আমদানি ব্যয় বাড়তে পারে— এমন তথ্য কাজে লাগিয়ে নাশকতাকারী একটি মহল পরিস্থিতি উস্কে দিতে পারে। এজন্য চট্টগ্রাম বন্দরের শ্রমিক, পরিবহন শ্রমিক ও বন্দরের অদূরে ইপিজেডে কর্মরত শ্রমিকদের বেছে নেয়া হতে পারে। এতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে পারে।
সম্প্রতি সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা চট্টগ্রাম বন্দরকে ঘিরে এ ধরনের আশঙ্কার কথা জানিয়ে সরকারের বিভিন্ন মহলে লিখিত বার্তা পাঠিয়েছে। সেখানে বন্দরের বিভিন্ন পরিস্থিতি তুলে ধরার পাশাপাশি ১৩টি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করে ১৯ দফা সুপারিশ করা হয়েছে।
সুপারিশে গুজবের মাধ্যমে সৃষ্ট সংকট কেউ যেন উস্কে দিতে না পারে এজন্য বন্দর এলাকা, জ্বালানি তেলের ডিপোসহ স্পর্শকাতর এলাকায় নজরদারি বাড়ানোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হলে সারাদেশে দ্রুত প্রভাব পড়ার পাশাপাশি সংকট কাটিয়ে উঠতেও সময় লাগবে বলে সরকারকে জানানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর ওই প্রতিবেদনের একটি কপি নয়া শতাব্দীর হাতে সংরক্ষিত রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, পণ্য আমদানি ও রফতানির ৯৩ শতাংশ এবং কন্টেইনার পণ্যের ক্ষেত্রে ৯৮ শতাংশ চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়। এটিকে বাংলাদেশের লাইফ লাইন বলা হয়। এটিকে ঘিরে সরকার যুগান্তকারী কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। বর্তমান বন্দরের ধারণক্ষমতা ৫৩০০০ টিইউইএস এবং দৈনিক মালামাল লোড-আনলোডের সক্ষমতা ৩৫০০ টিইউইএস। ৫৫০০ জনবলের বিপরীতে বন্দরের কন্টেইিনার জেটি আছে ১৩টি। এর মধ্যে একসঙ্গে জাহাজ ভেড়ানো যায় ১১টি। সাধারণ পণ্যের জন্য ৬টি জেটির বিপরীতেও ১১টি জাহাজ ভেড়ানো সম্ভব।
বন্দরের নিরাপত্তার জন্য নিজস্ব নিরাপত্তারক্ষী রয়েছেন ৬৫০ জন। এছাড়া ১০৫০ জন আনসার, ২০০ সেনা সদস্য, ২০ পুলিশ সদস্য (সার্বক্ষণিক সহায়তা প্রদান করে ৫৯৩ জন) ও নৌবাহিনীর এক সদস্য রয়েছে। এছাড়া বন্দরের মালামালবাহী পরিবহনের ট্রাফিক ব্যবস্থার জন্য প্রতিদিন ২০০ ট্রাফিক পুলিশ সদস্য বন্দর ও আশপাশের এলাকায় দায়িত্ব পালন করেন। তবে বন্দরের অভ্যন্তরে অন্য গোয়েন্দা সংস্থার জন্য অফিস রুম বরাদ্দ থাকলেও সিটি এসবির জন্য কোনো রুম বরাদ্দ নেই।
এ বিষয়ে বন্দরের চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করেও কোনো রুম বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। এ কারণে বন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সিটি এসবির সদস্যরা যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারছে না।
প্রতিবেদনে বিদ্যমান ১৩ চ্যালেঞ্জে বলা হয়েছে, প্রতিবছর দুই ঈদের আগে জাহাজ জট হয়। এবারো তার ব্যতিক্রম হয়নি। জাহাজ জটের কারণে আমদানিকারকদের পণ্য পেতে সময় লাগে। এ মাসের শুরুতে জাহাজ জট থাকলেও বর্তমান তা কমে এসেছে। বর্তমান পণ্য আমদানি কমতির দিকে। অথচ বছরের অন্য সময় আমদানির চাপ বেশি থাকে। সরকার বিলাসপণ্য ও অপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি নিয়ন্ত্রণ করায় আমদানি কমবে। তবে শিল্পের ও খাদ্যপণ্যের আমদানি বাড়বে। সে সময় জাহাজজটের সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রতিবেদনে পতেঙ্গা টার্মিনাল নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনা, সমন্বিত বন্দর ব্যবস্থাপনা, মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি ও রফতানির বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরার পাশাপাশি সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করা হয়েছে। সেখানে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানির বিষয়ে ধরা খাওয়ার পর ব্যবসায়ীরা সবসময় অস্বীকার করে বলে জানানো হয়। এতে বিআইএন, আইপি ও এলসি থাকলেও প্রকৃত অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে বেগ পেতে হয়।
বন্দরে মদ, সিগারেটের চালান ধরা পড়ছে। আবার অর্থ জালিয়াতির করে অনেক চালান বেরিয়ে যাওয়ারও সুযোগ রয়েছে। এভাবে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য বিপজ্জনক পণ্যের চালানও বেরিয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এছাড়া বিপজ্জনক কার্গো হ্যান্ডেলিংয়ের কথাও প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি রাসায়নিকসহ বিপজ্জনক পণ্য রফতানিও বন্ধ রয়েছে বলে গোয়েন্দাদের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
সেখানে বলা হয়েছে, শিপিং কোম্পানির অনীহার কারণে রফতানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সরকার বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যার সমাধান বাণিজ্য ও নৌ মন্ত্রণালয়ের হাতে। তারা নানা কৌশলে শিপিং কোম্পানিকে এ ধরনের কনটেইনার পরিবহনে বাধ্য করতে পারে। এছাড়া আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির কারণে বন্দরে নাশকতার সম্ভাবনা রয়েছে। নানা ধরনের পণ্য সংকট বাড়তে পারে। আর এটাকে পুঁজি করে একটি মহল পরিস্থিতি উস্কে দিতে পারে। এজন্য বন্দরের শ্রমিক, পরিবহন শ্রমিক ও ইপিজেডে কর্মরতদের ব্যবহার করা হতে পারে। তাদের মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রতিবেদনে আরো কয়েকটি বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে, সময়সাপেক্ষ রফতানি প্রক্রিয়া, সরেজমিন পরীক্ষার ক্ষেত্রে বিচ্যুতি, খাদ্য শস্য আমদানিতে অব্যবস্থাপনা, কন্টেইনার নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও অফডক ইনল্যান্ড ডিপোর বিপজ্জনক অবস্থানের বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। এ ধরনের ১৩টি বিষয়ে ১৯ দফা সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
এর মধ্যে, খাতভিত্তিক পণ্য ছাড়ে অগ্রাধিকার দেয়া, কানেকটিং পোর্ট নেটওয়ার্ক তৈরি করা, মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি ও রফতানি রোধ, বিপজ্জনক পণ্যের জোন তৈরি করা, বাণিজ্য ও নৌ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিপজ্জনক পণ্য হ্যান্ডেলিং করা, নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের গতিরোধ, রফতানি প্রক্রিয়ার গতিশীল করা, সরেজমিন পরীক্ষায় অটোমেশন, খাদ্যশস্য আমদানিতে অগ্রাধিকার, কন্টেইনার নিরাপত্তা ব্যবস্থা, বন্দর কর্তৃক অগ্রিম সিদ্ধান্ত ট্রাফিক বিভাগকে অবহিতকরণ, নীতিমালা অনুযায়ী ইনল্যান্ড ডিপো পরিচালনা, গোয়েন্দা কার্যক্রমে গতিশীলতা আনতে সিটি এসবির জন্য অফিস রুম বরাদ্দ, বন্দরে শিপ হ্যান্ডেলিংয়ে সব কোম্পানিকে সমান সুযোগ প্রদান, নোঙর অপারেটর ও সাইফ পাওয়ারটেক কোম্পানির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ রোধ, বন্দরের অনিয়ম বন্ধ, চোরাচালান তালিকাভুক্ত সিএনএফ এজেন্ট সিন্ডিকেট দমন, বন্দরের অফিসিয়াল কাজে ব্যবহূত সার্ভারের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও কাস্টম হাউস সপ্তাহের ৭ দিনই ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখার সুপারিশ করা হয়। সেখানে এসব বিষয়ে কী করণীয় সে বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে।
এর মধ্যে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড রোধে নজরদারি বাড়ানোর দরকার বলে মনে করে সংস্থাটি। পাশাপাশি বন্দরের অভ্যন্তরে বহিরাগতদের চলাচলের বিষয়ে আরো কঠোর হওয়ার তাগিদ দেয়া হয়েছে। সেখানে বহিরাগতরা প্রবেশ করে চুরিসহ নানা ধরনের অপকর্মে যুক্ত বলে তুলে ধরা হয়েছে। ২০২০ সালে চোর সন্দেহে বন্দরের অভ্যন্তরে অকশন গোলার কাছে পিটিয়ে হত্যার মতো ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু এত বছরেও বন্দরে কে যাচ্ছে, কে আসছে এবং কতক্ষণ অবস্থান করছে সে সম্পর্কে তার তথ্য কারো কাছেই থাকে না বলে উঠে এসেছে।
সেখানে বলা হয়েছে, বন্দরের অভ্যন্তরে ব্যক্তির পরিচয় নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিষয়ে এখনো তথ্যপ্রযুক্তি এবং গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমে প্রো অ্যাকটিভ ব্যবস্থা গ্রহণের সক্ষমতা অর্জন হয়নি। এ বিষয়ে সুপারিশে বলা হয়েছে, মোশন অ্যান্ড ফেস ডিটেকটিভ ক্যামেরা ও জিপিএস সংবলিত আইডি কার্ডের মধ্যে কোন ব্যক্তি কোথায় এবং কত সময় অবস্থান করছে তা নির্ণয় করা সম্ভব। প্রয়োজনে কনটেইনার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে অটো অ্যালার্ম ব্যবস্থা চালু করার কথা বলা হয়েছে।
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ