ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা অনুসরণ ও অনুশীলন আবশ্যক

প্রকাশনার সময়: ০৮ আগস্ট ২০২১, ০৪:৫৯

জনশ্রুতি মতে, করোনা অতিমারির এই দুঃসময়েও সীমাহীন সংক্রমণ আতঙ্ক ও বিপুলসংখ্যক প্রাণ সংহারের দৃশ্য হিংস্র রক্তপ্রবাহে বেড়ে ওঠা দানবরূপী মানুষদের দৃষ্টিভঙ্গিকে ন্যূনতম নাড়া দিতে পেরেছে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। করোনায় দরিদ্র-নিম্নবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জীবন-জীবিকাকে চরম দুর্ভোগ ও কঠিন সংকটের সম্মুখীন করেছে। করোনা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় পরিষেবা, টিকা ও অক্সিজেন সরবরাহ এবং আনুষঙ্গিক বিষয় বিশ্লেষণে এটি প্রতীয়মান হয় যে, মানবিকতাণ্ডমনুষ্যত্বের যথার্থ উজ্জীবন সমাজকে এখনও পরিশুদ্ধ করতে পারেনি।

মজুদদার, মুনাফাখোর, ঘুষখোর সিন্ডিকেটেড দুর্বৃত্তায়নের বেড়াজাল থেকে জনগণকে মুক্ত করার সব সরকারি- বেসরকারি উদ্যোগ পরিপূর্ণ সাফল্যের দৃষ্টান্ত স্থাপনে অনেকটাই ব্যর্থ। অর্থ, ক্ষমতা, আধিপত্য, ঘুষ-দুর্নীতি, কদাচার-পাপাচার, প্রতারণা ও জালিয়াতির নানামুখী কুকর্মে ব্যক্তিস্বার্থ সিদ্ধির কূটকৌশল অবলম্বন ও অধিকতর সমাজবিধ্বংসী বেপরোয়া মনোভাব সর্বত্রই দৃশ্যমান।

অনৈতিক ও অবৈধ পন্থায় উপার্জিত অর্থকে বৈধতা দানের অপসংস্কৃতি, নীতি- নৈতিকতাহীন অর্থ-প্রতিপত্তির দাপটে পুরো সমাজকে কলুষিত করার অপকৌশল, নিরপরাধকে অপরাধী বা অপরাধীকে নিরপরাধ করার নিকৃষ্টতম পন্থার আশ্রয় কোনোভাবেই সভ্য সমাজের পরিচায়ক হতে পারে না। আইনের শাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে এসব কদর্য চরিত্রের মানুষকে বৃহত্তর সুশীল জনগোষ্ঠী ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করলেও অদৃশ্য-অজানা উঁচু মার্গের পৃষ্ঠপোষকতায় সমাজকে কলঙ্কিত করার দুর্ভেদ্য অন্তরায়-পরিপ্রেক্ষিত নির্মিত হয়েছে। এদের কুকর্ম-কুপ্রবৃত্তি থেকে নিবৃত্ত করার জন্য দৃঢ়চেতা ও দেশপ্রেমী তরুণ প্রজন্মের সম্মিলিত উদ্যোগ অনিবার্য হয়ে পড়েছে।

প্রাসঙ্গিকতায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রকঠিন নির্দেশগুলো নতুন করে জাতিকে জাগ্রত করার লক্ষ্যে নিবিড় অনুসরণ ও অনুশীলন আবশ্যক। ১৯৭৫ সালের ১৫ জানুয়ারি রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের প্রথম পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘জীবন অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। এই কথা মনে রাখতে হবে। আমি আর আপনার মৃত্যুর পর সামান্য কয়েক গজ কাপড় ছাড়া সঙ্গে আর কিছুই নিয়ে যাব না। তবে কেন আপনারা মানুষকে শোষণ করবেন, মানুষের ওপর অত্যাচার করবেন? গরিবের ওপর অত্যাচার করলে আল্লাহর কাছে তার জবাব দিতে হবে। তাই শুধু আপনারা নন, সমস্ত সরকারি কর্মচারীকেই আমি অনুরোধ করি, যাদের অর্থে আমাদের সংসার চলে, তাদের সেবা করুন। যাদের জন্য, যাদের অর্থে আজকে আমরা চলছি, তাদের যাতে কষ্ট না হয়, তার দিকে খেয়াল রাখুন। যারা অন্যায় করবে, আপনারা অবশ্যই তাদের কঠোর হস্তে দমন করবেন। কিন্তু সাবধান, একটা নিরপরাধ লোকের ওপর যেন অত্যাচার না হয়। তাতে আল্লাহর আরশ পর্যন্ত কেঁপে উঠবে। আপনারা সেই দিকে খেয়াল রাখবেন।’

আগস্ট মাসের শোকাবহ অবগাহন বিশ্বব্যাপী বাঙালির হৃদয় গভীরে বিউগলের করুণ সুরের মতো শুধু আর্তনাদের অনুরণন সৃষ্টি করে না, বেদনাহত মানবিক চেতনায় প্রতিশোধ পরায়ণতা নির্বাণ করে দেশকে এগিয়ে নেয়ার স্বপ্নকে সমধিক অত্যুজ্জ্বল করে তোলে। শোকে মুহ্যমান জাতি সভ্যতার নিকৃষ্টতম কলঙ্কের উপমা সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতবরণের নির্মম অধ্যায়কে অপ্রতিরোধ্য শক্তিমানতায় দুর্জয় চেতনার কঠিন ব্রত গ্রহণ করে থাকে।

১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পথে দিল্লিতে ভারতবাসীর উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলাদেশ যাওয়ার পথে আমি আপনাদের মহতী দেশের ঐতিহাসিক রাজধানীতে যাত্রাবিরতি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি এ কারণে যে, আমাদের জনগণের সবচেয়ে বড় বন্ধু ভারতের জনগণ এবং আপনাদের মহীয়সী প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। যিনি কেবল মানুষের নয়, মানবতারও নেতা। তার নেতৃত্বাধীন ভারত সরকারের কাছে এর মাধ্যমে আমি আমার ন্যূনতম ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারব। এই অভিযাত্রা সমাপ্ত করতে আপনারা সবাই নিরলস পরিশ্রম করেছেন এবং বীরোচিত ত্যাগ স্বীকার করেছেন। এ অভিযাত্রা অন্ধকার থেকে আলোয়, বন্দিদশা থেকে স্বাধীনতায়, নিরাশা থেকে আশায় অভিযাত্রা।’

ভাষণে বঙ্গবন্ধু আরো বলেন, ‘অবশেষে আমি ৯ মাস পর আমার স্বপ্নের দেশ সোনার বাংলায় ফিরে যাচ্ছি। এ ৯ মাসে আমার দেশের মানুষ শতাব্দীর পথ পাড়ি দিয়েছে। আমাকে যখন আমার মানুষের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল তখন তারা কেঁদেছিল; আমাকে যখন বন্দি করে রাখা হয়েছিল তখন তারা যুদ্ধ করেছিল, আর আজ যখন আমি তাদের কাছে ফিরে যাচ্ছি তখন তারা বিজয়ী। আমি ফিরে যাচ্ছি তাদের নিযুত বিজয়ী হাসির রৌদ্রকরে। আমাদের বিজয়কে শান্তি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করার যে বিরাট কাজ এখন আমাদের সামনে, তাতে যোগ দেয়ার জন্য আমি ফিরে যাচ্ছি আমার মানুষের কাছে। আমি ফিরে যাচ্ছি আমার হৃদয়ে কারও জন্য কোনো বিদ্বেষ নিয়ে নয়, বরং এ পরিতৃপ্তি নিয়ে যে, অবশেষে মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের, অপ্রকৃতিস্থতার বিরুদ্ধে প্রকৃতিস্থতার, ভীরুতার বিরুদ্ধে সাহসিকতার, অবিচারের বিরুদ্ধে সুবিচারের এবং অশুভের বিরুদ্ধে শুভের বিজয় হয়েছে।’ মানব সভ্যতার যুক্তি-জ্ঞাননির্ভর জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সুমহান অর্জন হিসেবে শুধু স্বাধীনতাকে বাচনিক মহিমান্বিত নয়; কার্যকর অর্থবহ করার উদ্দেশ্যগুলো বঙ্গবন্ধুর এই অমূল্য ভাষণে প্রতিফলিত হয়েছে।

১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশরা কেবল ভারতকেই বিভক্ত করেনি, বাংলাকেও দ্বিখ-িত করেছে। পাকিস্তান সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে পূর্ব বাংলার সমগ্র নাগরিককে পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে নির্যাতন, নিপীড়ন, বৈষম্যের পরাকাষ্ঠায় নিপতিত হতে হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পেছনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুসহ পূর্ব বাংলার অবিসংবাদিত নেতৃবৃন্দের বিশাল অবদানের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করা। কিন্তু স্বল্প সময়ের মধ্যে পূর্ব বাংলার মানুষ উপলব্ধি করতে পেরেছিল তারা নতুন এক আন্তঃঔপনিবেশিক বেড়াজালে বন্দি হয়ে পড়েছে। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থের ২০৯ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘রাজনৈতিক কারণে একজনকে বিনা বিচারে বন্দি করে রাখা আর তার আত্মীয়স্বজন, ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে দূরে রাখা যে, কত বড় জঘন্য কাজ তা কে বুঝবে? মানুষ স্বার্থের জন্য অন্ধ হয়ে যায়। আজ দুশ’ বছর পরে আমরা স্বাধীন হয়েছি। সামান্য হলেও কিছুটা আন্দোলনও করেছি স্বাধীনতার জন্য। ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাস আজ আমাকে ও আমার সহকর্মীদের বছরের পর বছর জেল খাটতে হচ্ছে। আরো কতকাল খাটতে হয়, কেই-বা জানে? একেই কি বলে স্বাধীনতা? ভয় আমি পাই না, আর মনও শক্ত হয়েছে। যে পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিলাম, সেই পাকিস্তানই করতে হবে, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম।’

বিচিত্র অভিজ্ঞতায় পূর্ববাংলা গণমানুষের কাতরতা ও যন্ত্রণাদগ্ধ বঙ্গবন্ধুর চেতনাকে কতটুকু এবং কীভাবে নানামুখী প্রশ্নবিদ্ধ করেছে তার বক্তব্য থেকে তা অতি সহজবোধ্য। তিনি বলেছেন, ‘গোপালগঞ্জ মহকুমার যে কেউ আসে, তাদের এক প্রশ্ন, ‘আপনাকে কেন জেলে নেয়? আপনিই তো আমাদের পাকিস্তানের কথা শুনিয়েছেন’; আবার বলে, ‘কত কথা বলেছিলেন, পাকিস্তান হলে কত উন্নতি হবে। জনগণ সুখে থাকবে, অত্যাচার-জুলুম থাকবে না। চালের দাম কত বেড়ে গেছে।’ কী উত্তর দেব! এরা সাধারণ মানুষ। কী করে এদের বোঝাব! গ্রামের অনেক মাতবর শ্রেণির লোক আছেন, যারা বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান। কথা খুব সুন্দরভাবে বলতে পারেন। এক কথায় তো বোঝানোও যায় না। পাকিস্তান খারাপ না, পাকিস্তান তো আমাদেরই দেশ। যাদের হাতে ইংরেজ ক্ষমতা দিয়ে গেছে, তারা জনগণের কী করে উন্নতি করা যাবে, সেদিকে ক্ষমতাসীনদের খেয়াল নাই।’ এতসব নিপীড়ন-নিবর্তনের কুৎসিত কর্মকৌশল অচিরেই বাঙালি বোধগম্য হয়। নির্মম বৈষম্যের প্রারম্ভেই রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে নিয়ে তাদের কদর্য ষড়যন্ত্র উন্মোচিত হলে পূর্ব বাংলার মানুষ তা রুখে দিতে প্রতিরোধ-আন্দোলন-ত্যাগের নতুন ধারায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।’

পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, বুড়িগঙ্গা, সুরমা, শীতলক্ষ্যা ও কর্ণফুলীর অববাহিকায় সুদীর্ঘ লালিত ও প্রাণস্পন্দনে পরিশীলিত হাজার বছরের ভাষা-কৃষ্টি-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির প্রতি ন্যূনতম অবজ্ঞা বাঙালি জাতি মেনে নেয়নি। আবহমান বাংলার শাশ্বত ও সাবলীল মৌলিকত্বে কুঠারাঘাত করার সব অপচেষ্টা নস্যাৎ করার জন্য দৃঢ়চেতা বাঙালি জাতি সাগর-মহাসাগরের উত্তাল তরঙ্গের মতো গর্জে উঠেছিল। ১৯৫২ সালের মহান আত্মবিসর্জনের স্বাক্ষরে গ্রন্থিত করেছিল মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার বিশ্বে অতুলনীয় গৌরবদীপ্ত ইতিহাস। ধারাবাহিকতায় প্রবহমান অন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের নবতর উন্মেষ রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রধান অনুষঙ্গ স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত হয়। মূলত বঙ্গভঙ্গের আড়ালে সম্পূর্ণ দুটি ভিন্ন ভাষাভাষী-মতাদর্শের জনগোষ্ঠীকে ব্রিটিশরা তাদের শাসন-শোষণের চিরস্থায়ী করার যে, অপকৌশলের আশ্রয় নিয়েছিল; তা অচিরেই ব্যর্থতার পরিহাসে পর্যবসিত হয়। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে উজ্জীবিত বাঙালি জাতি মুক্তির মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যগাথায় বিশ্বমানচিত্রে লাল-সবুজের পতাকার বাংলাদেশকে প্রাণ-বিসর্জনের সর্বোচ্চ মাত্রিকতায় অধিষ্ঠিত করে।

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ভাষণগুলোর প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু প্রণিধানযোগ্য এবং বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে এই সংকট মোকাবিলায় অপরিসীম প্রয়োজনীয়তা অনুধাবনে আশা করি জাতি কখনো পিছপা হবে না। দেশের সম্পদ সুরক্ষায় এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে দেশকে স্বয়ং সম্পূর্ণ স্বনির্ভর করার নিবিড় সতর্ক উচ্চারণ এখনো জাতিকে পথ দেখানোর সর্বোৎকৃষ্ট প্রণোদনাময় অভিব্যক্তি। এরই আলোকে স্মরণযোগ্য বিষয় হচ্ছে, প্রকৃত মানবসম্পদ বা সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য নির্মোহ-যোগ্য-মেধাবী- দেশপ্রেমী সোনার মানুষগুলোকে যথাযোগ্য মূল্যায়নে যথাস্থানে প্রতিষ্ঠিত করা না হলে জাতি শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হবে না; ভবিষ্যৎকে আলোকময় করার সব সৎ উদ্যোগও বিফলে যাবে।

লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

নয়া শতাব্দী/এসএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ