গত কয়েক বছরের মধ্যে এবারই সবচেয়ে ইলিশের দাম চড়া। তবে আগামী ৭ অক্টোবর থেকে ২২ দিনের জন্য সারাদেশে বন্ধ হচ্ছে ইলিশ ধরা ও বেচাকেনা। এই মৌসুমে জেলেদের জালে ধরা পড়ছে বিপুল পরিমাণ ইলিশ। বাজারেও সরবরাহ প্রচুর। পর্যাপ্ত সরবরাহ সত্ত্বেও দাম কেন এতো চড়া। মাঝারি সাইজের একটি ইলিশের দাম হাজার টাকার ওপরে। সংশ্লিষ্ট জেলে ও আড়তদাররা বলছেন, ইলিশের দাম কমার তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই।
বাংলাদেশের চাঁদপুর বড়স্টেশন মাছঘাটে বেড়েছে ইলিশের সরবরাহ। গত এক মাসের তুলনায় ঘাটে ইলিশের আমদানি বাড়ায় কর্মব্যস্ততা বেড়েছে মৎস্য ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের। প্রতিদিন কমপক্ষে দেড় হাজার মণ ইলিশ আমদানি হচ্ছে। এর আগে ৪০০ থেকে ৬০০ মণ ইলিশ আসতো ঘাটে।
শুক্রবার (১৬ সেপ্টেম্বর) সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, আগের তুলানায় ইলিশের সরবরাহ বাড়ায় বিক্রেতাদের হাঁকডাকে মুখরিত। প্রতিটি আড়তের সামনে ইলিশের স্তূপ। বরফ ভেঙে প্যাকেটজাত করা হচ্ছে ইলিশ। দক্ষিণাঞ্চল ও সাগর মোহনার প্রচুর ইলিশ মাছঘাটে আসছে। ইলিশের আমদানি বৃদ্ধি পাওয়ায় দাম কিছুটা কমেছে। তবে দাম নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ব্যবসায়ী ও ক্রেতারা। কেউ বলছেন দাম কমেছে, আবার কেউ বলছেন দাম বেড়েছে।
বর্তমানে চাঁদপুরে ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৩৪ থেকে ৩৬ হাজার টাকা মণ। সে হিসেবে এই সাইজের মাছের প্রতি কেজির দাম পড়ে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা। আর যেসব ইলিশের ওজন ৬০০ থেকে ৭০০ গ্রাম, সেগুলোর মণ ২৮ থেকে ৩০ হাজার টাকা। এগুলোর প্রতি কেজির দাম পড়ে ৭০০ থেকে সাড়ে ৭০০ টাকা। তবে চাঁদপুরের আড়তে এক কেজি সাইজের ইলিশের দাম ও চাহিদা সব থেকে বেশি। সেখানে এক কেজি ও তার চেয়ে একটু বেশি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৪২ থেকে ৪৪ হাজার টাকা মণে। তাতে প্রতি কেজি ইলিশের দাম পড়ছে এক হাজার টাকার ওপর। অপরদিকে দেড় কেজির ইলিশের দাম পড়ছে ৫২ হাজার টাকা মণ।
এদিকে নোয়াখালীতে মাত্র ৫ দিনে মা আয়েশা-২ নামে একটি ট্রলারের ২১ জন জেলে পেয়েছেন ১৩০ মণ ইলিশ। এসব মাছ নিলামে বিক্রি হয়েছে ২৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা।
শুক্রবার (১৬ সেপ্টেম্বর) বেলা সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত নোয়াখলীর হাতিয়ার চেয়ারম্যান ঘাটে এসব ইলিশ বিক্রি করা হয়।
ভোলার মনপুরা উপজেলার মো. জহির উদ্দিন মা আয়েশা-২ ট্রলারের প্রধান মাঝি। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপ ও পূর্ণিমার জোয়ারের মধ্যেই ২১ জন মিলে উত্তাল সাগরে মাছ ধরেছেন। মাত্র পাঁচ দিনে মিলেছে ১৩০ মণ ইলিশ। ভালো দাম পেয়ে উচ্ছ্বসিত জেলেরা।
আব্দুল মালেক নামে আরেক মাঝি বলেন, বিভিন্ন সাইজের মাছ ধরা পড়েছে। এক কেজি সাইজের মাছের মণ ৩০ হাজার টাকা করে পাই। আধাকেজির থেকে কম ওজনের মাছ আমরা ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা পাই।
মেঘনা ফিশিংয়ের ম্যানেজার মো. হাবিব ভূঁইয়া বলেন, মাঝি জহির উদ্দিন ১৩০ মণ মাছ পেয়েছেন। যার নিলামে দাম গড়ে ১৯ হাজার টাকা করে ২৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা। মাছগুলো সব বড় বড় এবং দেখতে সুন্দর। সারাদেশে এত বড় মাছ উঠেছে কিনা আমার জানা নেই। তবে চেয়ারম্যান ঘাটে প্রচুর মাছ উঠছে। জেলেরাও ভালো দাম পাচ্ছেন। এখানে সকাল ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত মাছ বিক্রি হয়।ইলিশের দাম বৃদ্ধির জন্য অনেকে দায়ী করেছেন ভারতে ইলিশ রফতানির সরকারি সিদ্ধান্তকে। তাদের মতে, ভারতে রফতানির কারণে দেশের বাজারে চড়া ইলিশের দাম। অথচ ভারতে মাত্র আড়াই হাজার টন ইলিশ রফতানির অনুমতি দিয়েছে সরকার। যা মোট ইলিশের উৎপাদনের তুলনায় খুবই নগন্য। গত বছর বাংলাদেশে ইলিশ ধরা পড়েছে ৬ লাখ টনেরও বেশি। এবার তা আরও বাড়ার প্রত্যাশা মৎস্য সম্পদ বিভাগের। এ পরিস্থিতিতে ভারতে রফতানির কারণে দেশের বাজারে ইলিশের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
কলকাতার বাজারগুলোতে নাকি বাংলাদেশ থেকে যাওয়া ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ঢাকার বাজারের থেকে কম দামে। রফতানিকারকরা বলছেন, পত্রপত্রিকায় যেভাবে দেখানো হচ্ছে এতটা সরল নয় ইলিশের দামের হিসাবটি। বর্তমানে কলকাতার বাজারে এক কেজি সাইজের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১২০০ থেকে ১৪০০ রুপি বা বাংলাদেশি টাকায় ১৪০০ থেকে ১৬০০ টাকায়। আবার ঢাকার খুচরা বাজারে বর্তমানে এক কেজি বা তার বেশি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি কমপক্ষে ১২০০ থেকে ১৪০০ টাকায়।
ভরা মৌসুমে ইলিশের দুর্মূল্যের বিষয়টি মেনে নিতে পারছেন না ইলিশপ্রেমীরা। বিষয়টি গড়িয়েছে আদালত পর্যন্ত। দাম বৃদ্ধির জন্য ভারতে ইলিশ রফতানির সিদ্ধান্তকে দুষছেন তারা। তাদের মতে, ভারতে ইলিশ রফতানির কারণেই দেশের বাজারে চড়ে গেছে দাম। ভারতে ইলিশ রফতানি বন্ধে সরকারকে সম্প্রতি আইনি নোটিশ দিয়েছেন মোহাম্মদ মাহমুদুল হাসান নামের এক আইনজীবী। নোটিশের কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ভারতে ইলিশ রফতানি করার কারণে বাংলাদেশে ইলিশের দাম বেড়ে গেছে। বাংলাদেশের মানুষ ইলিশ খেতে পারছেন না। বাংলাদেশের রফতানি নীতি অনুযায়ী ইলিশ রফতানি উন্মুক্ত নয়। দেশের মানুষ যেখানে ইলিশ খেতে পারছে না দামের কারণে সেখানে রফতানি গ্রহণযোগ্য নয়। তাই স্থায়ীভাবে ভারতে ইলিশ রফতানি বন্ধে ব্যবস্থা নিতে ওই নোটিশ পাঠানো হয়েছে। এ বিষয়ে সাত দিনের মধ্যে ব্যবস্থা না নেওয়া হলে উচ্চ আদালতে রিট করার কথা জানান তিনি।
বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রতি কেজি ইলিশ রফতানিতে দাম ধরা হয় গড়ে দশ ডলার। গত রোববার থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক রফতানির ক্ষেত্রে এক ডলারের দাম ৯৯ টাকা করেছে। আবার খোলাবাজারে ডলারের দর ১০৭ টাকা। সে হিসেবে প্রতি কেজি ইলিশ রফতানি হচ্ছে গড়ে ৯৯০ টাকা থেকে ১ হাজার সত্তর টাকার মধ্যে।
জেলেরা বলছেন, উপকূলের বদলে ইলিশ মিলছে গভীর সমুদ্রে। আগে যেখানে উপকূলে জাল ফেললেই তাদের নৌকার গলুই ভরে উঠতো ইলিশে, সেখানে এখন ইলিশ ধরতে তাদের যেতে হয় গভীর সমুদ্রে। সমুদ্রে থাকতেও হচ্ছে বেশি সময়। ফলে বেড়ে যাচ্ছে মাছ ধরার নৌকার জ্বালানি, মাল্লাদের মজুরিসহ অন্যান্য খরচ। সমুদ্রে মাছ ধরার ট্রলারগুলোর ইঞ্জিনগুলো চলে ডিজেলে। সম্প্রতি দেশে ডিজেলসহ জ্বালানির দাম বাড়ানো হয়েছে। অতিরিক্ত খরচ যোগ হচ্ছে ভোক্তা পর্যায়ে ইলিশের দামে।
নয়া শতাব্দী/এফআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ