মুচলেকা দিয়ে প্যারোলে মুক্তি নিয়ে আইয়ুব খানের ডাকা গোল টেবিল বৈঠকে যোগ দেয়ার ব্যাপারে দলের কতিপয় নেতার নেয়া সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করে কারাবন্দী বঙ্গবন্ধুর কাছে বার্তা পাঠিয়েছিলেন বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।
আরো পরে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সমঝোতা করলে তার সামরিক বাহিনী তাদের সুবিধামত যে কোন সময়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করবে বলে বঙ্গবন্ধুকে সাবধান করে দিয়েছিলেন বেগম মুজিব। একাত্তরের ৭ মার্চের ভাষণের আগেও বঙ্গবন্ধুকে অনেকে অনেক রকম পরামর্শ দিলেও সঠিক পরামর্শটি দিয়েছিলেন তাঁর সহধর্মিনীই। তিনি বঙ্গবন্ধুকে একটি কথাই বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু যেন তার নিজের মনে যা আছে তা-ই ওই ভাষণে বলেন।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকাকালীন মুচলেকা দিয়ে প্যারোলে মুক্ত হয়ে আইয়ুব খানের ডাকা গোল টেবিল বৈঠকে যোগ দেয়া সর্ম্পকিত দলের কতিপয় নেতার সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করে বঙ্গবন্ধুর কাছে বার্তা পাঠিয়ে অসাধারণ রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দেন বঙ্গমাতা।
বঙ্গবন্ধুকে পরিষ্কার জানিয়ে দেন, তিনি হাতে বঁটি নিয়ে বসে আছেন, প্যারোলে মুচলেকা দিয়ে আইয়ুবে দরবারে যেতে পারেন, কিন্তু জীবনে ৩২ নম্বরে যাতে না আসেন বঙ্গবন্ধু।
প্রয়াত সাংবাদিক এবং লেখক এবিএম মুসা তার ‘মুজিব ভাই’ গ্রন্থে এ ব্যাপারে লিখেন, শেখ মুজিব যদি মুচলেকা দিয়ে সহবন্দিীদের ক্যান্টনমেন্টে রেখে রাওয়াল পিণ্ডি যেতেন তবে এদেশের ভবিষ্যত ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো।
এবিএম মুসা লিখেছেন, ঢাকা সেনানিবাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচার চলছে। সাল ১৯৬৯। গণ- অভ্যুত্থানে বিধ্বস্ত ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান গোল টেবিল বৈঠক ডাকলেন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের অবিসংবাদী নেতা শেখ মুজিবকে বাদ দিয়ে গোল টেবিল বৈঠক হয় কী করে ? শেষ পর্যন্ত আইয়ুব খান বৈঠক সফল করতে রাজনৈতিক নেতাদের চাপে বাধ্য হলেন কারাবন্দী শেখ মুজিবুর রহমানকে আমন্ত্রণ জানাতে। কিন্তু দেশদ্রোহের দায়ে বিচারের আসামি, ক্যান্টনমেন্টে বন্দি, আসবেন কিভাবে? অবশেষে আইয়ুব খান সিদ্ধান্ত নিলেন প্যারোলে মুক্তি দিয়ে তাঁকে রাওয়ালপিন্ডি নিয়ে যাওয়া হবে। ফেব্রুয়ারির ১৭ বা ১৮ তারিখ থেকে বিভিন্ন মহল শেখ সাহেবকে প্যারোলে যাওয়ার প্রস্তাব দিতে থাকে। অনেকে জেলে দেখা করে তাঁকে একই অনুরোধ করেন। এদিকে ঢাকায় তখন শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে কারফিউ ভেঙ্গে রোজ রাতে মানুষের ঢল নামছে রাস্তায়।অন্যদিকে, ক্যান্টনমেন্টে বসে শেখ সাহেব কি ভাবছেন, কেউ তা জানে না। সারা দেশের মানুষও কিছুটা বিভ্রান্ত। তারা প্রাণ দিচ্ছেন, রক্ত দিচ্ছেন প্রিয় নেতাকে মুক্ত করে আনার জন্য। মুচলেকা দিয়ে আইয়ুবের দরবারে যাওয়ার জন্য নয়। কিন্তু এব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিবেন যিনি, তিনিও ছিলেন দ্বিধাগ্রস্ত। সেদিন, মুচলেকা দিয়ে, নাকি নিঃশর্ত মুক্তি-এই যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন একজন নারী। মুজিবের সহধর্মিণী, যিনি রাজনীতি বুঝতেন না, কিন্তু নিজের স্বামীকে জানতেন। বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর স্বামীর মানসিক দ্বন্দ্ব। বন্দি স্বামীকে খবর পাঠালেন ‘হাতে বঁটি নিয়ে বসে আছি, প্যারোলে মুচলেকা দিয়ে আইয়ুবের দরবারে যেতে পারেন, কিন্তু জীবনে ৩২ নম্বরে আসবেন না।’
আরো পরে একাত্তরের ২২ মার্চ ইয়াহিয়া খান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভুট্টোর মধ্যে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক খুব একটা ফলপ্রসূ হয়েছিল বলে মনে হচ্ছিল না। এ দিনেই সরকারের এক ঘোষণায় বলা হয় যে, পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আরো বিস্তৃত আলোচনার প্রয়োজনীয়তার কারণে ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন শুরু করার পূর্ব সিদ্ধান্ত অনির্দিষ্টকালের জন্য বাতিল করা হয়েছে। ঐসময় আভাস পাওয়া গিয়েছিল যে, ইয়াহিয়া খান কোন শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধান করতে আন্তরিক ছিলেন না।এম এ ওয়াজেদ মিয়া এ বিষয়ে তার ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ গ্রন্থে বলেন, ঐদিন দুপুরে বঙ্গবন্ধু কারো সঙ্গে কোন কথা না বলে গম্ভীরভাবে খাচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে শাশুড়ি বঙ্গবন্ধুকে বললেন, ‘এতদিন ধরে যে আলাপ আলোচনা করলে, তার ফলাফল কি হলো কিছুতো বলছো না। তবে, বলে রাখি, তুমি যদি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সমঝোতা কর, তবে, একদিকে ইয়াহিয়া খানের সামরিক বাহিনী তাদের সুবিধামত যে কোন সময়ে তোমাকে হত্যা করবে, অন্যদিকে এদেশের জনগণও তোমার উপর ভীষণ ক্ষুব্ধ হবে।’
কথা শুনে বঙ্গবন্ধু রাগান্বিত হয়ে শাশুড়িকে বললেন, ‘আলোচনা এখনও চলছে। এই মুহূর্তে সব কিছু খুলে বলা সম্ভব না।’ এই পর্যায়ে শাশুড়ি রেগে গিয়ে নিজের খাবারে পানি ঢেলে দ্রুত উপরের তলায় চলে যান। তিনি না খেয়ে সারা দিন শুয়ে থাকলেন, কারো সঙ্গে কথাও বললেন না।
৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘এ ভাষণ যখন বঙ্গবন্ধু দিতে যাবেন তখন অনেকে অনেক কিছু বলেছেন। অনেকেই অনেক পরামর্শ নিয়ে এসেছেন। কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে আছে সেদিন তাকে সঠিক পরামর্শটি দিয়েছিলেন আমার মা।’
২০১৭ সালের ১৫ মার্চ রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিতএকটি সেমিনারে এদিন মা ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের স্মৃতিচারণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রকাশ্য রাজনীতিতে কখনোই না এলেও তিনিই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার মা ঘরের ভেতরে ডেকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে একটি কথাই বলেছিলেন, তিনি যেন তার নিজের মনে যা আছে তাই ওই ভাষণে বলেন। তিনি বলেছিলেন, গোটা দেশ তার এই ভাষণের দিকে তাকিয়ে আছে। অতএব তাকে সে কথাই বলতে হবে যা বাঙালি জাতি চায়।’
শেখ হাসিনার এই বক্তব্য পরবর্তী সময়ে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের দেয়া একটি বক্তব্যেও তা প্রকাশ পেয়েছে। তোফায়েল আহমেদ সেই সময়ে খ্যাতিমান ছাত্রনেতা। তিনি ৭ মার্চের সভাস্থলেও উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, ‘৭ মার্চের আগে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি গিয়েছিলাম। একজন তাঁকে বললেন জনগণ কিন্তু সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণা ছাড়া মানবে না। বঙ্গবন্ধু তাকে বললেন, তুমি তোমার কাজ কর। আমি তাদের নেতা, আমি তাদের পরিচালিত করবো, তারা আমাকে নয়।’
শেখ হাসিনা সেদিন সেমিনারে তাঁর বক্তব্যে আরো বলেন, তাঁর মা ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের সে কথা মেনেই বঙ্গবন্ধু ওই ভাষণে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। বঙ্গবন্ধু কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতার কথাই বলেননি, বলেছিলেন এদেশের অর্থনৈতিক মুক্তির কথাও। আর সেই কারণে এ ভাষণের শেষ ওই দুটি লাইন ইতিহাস হয়ে আছে, বলেন তিনি।
তবে, ইয়াহিয়া খানকে নিয়ে বেগম মুজিবের এ আশংকায়ে অমূলক ছিল না পরবর্তী সময়ে কিন্তু তা প্রমাণ হয়েছে। পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া যখন ভুট্টোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন সেসময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসি দেয়ার আবারও প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এর আগে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায়ও বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার একটি পরিকল্পনা আঁটা হয়েছিল। বন্দিত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু প্রখ্যাত সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছিলেন। অধ্যাপক আবু সাইয়িদের বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস’ গ্রন্থে সাক্ষাৎকারটি ছাপা হয়েছে।
নয়া শতাব্দী/এসএম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ