‘সরকার পতন ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন’— এক দফা দাবিতে সরকারবিরোধী ডান-বাম ঘরানার দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করছে মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। প্রথম ধাপে বিএনপির সঙ্গে সংলাপে অংশ নেয় ২৩টি সমমনা দল। অনানুষ্ঠানিকভাবে গতকাল আরও ১৩টি দলের সঙ্গে সংলাপ করে দলটি।
আলোচনায় উঠে আসে জোট আগে নয়, সরকার পতনে যুগপৎ আন্দোলন। সব দলই যুগপৎ আন্দোলনে বিএনপির সঙ্গে ‘রাজি’ হয়। এখন চলছে দ্বিতীয় ধাপের সংলাপ। এরই মধ্যে ১৩টি দলের সঙ্গে সংলাপ করেছে।
গতকাল গণতন্ত্রের মঞ্চের সাত দলের সংলাপ শেষ করে বিএনপি। এবারের ধাপে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলসহ (বাসদ) বাম গণতান্ত্রিক জোটের শরিক ও ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সংলাপ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টি (জাপা)সহ আরও দুইটি দলের সঙ্গে বিএনপির সংলাপ হতে পারে বলে গুঞ্জন রয়েছে।
চলতি মাসেই দ্বিতীয় ধাপের সংলাপ শেষ করতে চায় দলটি। যুগপৎ আন্দোলনে যারা রাজপথে থাকবে ক্ষমতায় গেলে তাদের নিয়েই গঠন করা হবে ‘জাতীয় সরকার’— এমন প্রতিশ্রুতিও দেয়া হচ্ছে বিএনপির পক্ষ থেকে। সব মিলিয়ে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ‘কেয়ারটেকার সরকার বা নির্দলীয় সরকারের অধীনে’ দাবি আদায়ে রাজপথে যুগপৎ আন্দোলনে বিএনপির সঙ্গে প্রস্তুত অন্তত ৩০টি দল। বিএনপির সূত্রমতে জানা গেছে এমন তথ্য।
জানা যায়, দ্বিতীয় দফা সংলাপ শেষ করে বিএনপি ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রীয় কাঠামো বা আন্দোলন নিয়ে একটি রূপরেখা ঘোষণা করতে যাচ্ছে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির সমাবেশে এই রূপরেখা ঘোষণা করা হতে পারে আভাস পাওয়া গেছে। রূপরেখায় আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে ও পরে— এই দুই ধাপে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে।
দলের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে চূড়ান্ত অনুমোদনের পর দেশবাসীর সামনে এ রূপরেখা উপস্থাপন করবে বিএনপি। এরপর রূপরেখা অনুযায়ী আগামী বছরের প্রথমে শুরু হবে আন্দোলন। যা নির্বাচন পর্যন্ত পুরো এক বছর টেনে নেবে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো।
প্রথম দফায় ৩০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপের লক্ষ্য নির্ধারণ করে বিএনপি। ওই দফায় ২৩টি রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ে গিয়ে সংলাপ করে বিএনপি। গত ২৪ মে মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্যের সঙ্গে বৈঠকের মধ্য দিয়ে প্রথম দফার সংলাপ শুরু হয়। যা শেষ হয় গণঅধিকার পরিষদের সঙ্গে বৈঠকের মাধ্যমে ৩ আগস্ট।
এরপর প্রথম দফার সংলাপ থেকে উঠে আসা পরিকল্পিত যুগপৎ আন্দোলনের দাবিগুলো চূড়ান্ত করতে গত ২ অক্টোবর দ্বিতীয় দফা সংলাপ শুরু করে বিএনপি। যা এখনও চলছে। প্রথম দফা সংলাপে একমত হওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে উত্থাপিত বিভিন্ন দাবির বিষয়ে সমঝোতা এবং আন্দোলনের দাবিগুলো সুনির্দিষ্ট করে সরকার পতন আন্দোলনের দিনক্ষণ ঠিক করে নেয়া হচ্ছে এই দফার সংলাপ থেকে।
এই সংলাপের শেষে একটি লিয়াজোঁ কমিটি গঠন করা হতে পারে। যারা দ্বিতীয় দফা সংলাপে গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ সব দলের সঙ্গে সমন্বয় করে কিছুটা কাটছাঁট করবেন। কাটছাঁটের পর যে রূপরেখা দাঁড়াবে তা নিয়ে পরবর্তীতে দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে তৃতীয় দফা সংলাপের পরিকল্পনা রয়েছে বিএনপির। তবে তার প্রয়োজন নাও পড়তে পারে বলে মনে করছেন দলটির একাধিক নেতা।
দ্বিতীয় দফা সংলাপের বিষয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, প্রথম দফা সংলাপে আমরা নীতিগতভাবে একমত হয়েছিলাম যে, একটা যুগপৎ আন্দোলনে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলব। দ্বিতীয় দফা সংলাপে আমরা কোন কোন দাবিতে বা কোন কোন ইস্যুতে আন্দোলনটা করব, সেই বিষয়ে আলোচনা করে ঐকমত্যে এসেছি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে সামনে সরকারবিরোধীদের ‘এক ছাতায়’ বা ‘একমঞ্চে’র নিয়ে আনতে চাইছে বিএনপি। এরপর রাজপথে যুগপৎ আন্দোলন। ওই আন্দোলনে ডান, বাম ও মধ্যপন্থি ৩০ থেকে ৩৫টি দলকে রাজপথে এক কাতারে আনতে চাইছে বিএনপি। এজন্য দীর্ঘদিন ধরেই দৌড়ঝাঁপ করছেন বিএনপির দায়িত্বশীল সিনিয়র নেতারা।
প্রথম দফায় ২৩টি দলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সংলাপ করলেও বিভিন্ন কারণে আরও কিছু দলের সঙ্গে সংলাপ করতে পারেনি। তবে আরও ১৩টি দলের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিকভাবে সংলাপ হয়েছে বলে জানা গেছে। আর এবার দ্বিতীয় দফায় আগের ২৩টি দলসহ আরও ৬ থেকে ৭টি দলের সঙ্গে সংলাপ করতে চায় বিএনপি।
বিএনপির সঙ্গে সংলাপে যুগপৎ আন্দোলনে একমত দলগুলো হচ্ছে— লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এলডিপি), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, নাগরিক ঐক্য, গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, মুসলিম লীগ, জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর), জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), ন্যাশনাল পার্টি (ন্যাপ-ভাসানী), জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি, সাম্যবাদী দল, ডেমোক্র্যাটিক লীগ, ইসলামী ঐক্যজোট, ইসলামিক পার্টি, এনডিপি, পিপলস লীগ, বাংলাদেশ জাতীয় দল, মাইনরিটি জনতা পার্টি ও গণফোরাম (মন্টু)।
আর দ্বিতীয় ধাপের সংলাপ শুরু হয় গত ২ অক্টোবর। ওই দিন কল্যাণ পার্টির সঙ্গে গুলশানে চেয়ারপারসনের অফিসে মতবিনিময় করে বিএনপি। এরপর ৩ অক্টোবর বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, এলডিপি, ৬ অক্টোবর লেবার পার্টি ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টি, ১০ অক্টোবর জাগপা (একাংশ) ও মুসলিম লীগ, ১৮ অক্টোবর ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ও জমিয়ত, ২৩ অক্টোবর ন্যাপ ভাসানী ও পিপলস লীগ, ৯ নভেম্বর মাইনরিটি জনতা পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাপ (একাংশ) ও বাংলাদেশ সাম্যবাদী দলের (একাংশ) সঙ্গে কথা বলেন বিএনপি নেতারা।
বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা বলছেন, ২০০১ সালের আগে চারদলীয় জোট করে যেভাবে রাজপথ দখলে রেখে ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয় লাভ করে সেভাবে আন্দোলন করতে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। তবে সেবার জোটগতভাবে আন্দোলন হলেও এবার হবে যুগপৎ আন্দোলন।
তারা বলছেন, যুগপৎ আন্দোলন শুরু হবে, এর রূপরেখা কবে ঘোষণা করা হবে— কৌশলগত কারণে সেই দিনক্ষণ এখনই প্রকাশ বলা যাচ্ছে না। সঠিক সময়ে জাতির সামনে তুলে ধরা হবে। তবে যুগপৎ আন্দোলনের রূপরেখা চূড়ান্ত পর্যায়ে। আগামী ১০ ডিসেম্বরে ঢাকার সমাবেশে ঘোষণা করা হতে পারে এই চূড়ান্ত রূপরেখা।
সমাবেশ থেকে নির্বাচনপরবর্তী তারেক রহমানের নেতৃত্বাধীন জাতীয় সরকার গঠনের একটি ডেমো প্রকাশ করা হতে পারে। একই সঙ্গে সংবিধান ও বিচার বিভাগের বেশ কিছু বিষয় পরিবর্তন, দুর্নীতি-গুমে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করাসহ বিএনপি ক্ষমতায় গেলে কীভাবে দেশ পরিচালনা করা হবে, সে বিষয়ে বেশ কিছু প্রতিশ্রুতিও তুলে ধরা হতে পারে। তবে সবই এখনও আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে। এ বিষয়ে একমত পোষণ করা রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতারা ওই সমাবেশ মঞ্চে উপস্থিত হয়ে একযোগে এই রূপরেখা ঘোষণা করবেন বলেও জানা গেছে।
নাগরিক ঐক্যর সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না নয়া শতাব্দীকে বলেন, যুগপৎ আন্দোলনের বিএনপির সঙ্গে আমরা আছি। আমরা চেঞ্জ অব সিস্টেম সঙ্গে বিএনপি রাজি আছে কিনা সেবিষয়েও আবারও বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করব।
তিনি বলেন, সরকার পতনের আন্দোলন চলছে বহু দিন ধরে। মাঝে একটু জোয়ার-ভাটা চলছে। তাছাড়া আমরা সবাই একসঙ্গে আছি। এখন যে সমাবেশগুলো বিএনপি করছে তা দেখে আমরা উৎফুল্ল। আমরা সমর্থন করি। সমাবেশে দলে দলে ব্যাপক মানুষ আসছে। আমরা মনে করি, এটা জনগণের উত্থান, জনগণের গণঅভ্যুত্থান। এটাকে একসঙ্গে করে একটা রূপ দিতে হবে যাতে সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয়। আমরা আগেও ছিলাম এখনও আছি।
এক প্রশ্নের জবাবে মান্না বলেন, যুগপৎ আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপরেখা ষোষণার বিষয়ে বিএনপির তরফ থেকে এখনও কোন কিছু জানানো হয়নি। তবে আগামী ১০ ডিসেম্বর সমাবেশে বিএনপি যদি আমন্ত্রণ জানায় তাহলে আমরা যোগ দেবো।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন নয়া শতাব্দীকে বলেন, শুধু বিএনপি নয়, দেশের প্রতিটি জনগণ সরকারের পতন চায়। বিএনপির সঙ্গে সংলাপে অংশ নেয়া প্রত্যেক দলই যুগপৎ আন্দোলনের বিষয়ে একমত। তবে কবে নাগাদ আন্দোলন শুরু হবে তা কৌশলগত কারণে এখনই প্রকাশ করা হবে না। দলের সঠিক সংখ্যাও বলা যাচ্ছে না। এখনও সংলাপ চলছে। তিনি বলেন, চূড়ান্ত রূপরেখায় কী কী দফা থাকবে তা ফাইনালি সাংবাদিকদের মাধ্যমে জনগণের সামনে তুলে ধরা হবে।
জাতীয় পার্টির সঙ্গে সংলাপ হবে কিনা জানতে চাইলে খন্দকার মোশাররফ আরও বলেন, এখনই বলা যাচ্ছে না। এটা সময়ই বলে দেবে।
আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী নয়া শতাব্দীকে বলেন, অবৈধ আওয়ামী সরকার পতনের আন্দোলন যারা রাজপথে থাকবে, তাদের নিয়ে একটি জাতীয় সরকার গঠন হবে। এই জাতীয় সরকার তারেক রহমানের নেতৃত্বে কী ভূমিকা পালন করবে, তা পরিষ্কার করা হবে। জাতীয় সরকার কী কী সংস্কার করবে জাতির সামনে আগামী দিনে তা পরিষ্কার করা হবে।
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ