ঢাকা, বুধবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৪, ১৪ কার্তিক ১৪৩১, ২৬ রবিউস সানি ১৪৪৬

বারবার ধাক্কা, দুর্ঘটনা না কি ষড়যন্ত্র?

প্রকাশনার সময়: ১৪ আগস্ট ২০২১, ০৪:২৫ | আপডেট: ১৪ আগস্ট ২০২১, ০৬:৩৩

পদ্মা সেতুর একটি পিলার থেকে আরেকটির দূরত্ব ১৫০ মিটার। অন্যদিকে যমুনা সেতুর দুই পিলারের মাঝে দূরত্ব ১০০ মিটার। কুমিল্লার দাউদকান্দিতে গোমতী নদীর ওপর নির্মিত দ্বিতীয় সেতুর পিলারের দূরত্ব ৮৭.৫ মিটার। কাঁচপুর সেতুর পিলারের দৈর্ঘ্য মাত্র ৫৬ মিটার। অথচ এসব সেতুর নিচ দিয়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অসংখ্য লঞ্চ-জাহাজ চলাচল করে। ঘটেনি কোনো দুর্ঘটনা। ফলে পদ্মা সেতুর দুই পিলারের মাঝে সবচেয়ে বেশি দূরত্ব থাকায় স্বাভাবিকভাবে সেতুতে কোনো ধাক্কা লাগার কথা নয়। সবশেষ চার দিনের ব্যবধানে শুক্রবার মুন্সীগঞ্জের লৌহজং এলাকায় পদ্মা সেতুর ১০নং পিলারের সঙ্গে ফের ‘কাকলি’ ফেরির ধাক্কা লেগেছে। সকাল ৮টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে পদ্মা সেতুর তিন পিলারে চার দফা ফেরির ধাক্কা দেয়ার ঘটনা ঘটল।

নৌপরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যমুনা গোমতী সেতুর পিলারে ধাক্কা না লাগলেও বারবার কেন পদ্মা সেতু প্রকল্পের পিলারে ধাক্কা লাগছে। যদিও চার হাজার টনের বড় বড় জাহাজ ধাক্কা মারলেও সেতুর কিছু হবে না। এক মাসের মধ্যে চারবার ফেরির ধাক্কার ঘটনা রহস্যজনক। পদ্মা সেতুর পিলারে বারবার ফেরির ধাক্কার ঘটনা উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন তারা। জানা গেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর নির্মিত দ্বিতীয় কাঁচপুর সেতু। এই সেতুতে এক পিলার থেকে অন্য পিলারের দৈর্ঘ্য মাত্র ৫৬ মিটার। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কুমিল্লার দাউদকান্দিতে গোমতী নদীর ওপর নির্মিত দ্বিতীয় সেতু। মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় মেঘনা নদীর ওপর দ্বিতীয় সেতুর উদ্বোধন করা হয়। এই সেতুতে একটি পিলার থেকে অন্য পিলারের দৈর্ঘ্য মাত্র ৮৭ দশমিক ৫ মিটার। এসব সেতুর নিচ দিয়ে পাথরবাহী ও সিমেন্টবাহী জাহাজ চলাচল করে। সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল ক্লিংকারবাহী জাহাজও চলে সেতুর নিচ দিয়ে। অথচ নির্মাণের পর থেকে কখনো সেতুর পিলারে কোনো জাহাজ বা লঞ্চ ধাক্কা লাগেনি।

জানতে চাইলে কাকলি ফেরির চালক মো. বাদল হোসেন নয়া শতাব্দীকে বলেন, পদ্মায় তীব্র স্রোত, বাতাস ও বৃষ্টির কারণে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সেতুর ১০ নম্বর পিলারে ধাক্কা লাগে। পদ্মা সেতুর ১১-১২ নম্বর পিলারের মধ্য দিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তীব্র স্রোতের কারণে তৈরি ঘূর্ণির কারণেই ধাক্কা লেগেছে। এতে ফেরিটির র‌্যাম্পের সামান্য ক্ষতি হয়। পানির স্তর উপরে থাকায় ফেরিতে পানিও ওঠেনি। পরে ফেরিটি নিরাপদে শিমুলিয়া ঘাটে নিয়ে এসেছি।

তিনি আরো বলেন, ‘কাকলি’ একটি মেকানিক্যাল ফেরি। তাই বর্তমানে পদ্মার তীব্র ¯্রােতের বিপরীতে চলাচলে অনুপযুক্ত। নিয়ন্ত্রণ রাখাও বেশ কঠিন। তাই ফেরিটি এই রুট থেকে সরিয়ে অন্য রুটে চালানোর জন্য দু’দিন আগেই চিঠি দিয়ে সতর্ক করেছিলাম। কিন্তু শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌরুট থেকে ফেরিটি সরানো হয়নি।

একই রুটের ‘করিম’ ফেরির চালক গোলাম মাওলা নয়া শতাব্দীকে বলেন, স্রোতে, বাতাস ও স্টিয়ারিং এই তিনের সমম্বয়ে চলে ফেরি। কোনো একটি বিপরীত দিকে গেলেই দুর্ঘটনার কবলে পড়বে নৌযান। এছাড়া চালানোর দক্ষতার ওপর নির্ভর করে দুর্ঘটনা। তিনি বলেন, স্রোতের অনুকূলে কম গতিতে চালাতে গিয়ে অনেকেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। এক্ষেত্রে চালকের অসতর্কতা থাকে।

জানা গেছে, গত ২০ জুলাই পদ্মা সেতুর ১৬ নম্বর পিলারে ধাক্কা খেয়ে রো রো ফেরি ‘শাহ মখদুম’-এর তলা ফুটো হয়ে যায়। এর আগে ২ ও ১৬ জুলাই একই পিলারে ধাক্কা লাগে ফেরির। ২৩ জুলাই সেতুর ১৭ নম্বর পিলারে ধাক্কা খায় ‘শাহজালাল’ নামে আরেকটি ফেরি।

এতে ফেরির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়, ‘হাল-প্লেট’ ভেঙে দেবে যায়। ফেরিতে থাকা গাড়িগুলোও একটির সঙ্গে আরেকটির ধাক্কায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গত ৯ আগস্ট সেতুর ১০ নম্বর পিলারে ‘বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর’ নামের ফেরি ধাক্কা খায়। এতে আহত হন পাঁচজন।

পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম জানান, সেতুতে বারবার ফেরির ধাক্কা লাগার ঘটনাটি রহস্যজনক লাগছে। কারণ সেতুর একটা পিলার থেকে অন্য পিলারের দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার বা ৪৯২ ফুট। আর যমুনা সেতুর একটা পিলার থেকে অন্য পিলারের দৈর্ঘ্য ১০০ ফুট। তারপরও যমুনা সেতুতে কোনো নৌযানের ধাক্কা লাগে না। গোমতী সেতুর নিচ দিয়ে বিদেশি জাহাজ চলাচল করে তারপরও ধাক্কা লাগে না। তাহলে কেন পদ্মা সেতুর পিলারে ফেরির বারবার ধাক্কা লাগছে। ফেরি অনেক ছোট তাই স্বাভাবিকভাবে সেতুর পিলারে ফেরির ধাক্কা লাগার কথা নয়। এ জন্য অদক্ষ চালক অথবা ফেরির ফিটনেস নেই বলে মনে করেন তিনি।

জানতে চাইলে নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে নয়া শতাব্দীকে বলেন, প্রথম ফেরির ধাক্কার তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হলে সবশেষ ১৩ আগস্টে ফেরির ধাক্কার ঘটনা ঘটত না। বারবার পদ্মা সেতুর পিলারে ফেরির আঘাত অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত। এ জন্য শুধু ফেরির মাস্টার ও ড্রাইভার দায়ী তা বলা যাবে না। নিশ্চয়ই এসব নৌযানের অপারেশনাল ফল্ট আছে। তবে সব দায় তাদের নয়।

শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌপথসহ সংশ্লিষ্ট এলাকা দিয়ে চলাচল নৌযানের ওপর বিআইডব্লিউটিএর নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের কঠোর তদারকি প্রয়োজন।

তিনি বলেন, ফেরিসহ সব ধরনের মাস্টার ও ড্রাইভারদের বিশেষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তোলা দরকার। এ দায়িত্ব নৌ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা নৌপরিবহন অধিদফতরের। কিন্তু তারাও যথাযথ দায়িত্ব পালন করে বলে দৃশ্যমান হয় না।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) একাধিক কর্মকর্তা বলেন, চালক ও সুকানির অসতর্কতা ও অদক্ষতার কারণে এমন ঘটনা ঘটছে। তা ছাড়া পদ্মা নদীতে তীব্র স্রোতের টানে অনেক সময় ফেরি নিয়ন্ত্রণে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই রুটে অনেক পুরোনো ফেরিও চলে, যেগুলোর যে কোনো যন্ত্রাংশ যে কোনো সময় বিকল হয়ে ফেরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।

সংশ্নিষ্টরা বলেছেন, পদ্মার তীব্র স্রোতের কাছে অসহায় কয়েক দশকের পুরোনো ফেরির দুর্বল ইঞ্জিনগুলো। সেতুর পিয়ার (পিলার) নির্মাণে নদীতে পানিপ্রবাহের পথ সংকুচিত হয়ে স্রোতের গতি আরও বেড়েছে। পিলারের আশপাশে স্রোতে ও ঘূর্ণন থাকায় ফেরিগুলো বাতাস ও স্রোতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। স্রোতের টানে পিলারের দিকে গিয়ে ধাক্কা খাচ্ছে। এক্ষেত্রে দক্ষতার অভাব আছে চালকদের। অথচ ফেরির চেয়ে অনেক বেশি ওজনের তেল ও পণ্যবাহী জাহাজ প্রয়োজনীয় ক্ষমতার ইঞ্জিন দিয়ে নির্বিঘ্নে দুই পিয়ারের মাঝের ১৫০ মিটারের মধ্য দিয়ে চলাচল করছে।

তারা বলছেন, নদীতে চলতি বর্ষায় স্রোত সেকেন্ডে দুই থেকে তিন মিটার। ঘণ্টায় গতি সাত কিলোমিটারের বেশি। বিআইডব্লিউটিসির যেসব ফেরি চলে সেগুলোর সর্বোচ্চ গতি ১০ দশমিক ২ কিলোমিটার। স্রোত ও নৌযানের গতি মিলিয়ে ঘণ্টায় ১৭ কিলোমিটার। কিন্তু ফেরির ৪৪০ থেকে ৫৬০ অশ্ব ক্ষমতার ইঞ্জিনগুলো এত গতির নৌযানকে নিয়ন্ত্রণের উপযোগী নয়। স্রোতের গতি ফেরির গতির চেয়ে কখনো কখনো বেশি হয়। ফলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পিলারে আছড়ে পড়ে। আরেকটি কারণ হলো ফেরিগুলো সক্ষমতার চেয়ে বেশি ভারের গাড়ি পারাপার করে। ফলে জোয়ারের প্রচণ্ড স্রোতের কারণে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আরো খারাপ।

জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিসির শিমুলিয়া ঘাটের সহকারী ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) সাফায়েত আহমেদ বলেন, নানা কারণেই ফেরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। অনেক সময় ফেরির ইঞ্জিন বা অন্য কোনো যন্ত্র হঠাৎ বিকল হয়ে পড়তে পারে। ঘটনার তদন্ত চলছে। তদন্তের পর সবকিছু জানা যাবে।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, হালকা আঘাত লাগলেও আমরা এটাকে হালকাভাবে দেখছি না। চালকদের দায়িত্বে উদাসীনতার কারণগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এদিকে, ভবিষ্যতে এ ধরণের দুঘর্টনা এড়াতে ঘাট স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত যাচ্ছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি ঘাট স্থানান্তর না হওয়া পর্যন্ত বাংলাবাজার-শিমুলিয়া রুটে রো রো ফেরি না চালানোরও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিসি চেয়ারম্যান সৈয়দ মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ফেরি চলাচলের পথে পদ্মা সেতু এলাকা এড়ানোর জন্য বাংলাবাজার ঘাট স্থানান্তরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সরকার। এই ঘাটটি শরীয়তপুরের জাজিরায় মাঝিরকান্দি ঘাটে নেওয়া হবে। এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে সরানো হবে।

নয়া শতাব্দী/এম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ