ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

অভিযোগ জানা নেই, তবুও আসামি অসংখ্য মানুষ

প্রকাশনার সময়: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১২:১৩ | আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১২:৪২

মো. কবির, বয়স ৫৫ বছর। বাড়ি কক্সবাজারের রামু উপজেলার গর্জনিয়ায়। ১০ বছর ধরে আদালত প্রাঙ্গণে আসা-যাওয়ার মধ্যে আছেন। তিনি রামু বৌদ্ধ বিহারে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় মামলার একটিতে অভিযুক্ত। তবে তার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ- সেটি সুস্পষ্টভাবে বলতে পারছেন না। পেশায় বর্গাচাষী কবির এখন পর্যন্ত মামলা বাবদ কয়েক লাখ টাকা খরচ করেছেন। বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে ধারদেনা করে দিতে হয়েছে তার এই টাকা।

কক্সবাজারের রামু ট্রাজেডির দশ বছর পূর্ণ হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে গুজবের জেরে ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে রামুর বৌদ্ধ বিহার ও বসতিতে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ১৯টি মামলার ১৮টি বিচারাধীন। তবে, এখনো সাক্ষীর অভাবে গতিহীন হয়ে পড়েছে ১৮টি মামলার বিচার কাজ। তবে ১টি মামলা প্রত্যাহার করেন বাদী নিজেই।

অভিযোগ রয়েছে, এই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় অনেক নিরাপরাধ মানুষকে আসামি করা হয়েছে। অন্যদিকে হামলায় জড়িত থেকেও পার পেয়ে গেছে অনেকে। এই নিয়ে খোদ বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজনের মাঝেও ক্ষোভ রয়েছে।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এবং কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি ফরিদুল আলম জানান, ১০ পার হতে চললেও অভিযোগপত্র জমা ছাড়া একটি মামলারও অগ্রগতি নেই। শুধুমাত্র সাক্ষীদের অনীহার কারণে তা সম্ভব হয়নি। সমন জারি, ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করেও সাক্ষ্য দিতে তাদের আদালতে আনা যাচ্ছে না!

তিনি বলেন, সাক্ষীরা আমাদের বলেছেন, তারা এসব মামলার বিচার চায় না। কারণ পুড়ে যাওয়া মন্দিরের স্থলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্মাণ করে দেয়া মন্দিরগুলো তাদের বেশি সন্তুষ্ট করেছে। শেখ হাসিনা যা দিয়েছেন তা হারানোর চেয়ে অনেক বেশি। তাই হামলাকারীদের বিচার না হলেও তাদের কোনো দুঃখ নেই!

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিচারাধীন ১৮ মামলার (রামুর সাতটি, উখিয়ায় সাতটি, টেকনাফে দুইটি ও কক্সবাজার সদরের দুইটি) আসামি ৯৯৫ জন। আসামিদের মধ্যে রয়েছেন, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা পরিষদ সাবেক চেয়ারম্যান তোফাইল আহমদ, কক্সবাজার পৌরসভার সাবেক মেয়র সরওয়ার কামাল, উখিয়া উপজেলা পরিষদ সাবেক চেয়ারম্যান ও উখিয়া উপজেলা বিএনপির সভাপতি সরওয়ার জাহান চৌধুরী, উখিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা সুলতান মাহমুদ চৌধুরী, জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও জেলা জামায়াতের সাবেক সেক্রেটারি শাহজালাল চৌধুরী, জামায়াত নেতা ভিপি বাহাদুর প্রমুখ।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, রামু- উখিয়া ও টেকনাফের বৌদ্ধমন্দির ও বসতি পোড়ানোর এই সহিংসতার ঘটনায় এজাহারভুক্ত ৩৭৫ জনসহ ১৫ হাজার ১৮২ জনের বিরুদ্ধে ১৯টি মামলা দায়ের করা হলেও পরবর্তীতে এসব মামলায় ৯৪৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। এরমধ্যে একটি আপসে নিষ্পত্তি হয়ে গেছে, দুটি পুন:তদন্তাধীন রয়েছে। ১৬টি বিচারধীন রয়েছে।

অন্যদিকে সেই বর্বর হামলার ১০ বছর পর ক্ষতি কেমন পুষিয়েছে বৌদ্ধরা, কোথায় দাঁড়িয়েছে তাদের জীবন- তা জানতে ঘুরে দেখা হয় রামুর বিভিন্ন বৌদ্ধপল্লী। সেখানে আলাপকালেও আধুনিক স্থাপত্যশৈলিতে নির্মিত সুরম্য মন্দির পেয়ে বেশ খুশি বৌদ্ধরা। তাদের মনে যে ক্ষোভ দানা বেধেছিলো তা বহুলাংশে মুছে গেছে। তারা এখন প্রায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। তবে বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সাধারণ বৌদ্ধরা শক্ত অবস্থানে রয়েছে।

ঐতিহাসিক রাংকুট বনাশ্রম বৌদ্ধ বিহারের উপাধ্যক্ষ সাধনানন্দ ভিক্ষু বলেন, ১০ বছরের মাথায় এসে বৌদ্ধরা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। সেই বিভৎস ঘটনার প্রভাব কেটে গেছে। কিন্তু এত বড় বর্বর ঘটনা কখনো ভোলার নয়। তাই স্বাভাবিকভাবে রেশ রয়েই গেছে, থাকবেও আজীবন। তবে বিচার প্রাপ্তি নিয়ে সন্দেহ রয়েছে অনেকের মনে।

বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতি রামু উপজেলা শাখার সভাপতি সুরেশ বড়ুয়া বলেন, ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বৌদ্ধ সম্প্রদায়সহ রামুবাসীর জন্য একটি ‘কালো রাত’ ছিলো। এই নৃশংস ঘটনাটি রামু সম্প্রীতির জায়গায় বড় একটা ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিলো। তারপরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অকল্পনীয় সহযোগিতার মাধ্যমে তা পূরণ করা হলেও আমাদের শত শত বছরের পুরোনো স্থাপত্যশিল্পগুলো আর ফিরে পাবো না। যে কারণে অনেকের মনে দাগ রয়ে গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর উত্তম বড়ুয়া নামের এক বৌদ্ধ যুবকের ফেসবুকে পবিত্র কোরআন অবমাননার একটি ছবি ট্যাগকে কেন্দ্র করে রামুতে সংঘটিত হয় ভয়াবহ ঘটনা। পরে রাতের অন্ধকারে রামুতে ১২টি বৌদ্ধ বিহার, ৩০টি বসতঘরে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে দুস্কৃতিকারীরা। ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে একইভাবে উখিয়া ও টেকনাফে ৭টি বৌদ্ধ বিহার ও ১১টি বসতিহামলা ও অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনার পর পরই সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত বিহার ও ঘরবাড়িগুলো নতুন কারুকাজে পুনর্নির্মাণ করে দেয় সরকার।

নয়াশতাব্দী/জেডএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ