্দরে সংবর্ধনা জানাতে যাবেন না।
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ