ঢাকা, সোমবার, ২৮ অক্টোবর ২০২৪, ১২ কার্তিক ১৪৩১, ২৪ রবিউস সানি ১৪৪৬

কী করতে চাচ্ছেন ডা. জাফরুল্লাহ, সাকি, নুর ও কাইয়ুম

প্রকাশনার সময়: ০৩ এপ্রিল ২০২১, ১৪:৪৩
ফাইল ছবি

দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন এক প্ল্যাটফর্ম গঠনের প্রচেষ্টা বিশেষ কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন ভাসানী অনুসারী পরিষদ, বামপন্থি রাজনীতিবিদ জোনায়েদ সাকির নেতৃত্বাধীন গণসংহতি আন্দোলন, ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের নেতৃত্বাধীন ছাত্র-যুব ও শ্রমিক অধিকার পরিষদ এবং লেখক-গবেষক হাসনাত কাইয়ুমের নেতৃত্বাধীন রাষ্ট্রচিন্তার সমন্বয়ে চার সংগঠনের এই নতুন প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চলছে। একজন প্রবীণ ও তিন তরুণ নেতা আসলে কী করতে চাইছেন- সেটা নিয়েও চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা।

নতুন প্ল্যাটফর্ম গঠনের উদ্যোক্তাদের দাবি, দেশে 'গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক কাঠামো প্রতিষ্ঠার' আন্দোলনের অংশ হিসেবেই ঐক্যবদ্ধ হতে চেষ্টা করছেন তারা। এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে একটা জায়গায় দাঁড়ানোর চেষ্টা রয়েছে তাদের। ইতোমধ্যে কয়েকদিন জাতীয় দিবসের কর্মসূচি একসঙ্গে পালনও করেছেন তারা। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাদের সাংগঠনিক কোনো কাঠামো তৈরি হয়নি। বলছেন, এটাকে 'বোঝাপড়া অবস্থার প্রাথমিক প্ল্যাটফর্ম' হিসেবে ধরে নেওয়া যায়।

রাজনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, চার সংগঠনের এই প্ল্যাটফর্ম গঠনের উদ্যোগ চলছে কয়েক মাস ধরে। তবে উদ্যোক্তারা অনেকটাই ধীরগতিতে জাতীয় বিভিন্ন ইস্যুতে সরব হতে চাইছেন। এরই মধ্যে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে এই চার সংগঠন। এর আগে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বড় ধরনের কয়েকটি কর্মসূচি পালন করেও রাজনৈতিক বোদ্ধাদের দৃষ্টিতে এসেছে নতুন এই প্ল্যাটফর্মটি। এছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবীকে নিয়ে কর্মসূচি পালনের উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে।

উদ্যোক্তারা বলছেন, শুরুতে এই চার সংগঠনকে একীভূত করে একটি রাজনৈতিক দলে রূপান্তরিত করার পরিকল্পনা থাকলেও পরে সেখান থেকে সরে এসেছেন তারা। বরং এই চার সংগঠনের সঙ্গে সমমনা অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর একটি বৃহত্তর জোট গঠনের পরিকল্পনা নিয়েই এগোচ্ছেন। ইতোমধ্যে তারা বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও আলোচনা করেছেন। তবে সব কিছুই এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, চূড়ান্ত কোনো রূপ নেয়নি।

বাম-ডানের মিশেল!: নতুন প্ল্যাটফর্ম গঠনের উদ্যোক্তাদের মধ্যে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বামঘেঁষা হলেও 'বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবী' হিসেবেও পরিচিত। প্রায়ই বিএনপির কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে নানাবিধ পরামর্শ দিতে দেখা যায় তাকে। তবে তার নেতৃত্বাধীন ভাসানী অনুসারী পরিষদ একটি বুদ্ধিবৃত্তিক সংগঠন হলেও এর কার্যক্রমের মধ্যে রাষ্ট্র ও গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা যুক্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বামপন্থি রাজনীতিবিদের মধ্যে সরকারবিরোধী অন্যতম সোচ্চার নেতা। তার দল গণসংহতি আন্দোলন দেশের বামপন্থি দলগুলোর সর্ববৃহৎ জোট বাম গণতান্ত্রিক জোটের অন্যতম শরিক দল। অন্য দুই উদ্যোক্তার মধ্যে ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের ছাত্র-যুব ও শ্রমিক অধিকার পরিষদ অনেকটাই ডানপন্থি সরকারবিরোধী চিন্তা-চেতনা থেকে নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে সক্রিয় রয়েছে। রাষ্ট্রচিন্তার সদস্য হাসনাত কাইয়ুমও বামপন্থি চিন্তা-চেতনার মানুষ হিসেবে পরিচিত। ফলে নতুন উদ্যোগ কার্যকর রূপ নিলে সেটা ডান ও বামের সমন্বয়ে একটা প্ল্যাটফর্ম হবে বলেও মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।

সূত্র মতে, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকিসহ নতুন প্ল্যাটফর্ম গঠনের উদ্যোক্তারা তাদের উদ্যোগ বিষয়ে বাম জোটের শরিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। নতুন প্ল্যাটফর্মের উদ্দেশ্য নিয়ে বামপন্থি দলগুলোর অনেকের মধ্যেই সংশয় রয়েছে। আবার বাম গণতান্ত্রিক জোট সক্রিয় থাকা অবস্থায় নতুন কোনো প্ল্যাটফর্ম গঠনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে কিনা অথবা এ নিয়ে বাম জোটের শরিকদের মধ্যে কোনো মতবিরোধ দেখা দেবে কিনা ইত্যাদি নিয়েও অনেকের মধ্যে প্রশ্ন রয়েছে। এই কারণে নতুন এই উদ্যোগের সঙ্গে আদৌ যুক্ত হবেন কিনা সেটা নিয়ে এখনই কোনো চূড়ান্ত মতামত দিতে রাজি নন তারা।

আসছে তিন দফা দাবি: চার সংগঠনের নেতারা তাদের ভাষায় দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে তিন দফা দাবি উত্থাপনের বিষয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করেছেন। এই তিন দফা দাবির মধ্যে রয়েছে- ক্ষমতাসীন সরকারের পদত্যাগ, নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বা জাতীয় সরকার ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন পরিচালনা এবং নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে দেশের গণতন্ত্রকে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা করতে সংবিধানের কিছু সংশোধনসহ বিদ্যমান বেশ কিছু আইনের অসঙ্গতি দূর করা। নতুন উদ্যোগের বিষয়ে উদ্যোক্তারা গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রবসহ সমমনা নেতাদের মতামত ও পরামর্শ নিয়েছেন। উল্লিখিত নেতারা তাদের এ উদ্যোগের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন বলে চার সংগঠনের নেতাদের দাবি।

উদ্যোক্তারা বলছেন, শিগগিরই সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরবেন তারা। সরকার তিন দফা দাবি না মানলে দেশের সব রাজনৈতিক দল ও মতকে নিয়ে বৃহৎ প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে গণআন্দোলনের পরিবেশ সৃষ্টিতেও প্রচেষ্টা নেবেন তারা।

চার সংগঠনের নেতারা জানান, এর বাইরে দেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাসকে জাতির সামনে তুলে ধরার প্রাথমিক সিদ্ধান্তেও ঐকমত্যে পৌঁছেছেন তারা। বিশেষ করে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে মওলানা ভাসানীর অবদানসহ অন্যান্য কৃতী মুক্তিযোদ্ধার ইতিহাসকে গুরুত্ব দিয়ে প্রচার তাদের অন্যতম উদ্দেশ্য। এই লক্ষ্য নিয়েই মওলানা ভাসানীর ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকীতে বেশ কয়েকটি বড় ধরনের কর্মসূচি পালন করেছেন তারা।

শুরুতেই মতবিরোধ: জানা গেছে, নতুন প্ল্যাটফর্ম তৈরির উদ্যোগ জোরদার হওয়ার পর থেকেই উদ্যোক্তাদের নিজেদের মধ্যেই আদর্শিক ও রাজনৈতিক মতপার্থক্য শুরু হয়েছে। একটি পক্ষ দেশের গণতন্ত্র উদ্ধারে সব দল ও মতকে ঐক্যবদ্ধ করার পদক্ষেপ নিয়ে অগ্রসর হতে চায়। এক্ষেত্রে মত-পথ ও আদর্শ ভিন্ন হলেও তাদের সমস্যা নেই। তাদের এই চিন্তাধারার সঙ্গে ডানপন্থি বিএনপি এবং ধর্মভিত্তিক দল যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামী ও মৌলবাদী দল হিসেবে পরিচিত হেফাজতে ইসলামকেও একত্র করার পরিকল্পনা রয়েছে। আরেকটি পক্ষ শুধু বাম ঘরানার রাজনৈতিক দল এবং সুশীল সমাজকে নিয়ে মাঠে নামার কথা বলেন। সেখানে ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে সম্পূর্ণ বাইরে রাখতে চান তারা। এর অংশ হিসেবে অচিরেই তারা বিভিন্ন পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবীকে নিয়ে নতুন কর্মসূচি ঘোষণার প্রস্তুতিও রেখেছেন।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণেও নতুন প্ল্যাটফর্ম গঠনের উদ্যোক্তাদের মধ্যে কিছুটা পিছুটান তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে এই সফরকে ঘিরে রাজনীতির মাঠ উত্তপ্তকারী হেফাজতে ইসলামের ডাকা হরতালে সমর্থন দেওয়াকে কেন্দ্র করে নিজেদের মধ্যে অপ্রকাশ্য মতভেদও শুরু হয়েছে বলে নেতারা জানান।

ভাসানী অনুসারী পরিষদের একজন নেতা জানিয়েছেন, নিজেদের মধ্যে কোনো আলাপ-আলোচনা কিংবা সিদ্ধান্ত ছাড়াই ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী তার একক সিদ্ধান্তে হেফাজতে ইসলামের হরতালকে সমর্থন দিয়েছেন। আবার ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরও তার দল নিয়ে হেফাজতকে সমর্থন জানিয়ে আন্দোলনের কর্মসূচি পালন করেছেন। এই দুইজনের ভূমিকাই অন্যরা সমর্থন করছেন না। বিষয়টি নতুন প্ল্যাটফর্ম গঠনের উদ্যোক্তাদের কিছুটা বিব্রত করেছে।

উদ্যোক্তারা যা বললেন: নতুন প্ল্যাটফর্ম গঠনের উদ্যোগ নিয়ে ভাসানী পরিষদের আহ্বায়ক ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সমকালকে বলেন, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নতুন ধারার রাজনীতি প্রচলনে নতুনদের জায়গা করে দিতে হবে। এখানে জোনায়েদ সাকি ও ভিপি নুরের মতো তরুণরা তাদের যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছেন। কোটা সংস্কার আন্দোলন কিংবা নিরাপদ সড়কের মতো অরাজনৈতিক ইস্যুতে তাদের যে ভূমিকা তা অন্য কোনো বড় দলেরও নেই। আগামীতে নতুনদের হাতে নেতৃত্ব তুলে দিতেই এ প্ল্যাটফর্ম।

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, তারা দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং ভবিষ্যতের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো প্রতিষ্ঠার বিষয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটা জায়গায় পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন। এটা তাদের নতুন কোনো রাজনৈতিক মেরুকরণ বা জোট গঠনের প্রচেষ্টাও নয়। তাছাড়া উদ্যোগটি প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, এখনও চূড়ান্ত কিছু হয়নি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তার দল বাম গণতান্ত্রিক জোটেরও শরিক। তবে তাদের উদ্যোগ বাম জোটের আদর্শ ও চিন্তা-চেতনার বিরোধী কিছু নয়। ফলে তাদের উদ্যোগে বাম জোটের আপত্তি কিংবা মতভেদ থাকার কথাও নয়।

ছাত্র-যুব ও শ্রমিক অধিকার পরিষদের আহ্বায়ক নুরুল হক নুর বলেন, দেশের গণতান্ত্রিক সংকট কাটিয়ে উঠতে একটি কার্যকর প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলার জন্য কাজ করছেন তারা। তাদের এ উদ্যোগের সঙ্গে আরও দল, সংগঠন ও বিভিন্ন সোসাইটিকেও সম্পৃক্ত করা হবে। তিনি বলেন, বর্তমান সরকারকে সরাতে সব জায়গা থেকে প্রতিবাদের আওয়াজ তুলতে নতুন পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। সেখানে কোনো বিভক্তি রাখা যাবে না। দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ ও যুগপৎ উভয় ধরনের আন্দোলন চলবে। সেখানে ডান-বাম সবাইকে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।

রাষ্ট্রচিন্তার সদস্য হাসনাত কাইয়ুম বলেন, রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সংস্কারের জন্য এক জায়গায় এসেছেন তারা। এখন নিজেদের মধ্যে কিছু কাজের মাধ্যমে আরও কাছাকাছি আসা যায় কিনা এবং নিজেদের মধ্যে হৃদ্যতা হয় কিনা- সেটা দেখার পর্বে রয়েছেন তারা। তাদের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কোনো জোট গঠন হয়নি। তিনি বলেন, দেশের সংকট উত্তরণে রাষ্ট্রচিন্তার পক্ষ থেকে তিন দফা প্রস্তাবনা তৈরি করা হচ্ছে, যা চার সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা করে জাতির কাছে তুলে ধরা হবে। বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক দেশে রূপান্তরিত করতে বৃহত্তর ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই বলেও মন্তব্য করেন হাসনাত কাইয়ুম।সূত্র : সমকাল

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ