পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টিপাতের কারণে দেশের উত্তরাঞ্চলের নদ-নদীর পানি বাড়ার আভাস রয়েছে। নীলফামারীর ডালিয়া ব্যারাজ পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি শুক্রবার সন্ধ্যায় বিপদসীমার ৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। একই কারণে সিলেটের সুরমা, কুশিয়ারা ও লোভা নদীর পানিও বেড়েছে। এক্ষেত্রে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার শঙ্কা দেখছে।
পাউবো জানিয়েছে, বর্তমানে ব্রহ্মপুত্র নদের পানির সমতল স্থিতিশীল আছে। অপরদিকে, যমুনা নদীর পানির সমতল হ্রাস পাচ্ছে। গতকাল শুক্রবার নাগাদ ব্রহ্মপুত্র নদের পানির সমতল স্থিতিশীল থাকতে পারে।
অন্যদিকে পদ্মা নদীর পানির সমতল বাড়ছে। পদ্মার পানি সুরেশ্বরে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে এবং পানির সমতল স্থিতিশীল আছে। এ অবস্থা আজ শনিবার পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আপারমেঘনা অববাহিকার কুশিয়ারাবর্তী প্রধান নদীগুলোর পানির সমতল বাড়ছে, যা শুক্রবার পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ও ভারত আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, শনিবার (আজ) নাগাদ দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন ভারতের হিমালয় পাদদেশীয় পশ্চিমবঙ্গ, সিকিম, দার্জিলিং, আসাম ও মেঘালয় প্রদেশের অনেক স্থানে মাঝারি থেকে ভারি বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস আছে। এর ফলে এ সময়ে দেশের উত্তরাঞ্চলের ও আপারমেঘনা অববাহিকার নদীগুলোর পানি সমতল দ্রুত বাড়তে পারে ও কতিপয় স্থানে স্বল্পমেয়াদি আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।
চলতি বছর এখনো মধ্যমেয়াদি বা দীর্ঘমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতির কবলে পড়েনি দেশবাসী। তবে উত্তরাঞ্চলের কিছু কিছু স্থানে স্বল্পমেয়াদি বন্যা হয়ে গেছে। এছাড়া কুড়িগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, জামালপুরের বিভিন্ন স্থানে নদীভাঙনের কবলেও পড়েছে যমুনা-ব্রহ্মপুত্র-তিস্তাপাড়ের মানুষ।
পাউবো জানিয়েছে, তাদের পর্যবেক্ষণাধীন বিভিন্ন নদ-নদীর ১০৯টি স্টেশনের মধ্যে বৃহস্পতিবার (১২ আগস্ট) ৫৮টিতে পানির সমতল বেড়েছে। কমেছে ৪৮টি স্টেশনের পানির সমতল। দুটি স্টেশনের পানির সমতল অপরিবর্তিত আছে। একটির তথ্য এখনো সংগ্রহ শুরু হয়নি। একটি স্টেশনের পানি বিপদসীমার ওপর দিয়েছে প্রবাহিত হচ্ছে।
তিস্তার পানি বিপদসীমার ৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত
নীলফামারী প্রতিনিধি জানান, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর ভারি বর্ষণে নীলফামারীর ডালিয়া ব্যারাজ পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার ৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টায় ৯ সেন্টিমিটার (বিপদসীমা ৫২.৬০ মিটার) ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও সকাল ৬টায় বিপদসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে রেখেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। নদী অববাহিকার নিম্নাঞ্চলগুলো প্লাবিত হয়েছে।নীলফামারীর ডালিয়া পানি উন্নয়ন রোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে তিস্তা নদীর পানি ডালিয়া খালিশাচাপানী পয়েন্টে বিপদসীমার ১৫ সেন্টিমিটার (৫২.৭৫) ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। বিকেলে তা কমে ৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
বন্যার পানি বৃদ্ধির ফলে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার কিছামত ছাতনাই, ঝাড় শিঙ্গেশ্বর, চর খড়িবাড়ি, পূর্ব খড়িবাড়ি, পশ্চিম খড়িবাড়ি, তিস্তা বাজার, তেলির বাজার, বাইশ পুকুর, ঝুনাগাছচাঁপানীর ছাতুনামা কেল্লাপাড়া, ভেন্ডাবাড়ি ও জলঢাকা উপজেলার গোলমুন্ডা, ডাউয়াবাড়ি, শৌলমারীতে পানি প্রবেশ করে। নিরাপদে আশ্রয় নিয়েছে ওই এলাকার বাসিন্দারা। প্রায় ১০ হাজার পরিবার বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে বলে জানান স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ খান জানান, উজানের ঢলে ডিমলার বিভিন্ন এলাকায় পানি প্রবেশ করে। এবার ভয়ংকর বন্যা হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ঝুনাগাছ চাপানি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমিনুর রহমান বলেন, রাতে বন্যার পানি প্রবেশ করায় ছাতুনামা কেল্লাবাড়ি ও ভেন্ডাবাড়ি এলাকার ৫ শতাধিক পরিবার বন্যাকবলিত হয়ে পড়েন।
খগাখড়িবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম লিথন জানান, তিস্তার বন্যায় মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছে। কিসামত ছাতনাই গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে হাঁটু থেকে কোমরপানিতে পরিণত হয়েছে।
ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আসফাউদৌলা জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে রাখা হয়েছে। সকাল ৬টায় ডালিয়া ব্যারাজ পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও এখন বিপদসীমার ৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে, রাতে বাড়ার সম্ভাবনা নেই।
ডিমলা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা জয়শ্রী রানী রায় জানান, জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে বন্যাকবলিত পরিবারগুলোকে নিরাপদে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। বিছু কিছু এলাকায় মানুষকে নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে, আমরা সতর্ক অবস্থানে আছি।
পানি বাড়ছে সুরমা-কুশিয়ারা-লোভা নদীতে
সিলেট ব্যুরো জানায়, সিলেটে টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সিলেটের সুরমা, কুশিয়ারা ও লোভা নদীতে। শুক্রবার বিকাল ৩টা পর্যন্ত সুরমা নদীর পানি বেড়ে সিলেট পয়েন্টে ৯.৭৮ সেন্টিমিটার দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আর কুশিয়ারা নদীর পানি অমলশিদ পয়েন্ট দিয়ে এক দিনেই দশমিক ১৩ সেন্টিমিটার বেড়ে তা ১৩.২৭ সেন্টিমিটার দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অপরদিকে লোভা নদীর পানি দশমিক ১৩ সেন্টিমিটার বেড়ে ১৩.৫২ সেন্টিমিটার দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সুরমা নদীর পানি সিলেট পয়েন্টে ৯.৬৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। একইভাবে কুশিয়ারা নদীর পানি অমলশিদ পয়েন্টে ১৩.১৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এমনকি লোভাছড়া নদীর পানি ১৩.৩৭ সেন্টিমিটার দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। তবে নদ-নদীর পানি বাড়লেও এখনো তা বিপদসীমার কাছাকাছি প্রবাহিত হচ্ছে। কোনো নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেনি।
এ ক্ষেত্রে টানা বৃষ্টি আর উজানের ঢল অব্যাহত থাকলে এসব নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মুহাম্মদ শহীদুজ্জামান সরকার।
নয়া শতাব্দী/এম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ