ঘোষণার পর আট মাস পার হতে চললেও গতি পায়নি সরকারের উচ্চাভিলাষী ও আলোচিত উদ্যোগ সর্বজনীন পেনশন। যাচাই-বাছাই আর মূল্যায়নের ফাঁদে আটকা পড়েছে উদ্যোগটি। যদিও এ সংক্রান্ত আইনের খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পায় গত জুন মাসে, কিন্তু এরপর আর কোনো অগ্রগতি নেই।
সূত্র জানায়, চলতি বছর ২৩ ফেব্রুয়ারি অর্থনৈতিকবিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল ‘সবার জন্য পেনশন স্কিম’-এর ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, আগামী ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে চালু হবে প্রোগ্রামটি। এটি বাস্তবায়নে শিগগিরই পৃথক আইন ও বিধি প্রণয়ন করে বাস্তবায়ন কাজ শুরু করা হবে।
অর্থমন্ত্রীর এ ঘোষণার পর মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত খসড়া যাচাই-বাছাইয়ের জন্য পাঠানো হয় অর্থ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত জাতীয় সংসদের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে। সংসদীয় কমিটিতে খসড়াটি আসার পর চার মাস কেটে গেলেও স্থায়ী কমিটি বিষয়টি নিয়ে এখনও বৈঠকেই বসেনি। কবে বৈঠক হতে পারে তাও জানা যায়নি। ফলে এটি কবে বাস্তব রূপ লাভ করবে, তা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, গত ফেব্রুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবার জন্য পেনশন ব্যবস্থার প্রস্তাবে সম্মতি দেয়ার পর অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানিয়েছিলেন, আগামী অর্থবছর থেকে এটি চালু হবে। কিন্তু কাজ যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে ধারণা করা হচ্ছে বর্তমান সরকারের মেয়াদে এটি আর আলোর মুখ নাও দেখতে পারে!
সর্বজনীন পেনশন স্কিমের উদ্যোগটি এমনভাবে সাজানো হচ্ছে যাতে দেশের বেসরকারি পর্যায়ের সব মানুষ পেনশনের আওতায় আসেন। এমনকি যাদের পেনশনের প্রিমিয়াম দেয়ার মতো ক্ষমতা নেই, তাদেরও এর আওতায় আনা হবে। এমন সুযোগ রেখেই ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন-২০২২’-এর খসড়ায় গত ২১ জুন অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। তবে সরকারি চাকরিজীবীরা এই আইনের আওতায় পড়বেন না। কারণ চাকরি শেষে তারা পেনশন পান।
আইনে ‘জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ’ গঠনের কথা বলা আছে। এতে একজন নির্বাহী চেয়ারম্যান থাকবেন এবং চারজন সদস্য নিয়ে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ গঠন হবে। অর্থমন্ত্রীকে চেয়ারম্যান করে ১৫ সদস্যের পরিচালনা পর্ষদ থাকবে।
এ আইন কার্যকর হলে আমৃত্যু পেনশন পাবেন সুবিধাভোগীরা। দেশের নাগরিকদের মধ্যে ১৮ থেকে ৬০ বছর পর্যন্ত নির্ধারিত প্রিমিয়াম জমা দিলে ৬০ বছরের পর থেকে পেনশন সুবিধা পাবেন। পেনশন পেতে কমপক্ষে ১০ বছর নিয়মিত প্রিমিয়াম দিতে হবে।
আইনটি জাতীয় সংসদে পাস হলে বিধি দিয়ে নির্ধারণ করা হবে এর সুযোগ সুবিধা। এতে প্রবাসীদেরও পেনশন দেয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি এ বিষয়ে তাদের মতামত দেয়ার পর আইনটি পাসের জন্য জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হবে। সংসদে পাস হলে সম্মতির জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হবে।
সূত্র জানায়, জাতীয় সংসদে খসড়া আইনটি পাস হওয়ার পরই পেনশন কর্তৃপক্ষের জন্য একজন চেয়ারম্যান নিয়োগ দেবে সরকার। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে চেয়ারম্যান কর্তৃপক্ষের জন্য চারজন সদস্য নিয়োগ দেবেন। পেনশন কর্তৃপক্ষ কীভাবে পরিচালিত হবে, সে বিষয়ে বিধি তৈরি করবেন নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তারা। মূলত কর্তৃপক্ষ গঠনের মাধ্যমেই সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হবে।
প্রস্তাবিত খসড়া আইনে বলা আছে, পেনশনের বিপরীতে প্রিমিয়ামের একাধিক স্তর থাকবে। যিনি বেশি প্রিমিয়াম দেবেন, তার পেনশন বেশি হবে। পেনশনারদের কেউ ৬০ বছর পর্যন্ত প্রিমিয়াম দেয়ার পরপরই মারা গেলে তার নমিনি প্রয়াত পেনশনারের ৭৫ বছর বয়স পর্যন্ত পেনশন পাবেন। প্রিমিয়ামের পরিমাণ কী রকম হবে, তা বিধির মধ্যে উল্লেখ থাকবে।
একজন নাগরিক ১৮ বছর থেকে পেনশনের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর সরকারি চাকরিতে ঢুকলে তিনি সর্বজনীন পেনশন তহবিলের সব প্রাপ্য টাকা এককালীন পেয়ে যাবেন। এরপর তিনি সরকারি চাকরির পেনশন নিয়মে ঢুকে যাবেন। কেউ ৬০ বছরের আগে মারা গেলে তার নমিনিরাও নির্ধারিত হিসাব অনুযায়ী এককালীন টাকা পাবেন।
স্থায়ী কমিটির বৈঠক না হওয়া বিষয়ে জাতীয় সংসদের অর্থ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য সাবেক চিফ হুইপ আবদুস শহীদ বলেন, যতগুলো কমিটি আছে, তার মধ্যে আমাদের কমিটিই সবচেয়ে কম মিটিং করে। বৈঠক কম হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রশ্নটা কমিটির চেয়ারম্যান ও অর্থমন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করেন। তারাই ভালো উত্তর দিতে পারবেন। তিনি বলেন, সবার জন্য পেনশন ব্যবস্থা খুবই ভালো উদ্যোগ। খসড়া আইনে কী আছে, তার ভালো-মন্দ দেখতে হবে। এজন্য পড়াশোনা করতে হবে। তারপর মতামত দিতে হবে, তবে এটি যত দ্রুত কার্যকর করা যায়, ততই দেশের জন্য মঙ্গল। কারণ সবাই এর সুবিধা পাবে।
প্রসঙ্গত, সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর প্রস্তাব বর্তমান সরকারের নির্বাচনি অঙ্গীকার। প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণায় সর্বজনীন পেনশনের প্রস্তাব প্রথম তুলেছিলেন। তখন এর বাস্তবায়ন নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন। সমালোচকরা বলেছেন, বাংলাদেশের জন্য এ ধরনের প্রকল্প কার্যকর করা সম্ভব নয়। এটি উচ্চাভিলাষী।
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ