ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কূটনৈতিক পাড়ায় দৌড়ঝাঁপ

প্রকাশনার সময়: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৮:০৪

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সরকার পতনে বড় আন্দোলন গড়ে তোলার পাশাপাশি কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করার চেষ্টায় রয়েছে মাঠের প্রধান বিরোধী দল-বিএনপি। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়ে রেখেছে ‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার’ বা ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ছাড়া কোনো নির্বাচনে যাবে না। এই দাবি আদায়ে আন্দোলনের পাশাপাশি বিদেশি বন্ধুরাষ্ট্রের সমর্থন আদায়ের দিক থেকে এগিয়ে থাকতে চায় বিএনপি। এজন্যই এবার বেশ আগেই দেশে অবস্থানরত প্রভাবশালী রাষ্ট্রের কূটনীতিকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা।

জ্বালানি তেল ও নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং পুলিশের গুলিতে তিন নেতা মৃত্যুর প্রতিবাদে নানামুখী কর্মসূচি নিয়ে মাঠে রয়েছে। সম্প্রতি মিছিল-সমাবেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হামলা-মামলা এবং সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা তুলে ধরছে বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে। সেই সঙ্গে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ব্রিটেনসহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক শক্তির সহায়তায় বাংলাদেশে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে চায় বিএনপি। এমন প্রেক্ষাপটে বিদেশি দূতাবাসগুলোতে আনাগোনা বেড়েই চলছে। সম্প্রতি কূটনৈতিকপাড়ায় বিএনপির হঠাৎ দৌড়ঝাঁপ রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ চাঞ্চল্যকর সৃষ্টি করেছে।

জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার কানাডিয়ান পলিটিক্যাল কাউন্সিলর ব্রেডলি কোটসের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপি। এর আগের দিন ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটার্টন ডিকসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্ব একটি প্রতিনিধি দল। তার আগে জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াটলি এবং বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক জিন লুইসের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ। এরও আগে ফেব্রুয়ারি মাসে বেশ কয়েকটি দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছে দলটি। বিএনপি মহাসচিব ছাড়াও স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ, তাবিথ আউয়াল অংশ নেন। তবে এই বৈঠকে কী কী আলোচনা হয়েছে এ বিষয়ে মুখ খুলছেন না কোনো পক্ষই।

দলীয় সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক উত্তেজনা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, নির্বাচনে বিএনপির আসা না আসা নিয়ে ধোঁয়াশার পরিপ্রেক্ষিতে গত কয়েকদিন ধরেই ঢাকায় আন্তর্জাতিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসছে বিএনপি। এসব বৈঠকে গত কিছুদিন ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে দলীয় নেতাকর্মীদের মৃত্যু, হামলা-মামলার বিষয়টি কূটনীতিকদের সামনে তুলে ধরেছেন দলটির নেতারা। গত বুধবার ব্রিটিশ হাইকমিশনের ভেরিফায়েড ফেসবুকে এক পোস্টে নিহত-হামলা ও মামলায় উদ্বেগও প্রকাশ করেছে।

ব্রিটিশ হাইকমিশনের ভেরিফায়েড ফেসবুক পোস্টে বলা হয়, বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ততা আমাদের কূটনৈতিক উপস্থিতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পোস্টে হাইকমিশন একই সঙ্গে সহিংসতা এড়িয়ে শান্ত থাকা, ধৈর্য ধরা এবং সংলাপের পথ বেছে নেয়ার জন্য সব দলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দলটির এ ধরনের তৎপরতা নিয়ে দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কোনো কোনো মহল মনে করছে, বিএনপির চলমান নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবির আন্দোলনের অংশ হিসেবেই এই তৎপরতা চালাচ্ছে। কারণ দীর্ঘদিন ধরে রাজপথে আন্দোলন করার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হয়েছে। মুখে যাই বলুক না কেন সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এক ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। যা এই দৌড়ঝাঁপের মধ্য দিয়ে প্রতীয়মান হচ্ছে।

এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) একে মোহাম্মদ আলী শিকদার বলেন, আগামী নির্বাচনে না গেলে বিএনপির মাঠে দাঁড়ানো আরো কঠিন হবে। সরকারের রোষানলে পড়ে হামলা ও মামলা পরিমাণও বাড়বে। তাই সংসদ নির্বাচন বিএনপির জন্য আবশ্যকীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর সেজন্য আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু আর নিরপেক্ষ করতে কূটনৈতিকপাড়ার সমর্থন চায় দলটি। তাদের চাওয়া— প্রথমত ‘নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন’। তা না হলে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেও সুষ্ঠু ভোট হবে না। আর এ কারণেই দলটির নেতাকর্মীরা নিয়মিত দূতাবাসগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে বলে ধারণা।

বৈঠকে অংশ নেয়া নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সদস্য বলেন, কানাডিয়ান পলিটিক্যাল ব্রেডলি কোটস ও ব্রিটিশ হাইকমিশনারকে জানিয়েছেন, বিএনপি জনসম্পৃক্ত ইস্যুতে কর্মসূচি পালন করছে। সরকারি দল ও পুলিশ তাদের কর্মসূচিতে বিনা উসকানিতে হামলা চালাচ্ছে। বিএনপি নেতাদের বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা করছে। অন্যদিকে, বিএনপির আহত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধেই পুলিশ মামলা দিচ্ছে। আগামী নির্বাচনের আগে এ ধরনের হামলা আরও বাড়বে বলে দলের পক্ষ থেকে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। তারা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারা সচল রাখা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য নিরসনে আলোচনার ওপর জোর দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

জানতে চাইলে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির সদস্য শামা ওবায়েদ বলেন, এক মাস আগে কানাডিয়ান পলিটিক্যাল কাউন্সিলর ব্রাডলি কোটস নিযুক্ত হয়েছেন। তিনি এসেছিলেন সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে। বৈঠকে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সারাদেশে বিএনপির ওপর যে দমনপীড়ন চলছে তা তিনি জানতে চেয়েছেন এবং দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা হয়েছে।

সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির এ কূটনৈতিক তৎপরতা কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, গত বুধবার আমরা ব্রিটিশ হাইকমিশনারের আমন্ত্রণে সেখানে গিয়েছিলাম। আর আমাদের কূটনৈতিক কার্যক্রম সবসময় চলমান। সেটা সব রাজনৈতিক দলই করে থাকে। তবে সে কার্যক্রম অনেক সময় দেখা যায়, আবার অনেক সময় দেখা যায় না।

জানতে চাইলে বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র নেই। আইনের শাসন ও মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নেই। মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে, গুম-খুন হত্যা হচ্ছে। এসব কিন্তু কোনো অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়, আন্তর্জাতিক বিষয়। সারাবিশ্ব এসব অবগত। বিশ্বের যে কোনো শক্তি এবং বাংলাদেশের ভেতরে ও বাইরের আন্তর্জাতিক সংগঠন যারা গণতন্ত্রের পক্ষে, মানবাধিকারের পক্ষে, সুশাসনের পক্ষে, তারা বাংলাদেশে যা চলছে তা সম্পর্কে সবই অবগত। বিএনপির সঙ্গে সবার যোগাযোগ আছে। কারণ এটি করা বিএনপির নৈতিক দায়িত্ব। যারা অবগত, এ নিয়ে কাজ করে তাদের সঙ্গে অব্যাহতভাবে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে এবং থাকবে।

বিএনপি সূত্র জানায়, বর্তমান অবস্থায় শুধু মাঠের আন্দোলন দিয়ে সরকারের কাছ থেকে দাবি আদায় করা ও রাজনৈতিক পরিবর্তন সম্ভব নয়। এজন্য মাঠের আন্দোলনের পাশাপাশি কূটনৈতিক তৎপরতাকে সমান গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। লক্ষ্য— সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি আদায়ে সরকারের ওপর নানামুখী আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ানো। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র চাইলে বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে। তাই বিএনপির সংশ্লিষ্ট উইংগুলো আন্তর্জাতিক মহলের সঙ্গে যোগাযোগও বাড়িয়ে দিয়েছে।

নয়া শতাব্দী/জেআই

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ