দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বকে ‘মাইনাস’ করে আসছে নতুন এক জোট। নতুন জোটের তৎপরতা এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় জড়িত রয়েছে বিএনপির ২০ দলীয় জোটের শরিক ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বেশ কয়েকটি দল। তাদের এই তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন সাবেক সামরিক-বেসরকারি আমলারাও। নতুন জোটে নাম লেখাতে জোট-ফ্রন্টের কয়েকটি দল সঙ্গ ত্যাগ করেছে বিএনপির। সামনে ২০ দলীয় জোট থেকে আরো কয়েকটি দলও বেরিয়ে যেতে পারে। নতুন জোটের উদ্যোক্তারা ইতোমধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে কয়েক দফায় অনানুষ্ঠানিক বৈঠকও করেছেন। তবে নতুন জোটে এবার জায়গা হচ্ছে না বিএনপির। নয়া শতাব্দীর সঙ্গে একান্ত আলাপকালে এমনটা জানিয়েছেন নতুন জোটের উদ্যোক্তারা।
তারা বলছেন, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে বাইরে রেখে হবে নতুন জোট। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলো তাদের অবস্থান থেকে যুগপৎ আন্দোলনের ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা চালাচ্ছে। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বকে বাদ দিয়ে তারা জাতীয় সংসদে প্রয়োজনে বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকতেও আগ্রহী। বিশেষ করে গণতান্ত্রিক ও মুক্তিযুদ্ধে পক্ষের বেশকিছু রাজনৈতিক দলকে এক ছাতার নিচে আনতে চাইছে তারা। সবাই ঐক্যবদ্ধ হলে সরকারকে চাপে ফেলা যাবে এবং বিভিন্ন পদক্ষেপগুলোর যৌক্তিক সমালোচনাও করা যাবে।
বিএনপির একটি সূত্র জানায়, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে নতুন রাজনৈতিক জোটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এলডিপি সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ। সঙ্গে জড়িত রয়েছেন বিএনপির নিষ্ক্রিয়, পদবঞ্চিত ও পদত্যাগকারী কিছু নেতা। সাবেক কিছু সামরিক-বেসামরিক আমলাও যোগ দিচ্ছেন। ২০ দলীয় জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামী, কল্যাণ পার্টিসহ কয়েকটি দল, গণফোরামের একটি অংশ এবং বি চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের কয়েকটি দল, বামজোটের ও ইসলামী ঘরানার বেশ কয়েকটি দল এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত। এছাড়াও ২০ দলীয় জোটের কয়েকটি ছোট দলের সঙ্গেও আলোচনা করেছে জোটে যোগ দেয়ার ব্যাপারে। জোট গঠনে মরিয়া হয়ে তারা ইতোমধ্যে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেছেন।
খুব শিগগিরই আরো কয়েকটি বৈঠকে মিলিত হবেন তারা। এই গ্রুপটি সরকারের গ্রিন সিগন্যাল নিয়েই নতুন জোট গঠন করতে চাচ্ছে। তারা বিএনপি থেকে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে ‘মাইনাস’ করতে চান। সরকার চাইছে বিএনপি দুর্বল হয়ে আগামী নির্বাচনে যাক। যাতে এই গ্রুপটিকেই বিরোধী দলের ভূমিকায় রাখা যায়। সরকার বলবে, বাংলাদেশের সংসদ কার্যকর। শক্তিশালী বিরোধী দলও আছে।
সূত্র আরো জানায়, এই গ্রুপের তৎপরতা সম্পর্কে অবগত আছে বিএনপির হাইকমান্ড। দল ও দুই জোটের ঐক্য ধরে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ। খালেদা জিয়া কারাবন্দি থাকায় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিজেই ঐক্য প্রক্রিয়া ধরে রাখতে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলছেন। পাশাপাশি আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘিরে জোট-ফ্রন্টসহ সরকারবিরোধী আরো বৃহত্তর প্ল্যাটফর্ম তৈরি করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। দেশের বাইরেও একাধিক স্থানে বৈঠক করেছেন। সরকার গঠন করলে মন্ত্রিসভা ও কে কোন মন্ত্রণালয়ে থাকবেন তা নিয়েও প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে। বিরোধী দল হলে সংসদে তাদের ভূমিকা কেমন থাকবে সেই বিষয়েও আলোচনা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নতুন জোটের একাধিক নেতা বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় সংবিধান অনুযায়ী আগামী নির্বাচনেও অংশ নিতে পারবেন না। আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণে তারা যদি সরকার গঠন চান। বিজয়ী হতে না পারলে সংসদের প্রধান বিরোধী দল হিসেবে কার্যকর ভূমিকা রাখতে চান। সরকারের পক্ষ থেকেও সবুজ সংকেত পেয়েছেন তারা।
তবে এলডিপির চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীরবিক্রম নয়া শতাব্দী বলেন, নতুন একটি জোটের তৎপরতা সম্পর্কে আমি শুনেছি। আমরা ২০ দলীয় জোটেও আছি আবার জাতীয় মুক্তিমঞ্চেও আছি। বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আগামী নির্বাচনের জন্য এলডিপিও দলগতভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে। অনেকেই আমাদের সঙ্গে কাজ করতে চাচ্ছেন। নতুন জোটে কারা, কীভাবে কাজ করছেন আমি জানি না। তিনি বলেন, জোটের প্রধান সমন্বয়কারী ও মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। তবে এর আগে অনেক সময় বিভিন্নভাবে অপমান হয়েছি তারপরও গিয়েছি জোটের বৃহত্তর স্বার্থে।
বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক নয়া শতাব্দীকে বলেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে জোট থাকবে কী থাকবে না। বিএনপির একনিষ্ঠতা এবং গুরুত্বের ওপর নির্ভর করবে জোট কতটুকু সফল এবং গতিশীল হলো।
জাগপা চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার তাসমিয়া প্রধান বলেন, বিএনপির ২০ দলে নেতৃত্বের জায়গাটা অনেকটা অস্পষ্ট। কোথা থেকে কারা সিদ্ধান্ত দিচ্ছে বা কারা মূল দায়িত্বে আছে তা অনেকটাই স্পষ্ট নয়। মাঝে মধ্যে মনে হয়, তারা তাদের অবস্থান ঠিক রাখার জন্য আমাদের ব্যবহার করে। বিএনপির ভেতরের কিছু মানুষ অবশ্যই চায় নাই আমাদের দলগুলো মূল্যায়ন হোক এবং তারা চেয়েছে জোটটা ভেঙে যাক।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে আরো জানা যায়, বিএনপির মূলধারার বাইরে গিয়ে নতুন একটি জোট তৈরি করতে চায় দলের একটি অংশ। বিএনপিতে বিভিন্ন সময়ে দলে নানাভাবে বঞ্চিত, অবহেলিত এবং হাইকমান্ডের মাধ্যমে অপমানিত গ্রুপটি নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন দলের স্থায়ী কমিটির একাধিক প্রভাবশালী সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যান, যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদক এমনকি নির্বাহী কমিটির সদস্য পর্যায়ের নেতারা। এছাড়া ২০ দলীয় জোটের বড় একটি অংশ, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের একটি অংশসহ সরকারবিরোধী অন্য দল-মতের নেতারাও থাকছেন নতুন এই জোটে।
এদিকে বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বলছেন, দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে জিয়া পরিবারের বাইরে গিয়ে নতুন জোট করলেও লাভ হবে না। জিয়া পরিবারের সঙ্গে থেকেই পরিবর্তিত পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য তাদের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। কেউ কেউ ফিরে এলেও একটি অংশ এখনো নতুন জোট গঠনে মরিয়া হয়ে উঠেছে। বেগম জিয়া ও তারেক রহমানের ‘সবুজ সংকেত’ নিয়েই সব কিছু করতে হবে। তবে যে কোনো মূল্যে দলের মধ্যে ভাঙন ঠেকানোসহ ঐক্য ধরে রাখতে চান বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান।
এলডিপির একাংশের মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম এই প্রতিবেদককে বলেন, অলি আহমদ অতিরিক্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষার কারণে তিনি এখন না ঘরকা না ঘাটকা। তার সঙ্গে যারা এলডিপি গঠন করেন তাদের মধ্যে ড. রেদওয়ান আহমেদ ছাড়া কেউ নেই। কিছু সাবেক সেনা কর্মকর্তা হয়ত তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। কিন্তু বিএনপি বা অন্য কোনো দলের কেউ তার সঙ্গে যাবে এটা বিশ্বাস হয় না। কারণ তার সঙ্গে প্রথম দিন যিনি কথা বলেন, দ্বিতীয় দিন কথা বলতে চান না। তার মধ্যে প্রচণ্ড আত্ম-অহমিকা ও আত্মকেন্দ্রিকতা কাজ করে।
জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু নয়া শতাব্দীকে বলেন, শহীদ জিয়ার আদর্শের সৈনিক হিসেবে আমরা বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ। কোনো ষড়যন্ত্রই বিএনপিকে থামিয়ে রাখতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না। ওয়ান-ইলেভেন থেকে শুরু করে দলের বিভিন্ন দুঃসময়ে সেটা প্রমাণিত হয়েছে। দলের দুই-চারজন নেতা যদি নিজেদের সুবিধার্থে বাইরে গিয়ে কিছু করার কথা ভাবতে পারে তবে বিএনপি ও জোটের কোনো ক্ষতি হবে না। তারা ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবেন।
উল্লেখ্য, গত ১৪ জুলাই সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ছেড়েছে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম (একাংশ)।
নয়া শতাব্দী/এম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ