ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফোনালাপ ফাঁসের শাস্তি কি?

প্রকাশনার সময়: ১২ আগস্ট ২০২১, ০১:৩৭

বাংলাদেশে প্রায়ই ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে আড়ি পাতা এবং গোপন ফোনালাপ ফাঁস হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটতে থাকায় সাধারণ মানুষের গোপনীয়তার অধিকার খর্ব হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এক্ষেত্রে আইন থাকলেও সরকারি সংস্থা এবং বাহিনী তা যথাযথভাবে প্রতিপালন করে কিনা সেটি নিয়েও আছে প্রশ্ন।। এ ধরনের কাজ কি বৈধ? সংবিধান ও আইনে এ বিষয়ে কী আছে?এতে কি ধরণের শাস্তির কথা বলা হয়েছে।

সর্বজনীন মানবাধিকার সনদপত্র, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চুক্তি বলছে, পৃথিবীর সব আধুনিক ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার স্বীকৃত ও সংরক্ষিত। আর দেশের সংবিধানের ৪৩(খ) অনুচ্ছেদে চিঠিপত্র ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা সংরক্ষণকে নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ব্যক্তির গোপনীয়তা রক্ষায় রায় দিয়েছেন দেশের হাইকোর্টও। এরপরও ঘটছে ফোনালাপ ফাঁসের মতো ঘটনা, যা ছড়িয়ে পড়ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

২০১৩ সালের ২৬ অক্টোবর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ফোন করে ৩০ মিনিট কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাদের সেই ফোনালাপ ফাঁস হয়ে যায়। ওই ফাঁসের ঘটনা বেশ আলোচিত ছিল। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও রাজশাহী মহানগর পুলিশের সহকারী কমিশনার, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কর্মকর্তা ও একজন ডিআইজির ফোনালাপও ফাঁস হয়েছিল। সম্প্রতি চিত্রনায়িকা পরীমণি, ব্যবসায়ী হেলেনা জাহাঙ্গীর, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষসহ অনেকেরই ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও ফোনালাপ ফাঁস হয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। যাকে সর্বজনীন মানবাধিকার সনদপত্র ও সংবিধানের পরিপন্থি বলে মনে করেন আইন বিশেষজ্ঞরা।

সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, কারও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বা ফোনালাপ ফাঁস করা সংবিধান পরিপন্থি। একই সঙ্গে অত্যন্ত অমানবিক ও নিন্দনীয়। এতে মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়। হাইকোর্টও এ ব্যাপারে একটি রায় দিয়েছেন। যেখানে মানুষের গোপনীয়তা রক্ষা করতে বলা হয়েছে। তবে বিশেষ প্রয়োজনে রাষ্ট্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা সংস্থা কারও ব্যক্তিগত তথ্য সংরক্ষণ করতে পারে; কিন্তু কোনোভাবেই ফাঁস করতে পারে না।

সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী মো. জে আর খান রবিন বলেন, মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য তার নিজস্ব সম্পদ। ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে একে অন্যের সঙ্গে ফোনে অনেক ধরনের কথা বলেন। তাই বলে যে কেউ ইচ্ছা করলেই তা প্রকাশ করতে পারে না। কিন্তু এখন প্রায়ই দেখা যাচ্ছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় কারও কারও গোপন কথোপকথনসহ অন্যান্য ব্যক্তিগত বিষয়ও প্রতিনিয়ত ফাঁস হয়ে যাচ্ছে, যা অত্যন্ত নিন্দনীয় ও দুঃখজনক। এতে একজন মানুষ পারিবারিক ও সামাজিকভাবে হেয় হন। সংবিধানের ৪৩(খ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, চিঠিপত্র ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকারের কথা বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০১-এর ৭১-ধারায় আড়ি পাতার সাজার বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। ওই ধারা অনুযায়ী, এই অপরাধের জন্য ২ বছর কারাদণ্ড ও অনধিক ৫ কোটি টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। তবে ওই আইনের ৯৭(ক) ধারা অনুযায়ী, সরকার কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তার ক্ষেত্রে এই বিধানগুলো প্রযোজ্য হবে না। তবে এক্ষেত্রেও সরকারি ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তার জনসমক্ষে তা প্রকাশ করা বা দীর্ঘদিন পর্যন্ত নিজ হেফাজতে রেখে দেওয়া সমীচীন নয়।

এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, ফোনে আড়ি পেতে ও ব্যক্তির গোপনীয়তা ফাঁস করে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া অবশ্যই অপরাধ। কারণ গোপনীয়তা সংরক্ষণ নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসেবে সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদে স্বীকৃতি পায়।

এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রাষ্ট্রের প্রয়োজনে কোনো ব্যক্তির বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে পারে। কিন্তু কারও গোপনীয়তা ফাঁস করে তা ছড়িয়ে দিতে পারে না এবং এমন ঘটনা আমি এখনও দেখিনি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা রাষ্ট্রের কোনো সংস্থা কারও ভিডিও বা ফোনালাপ ফাঁস করেনি। যেসব ঘটনা ঘটেছে, তা অন্য কেউ করেছে।

এদিকে ফোনালাপে আড়ি পাতা প্রতিরোধে পদক্ষেপের নির্দেশনা চেয়ে গত ১০ আগস্ট হাইকোর্টে একটি রিট করা হয়েছে। রিটকারীদের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, ‘সংবিধান লঙ্ঘন করে দেশে এখন ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনা অহরহ ঘটছে। এটি বন্ধ হওয়া উচিত।’

এদিকে ২০১৯ সালের ২৮ আগস্ট বিচারপতি মো. শওকত হোসাইন, বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস ও বিচারপতি এএসএম আব্দুল মবিনের বৃহত্তর হাইকোর্ট বেঞ্চ এ বিষয়ে একটি রায় দিয়েছিলেন। ওই রায়ে বলা হয়েছে, ‘টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন ও টেলিফোন সেবা প্রদানকারী কোম্পানিগুলোর দায়িত্ব সর্বাধিক। সংবিধান ও আইন অনুযায়ী ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সংরক্ষণ তাদের দায়িত্ব। তারা আইনের বিধান ব্যতিরেকে গ্রাহকদের ব্যক্তিগত যোগাযোগের তথ্য দিতে পারে না।’

নয়া শতাব্দী/এসইউ

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ