ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

হুন্ডিকাণ্ডে জড়িতরা চিহ্নিত!

প্রকাশনার সময়: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২২, ২৩:৫১

হুন্ডিকাণ্ডে জড়িত সাড়ে ৫ হাজার এজেন্ট নাম্বারধারীদের ধরতে মাঠে নেমেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এসব নাম্বারে ১ লাখ ৮১ হাজারটি সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছে বলে বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ)-এর তদন্তে উঠে এসেছে। ওইসব নাম্বরের সহায়তায় সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী প্রবাসীরা টাকা পাঠাচ্ছেন। নাম্বারগুলোর বেশিরভাগই বিকাশ, নগদ, রকেট ও উপায়ের নামে নিবন্ধিত। এতে প্রবাসীদের অর্থ বৈদেশিক মুদ্রায় দেশে আসছে না। ফলে রেমিট্যান্স হারাচ্ছে সরকার। এমন পরিস্থিতিতে অবৈধ এসব হুন্ডি নাম্বার ব্যবহারকারীকে ধরতে মাঠে নেমেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

জানা গেছে, গত এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত ১ লাখ ৮১ হাজার ৫০৫টি সন্দেহজনক লেনদেন চিহ্নিত করে বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ)। এসব নম্বরের মোট লেনদেনের ৯০ শতাংশ বা তার বেশি শুধু ‘ক্যাশ ইন’ হয়েছে। মোট লেনদেনের ৯০ শতাংশের বেশি ‘ক্যাশ আউট’ হয়েছে। রাত ২টা থেকে ভোর ৬টার মধ্যে প্রতি মিনিটে চারটি বা তার বেশি ‘ক্যাশ ইন’ হয়েছে। এভাবে বিকাশের ৬৯ হাজার ৬১৩টি, উপায়ের ৩৮ হাজার ৮৩৫টি, রকেটের ৩৮ হাজার ৩৫৮টি এবং নগদের ৩৪ হাজার ৩৫৮ এজেন্টকে প্রাথমিকভাবে সন্দেহজনক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এরপর সংশ্লিষ্ট মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) প্রতিষ্ঠানের কাছে এসব এজেন্টের তথ্য দিয়ে অধিকতর বিশ্লেষণ করে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। সে আলোকে ৫ হাজার ৮৯ জনের এজেন্টশিপ বাতিল করেছে প্রতিষ্ঠানগুলো। এর বাইরে অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত আরও ৩৩০টি এজেন্টের এজেন্টশিপও বাতিল করা হয়েছে। এরপর সব মিলিয়ে বাতিল হওয়া ৫ হাজার ৪১৯ এজেন্টের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সিআইডিতে তথ্য দেয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের ইকোনমিকস ক্রাইম স্কোয়াডের বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির বলেন, হুন্ডি রোধে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ আগে থেকেই কাজ করছিল। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের বিএফআইইউ শাখা থেকে একটি প্রতিবেদন পাওয়া গেছে। এতে সিআইডির কাজ আরো সহজ হয়েছে। সন্দেহজনক এজেন্টের বিষয়ে প্রাথমিক অনুসন্ধান চলছে। তদন্তে বেশকিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে। এখন জড়িতদের ধরতে মাঠে নামবে পুলিশ।

জানা গেছে, ডিজিটাল হুন্ডির কবলে পড়ে বৈধপথে কমছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। হুন্ডি কারবারিরা এর জন্য মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) প্ল্যাটফর্মকে বেছে নিয়েছে। কিছু অসাধু এজেন্ট এ অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। এর ফলে প্রবাসে বাংলাদেশি জনশক্তি রফতানি বাড়লেও দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আসার পরিমাণ কমে গেছে। বিষয়টি আমলে নিয়ে তদন্তে নামে বিএফআইইউ। দীর্ঘ তদন্তে তারা জানতে পারে, অবৈধ গেমিং, বেটিং বা জুয়া এবং অনলাইনে বৈদেশিক মুদ্রার বাণিজ্যের মাধ্যমে পাচার হচ্ছে নগদ ডলার। আর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিং।

সূত্রমতে, প্রবাসীদের কাছ থেকে অবৈধভাবে বিকাশ, নগদসহ বিভিন্ন এমএফএস প্রতিষ্ঠানের নামে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করছে একটি চক্র। হুন্ডি চক্রের সদস্যরা বাংলাদেশি এজেন্টের কাছে অ্যাপ বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রবাসীদের সুবিধাভোগীর এমএফএস অ্যাকাউন্ট নম্বর ও টাকার পরিমাণ উল্লেখ করে এসএমএস পাঠাচ্ছে। এখানকার এজেন্ট সুবিধাভোগীর নম্বরে ক্যাশ ইন করে দিচ্ছে। এতে করে প্রবাসীদের অর্থ বৈদেশিক মুদ্রায় দেশে আসছে না। বিষয়টি অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসার পর বিদেশে অবস্থানরত এমএফএস প্রতিষ্ঠনগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে বিএফআইইউ। অন্যদিকে, অনলাইন গেমিং, বেটিং, ক্রিপ্টোট্রেডিং বা অনলাইন ফরেক্স ট্রেডিংয়ের ক্ষেত্রে এমএফএস এবং কিছু ক্ষেত্রে ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করা হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় কিছু অসাধু এমএফএস এজেন্টের কাছে এসে ‘ক্যাশ আউট’ করে খোলাবাজার থেকে ডলার কিনে ওইসব অনলাইন সাইটের পরিচালনাকারীদের কাছে পাচার হচ্ছে। এ ধরনের বেশিরভাগ সাইট ভারত ও চীন থেকে পরিচালিত হচ্ছে। তাদের সহযোগিতা করছে দেশের মোবাইল ব্যাংকিংগুলো।

এ বিষয়ে বিকাশের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কাউকে ফোনে পাওয়া যায়নি। তবে নগদের হেড অব কমিউনিকেশন মুহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম সজল বলেন, ডিজিটাল হুন্ডির বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার রয়েছে নগদ। সর্বোচ্চ সতর্কতার মাধ্যমে যে কোনো সন্দেহজনক লেনদেন প্রতিরোধে আমরা বদ্ধপরিকর। লেনদেনে অস্বাভাবিকতা পাওয়া গেলেই সঙ্গে সঙ্গে বিএফআইইউতে সন্দেহজনক লেনদেন রিপোর্টিং (এসটিআর) করা হয়।

বিএফআইইউর প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, সন্দেহভাজন লেনদেনগুলো বেশিরভাগই ঘটেছে গভীর রাতে। এবং ক্যাশ আউট হয়েছে দিনের বেলায়। সাধারণত প্রবাসীরা টাকা পাঠাতে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসকে (এমএফএস) বেছে নিয়েছে। আর ওই প্রতিষ্ঠানগুলো টাকা পাঠানোর জন্য গভীর রাতকে বেছে নিয়েছে। তারা টাকা পাঠানোর পর সুবিধামতো সময়ে গ্রাহক তার টাকা তুলে নিয়েছেন। আর এ কারণে সম্প্রতি রাত ১২টার পর টাকা লেনদেন বন্ধ করে দিয়েছে মোবাইল ব্যাংকিংগুলো। তবে ব্যক্তিগত নম্বরে টাকা লেনদেন স্বাভাবিক রয়েছে। এ কারণে রাতে ব্যক্তিগত নম্বরে অস্বাভাবিক লেনদেন চোখে পড়তে তাৎক্ষণিক তা জানানোর জন্য মোবাইল ব্যাংকিংয়ে যুক্তদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

সিআইডির একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হুন্ডি চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন এমএফএসের এজেন্টশিপ নিয়েছে। তাদের কাছে বিদেশ থেকে শুধু টাকার পরিমাণ ও নম্বর উল্লেখ করে নির্দেশনা আসে। সে আলোকে সুবিধাভোগীর নম্বরে এখান থেকে অর্থ পরিশোধ হয়। দ্রুততম সময়ে সুবিধাভোগীর নম্বরে টাকা পৌঁছে দেয়া হয়। সাধারণত এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের সার্ভিস চার্জ নেয় না হুন্ডি কারবারিরা। ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাঠাতে যেখানে গড়ে ৪ শতাংশের মতো খরচ হয়, আবার ব্যাংকিং চ্যানেলের তুলনায় দর বেশি দেয়া হয়। হুন্ডি কারবারিদের আউটলেট বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিদেশে বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকার কাছে থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা বাসা থেকে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে আসে। কখনও কখনও প্রবাসীর পক্ষে অগ্রিম অর্থ পাঠিয়ে দেয়। এ রকম নানা সুবিধার কারণে হুন্ডিতে ঝুঁকছেন অনেকে।

সিআইডির একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বিএফআইইউর কাছ থেকে তালিকা পাওয়ার পর তারা মাঠে নেমে সত্যতা পান। এরপর অনেককেই ডেকে পাঠানো হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, যে নামে এজেন্টশিপ দেয়া হয়েছে তার কোনো অস্বিত্ব নেই। সাধারণত একটি প্রতিষ্ঠানের নামে এজেন্ট দেয়ার কথা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে মুরগি ব্যবসায়ীর কাছেও এজেন্ট নম্বরের অস্বিত্ব পাওয়া গেছে। এ কারণে সবাইকে আইনের আওতায় আনতে বেগ পেতে হচ্ছে। তবে তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। জড়িত রাঘব বোয়ালরা এখন সিআইডির জালেই রয়েছে। যে কোনো সময় তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হবে। এক্ষেত্রে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে যুক্ত জেলা পর্যায়ের কিছু কর্মকর্তারও সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। তারাও রয়েছে সিআইডির নজরদারিতে।

উল্লেখ্য, ২০২১-২২ অর্থবছরে ব্যাংকিং চ্যানেলে ২ হাজার ১০৩ কোটি ডলার সমপরিমাণ অর্থ পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। আগের অর্থবছরের তুলনায় যা ৩৭৫ কোটি ডলার বা ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ কম। অথচ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের হিসাবে গত বছর ৬ লাখ ৩০ হাজার শ্রমিক বাইরে গেছেন। চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসেই বিদেশে গেছেন আরও ৬ লাখ ৫০ হাজার শ্রমিক। এরপরও রেমিট্যান্স কমার বিষয়টি আশঙ্কাজনক। বিষয়টি আমলে নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে বিএফআইইউ।

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ