সৌদি গমনেচ্ছু বাংলাদেশি জনশক্তি ভিসা নিয়ন্ত্রণ সিণ্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। সিন্ডিকেটের কারণে তাদেরকে ভিসা নিতে মাথাপিছু ২৫০ ডলার ঘুষ দিতে হচ্ছে। ঘুষ-চাঁদা আদায়ের কৌশল হিসেবে ভিসার সংখ্যারও অস্বাভাবিকভাবে কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। দুটি রিক্রটিং এজেন্সির নেতৃত্বে ৫ সদস্যের সিণ্ডিকেট এই ঘুষ আদায় করছে। গত কয়েক মাসে এভাবে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা আদায় করেছে চক্রটি। যার পুরোটাই বিদেশে পাচার হয়েছে। এ বিষয়ে ভূক্তভোগি রিক্রটিং এজেন্সিগুলো সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে অভিযোগ করেও প্রতিকার পাইনি। এমতাবস্থায় ভূক্তভোগীদের পক্ষ থেকে সংসদীয় কমিটির হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়েছে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি বরাবর লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে, দেশের জনশক্তি রপ্তানিকারক রিক্রটিং এজেন্সিগুলো আগে সপ্তাহে চারদিন যতগুলো ভিসা আবেদন সৌদি দূতাবাসে জমা দিতো; তার বিপরীতে সবগুলোই ভিসা পেয়ে যেতো। এজন্য কাউকে কোন অতিরিক্ত টাকা বা ডলার দিতে হতো না। কিন্তু করোনা পরবর্তী সময়ে জনশক্তি রপ্তানীর সঙ্গে জড়িত আলহাজ্ব এনামুল হক ও কাজী সাখাওয়াত হোসেন লিন্টু একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। এই সিন্ডিকেটের পরামর্শে ভিসা আবেদন জমা নেওয়ার দিন কমিয়ে মাত্র একদিন করা হয়। আর সপ্তাহে মাত্র ১০টি ভিসা ইস্যু করা হয়। এই নিয়ম চালুর মাধ্যমে সৌদিতে জনশক্তি রপ্তানি কমে যায়। আর ডলারের এই সংকটকালে অবৈধ ডলার লেনদেনে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার সংকটও বেড়ে যায়।
লিখিত আবেদনে বলা হয়, বিষয়টি জানাজানি হলে দেশের একটি গোয়েন্দা সংস্থা বিষয়টি নিয়ে তদন্তে মাঠে নামে। তদন্তে ওই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়েছে সংস্থাটি। ওই সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সৌদি দুতাবাসের সাথে সখ্যের সুবাদে ওই সিন্ডিকেট এই সৌদি ভিসার ঘুষ বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করছে। ভিসা প্রতি ২৫০ ডলার ঘুষ না দিলে ভিসা প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে।
গোয়েন্দা সংস্থাটি জানতে পেরেছে, এ চক্রের অন্যতম হোতা আলহাজ্ব এনামুল হক তার প্রতিষ্ঠানের কর্মচারি হেলালকে দিয়ে এজেন্সিগুলোর কাছ থেকে প্রতি ভিসার বিপরীতে ডলার কালেকশন ও হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার থেকে শুরু করে যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করেন। চক্রের অপর দুজন হলেন সাইদুর রহমান ও বিল্লাল হোসেন। তারা পাসপোর্ট জমার লিস্ট সংগ্রহ করে তাদের কাছ থেকে ডলার আদায় করে এনামুল হক ও কাজী লিন্টুর কাছে হস্তান্তর করে। গত ৬ মাসে বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্টদের কাছ থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি। যে টাকা মূলতঃ সৌদি গমনেচ্ছুদের। এতে ভুক্তভোগীরা চরম সংকটে পড়েছেন। এমনিতেই তারা অনেক কষ্ট করে টাকা ম্যানেজ করে পরিবারের সদস্যদের মুখে হাসি ফোটাতে বিদেশ বাড়ি জমান। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার টাকা জোগাড় করতে ভিটেবাড়ি পর্যন্ত বিক্রি করে দেন। এই অবস্থায় ভিসা পেতে ঘুষের টাকা জোগাড় করা তাদের জন্য ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে উঠেছে।
ভুক্তভোগী রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকদের বরাত দিয়ে লিখিত আবেদনে বলা হয়েছে, সব নিয়ম মেনে শ্রমিকদের পাসপোর্ট দূতাবাসের নির্দিষ্ট কাউন্টারে জমা দেওয়া হলেও ভিসা ছাড়াই তা ফেরত দেওয়া হচ্ছে। আগে ভিসা ছাড়া কোন পাসপোর্ট ফেরত দেওয়া হলে তার কারণ লিখিত ভাবে জানিয়ে দেওয়া হতো। কিন্তু এখন ভিসা ছাড়া পাসপোর্ট ফেরত দেওয়ার সময় কোনো কারণ জানানো হচ্ছে না। কিন্তু পাসপোর্টের সঙ্গে নগদ ২৫০ ডলার দিলেই ভিসা মিলছে। এ বিষয়ে পররাষ্ট্র ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ করেছে কয়েকটি রিক্রুটিং এজেন্সি। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। লাইসেন্স ব্ল্যাকলিস্ট হওয়ার ভয়ে অনেক রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক এ ব্যাপারে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছে না। আর ভিসা পেতে বিলম্ব হওয়ায় অনেক সৌদিগামী কর্মীর মেডিকেলের মেয়াদ শেষ হওয়ায় দ্বিতীয় দফায় মেডিকেল করতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে অতিরিক্ত দশ হাজার টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে। আবার ভিসা পেতে বিলম্ব হওয়ায় সৌদি নিয়োগকর্তারা আকামা বাতিল করে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে। আর ঢাকাস্থ সৌদি দূতাবাসে ফ্যামিলি ভিসা, রেসিডেন্স ভিসা, বিজনেস ভিসা ও স্টুডেন্ট ভিসা ইস্যু বন্ধ থাকায় সংশ্লিষ্টরা চরম হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন। সৌদি গমনেচ্ছুদের এই হতাশা লাঘবে সংসদীয় কমিটির হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়েছে আবেদনে।
এ বিষয়ে লিখিত আবেদন প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, অভিযোগ নিয়ে কমিটির আগামী বৈঠকে আলোচনা হবে। আলোচনার মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সকলকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হবে।
নয়াশতাব্দী/জেডআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ