ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

জ্বালানির দাম বৃদ্ধিতে চাপ জীবনযাত্রায়, দেশজুড়ে উদ্বেগ

প্রকাশনার সময়: ০৬ আগস্ট ২০২২, ০৯:২৬ | আপডেট: ০৬ আগস্ট ২০২২, ০৯:৫২

রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী দেখা দিয়েছে অর্থনৈতিক মন্দা। দেশে দেশে দেখা দিচ্ছে মুদ্রাস্ফীতি, কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। যার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে সীমিত আয়ের মানুষ। কেবল নিম্নবিত্তরাই নয়; কুলিয়ে উঠতে পারছে না মধ্যবিত্তরাও। এ পরিস্থিতি সামলা দিতে বাংলাদেশ সরকার ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ করেছে। বিশেষ করে জ্বালানি খাতে সরকারের ভর্তুকি কমিয়ে আনা। যার জেরে শুক্রবার (৫ আগস্ট) মধ্যরাতে রেকর্ড পরিমাণে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। আর এতে দেখা দিয়েছে দেশজুড়ে উদ্বেগ।

বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, প্রতি লিটার ডিজেলের দাম বেড়েছে ৩৪, অকটেন ৪৬ এবং পেট্রোল ৪৪ টাকা। গতরাত ১২টার পর থেকে নতুন এই দাম কার্যকর হয়েছে। ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ৪২.৫ শতাংশ বেড়ে হয়েছে প্রতি লিটার ১১৪ টাকা। পেট্রোলের দাম ৫১.১৬ শতাংশ বেড়ে প্রতি লিটারের দাম হয়েছে ১৩০ টাকা। আর অকটেনের দাম বেড়েছে ৫১.৬৮ শতাংশ, প্রতি লিটার কিনতে গুনতে হবে ১৩৫ টাকা।

মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এবং আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করতে এ দাম বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, যতদিন সম্ভব ছিল ততদিন সরকার জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির চিন্তা করে নাই। অবস্থার প্রেক্ষিতে অনেকটা নিরূপায় হয়েই কিছুটা এডজাস্টমেন্টে যেতে হচ্ছে। ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে সরকার জ্বালানি তেলের মূল্য কমিয়ে দিয়েছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সে অনুযায়ী জ্বালানি তেলের মূল্য পুনঃবিবেচনা করা হবে।

এদিকে জ্বালানি তেলের মৃল্য বৃদ্ধির খবরে শুক্রবার রাত থেকেই রাজধানীর সড়কে গণপরিবহন শূন্য হতে থাকে। হঠাৎ বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেকটা বিপাকে পড়েন নগরবাসী।

পরিবহন শ্রমিকরা জ্বালানির দাম বাড়ানোর এই হারকে অস্বাভাবিক বলছেন। কারণ এর প্রভাব দ্রব্যমূল্যের ওপরও পড়বে। এমনিতেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নাভিশ্বাস অবস্থা সাধারণ জনগণের। তার মধ্যে জ্বালানি তেলের এমন অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে ব্যয় বাড়বে সবকিছুতে।

জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গণপরিবহনের ভাড়া দ্রুত সমন্বয়ের দাবি জানিয়েছেন মালিকরা। তা না হলে যাত্রীদের সঙ্গে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটার সম্ভবনা রয়েছে বলে তারা জানান। পরিবহন নেতারা বলছেন, তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গণপরিবহনের ভাড়া সমন্বয় না হলে সড়কে তার প্রভাব পড়বে।

দেশজুড়ে উদ্বেগ

রংপুর: পেট্রোল-অকটেনসহ জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির খবরে রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলের বেশিরভাগ ফিলিং স্টেশন বন্ধ করে সটকে পড়েছেন কর্তৃপক্ষ। আগের দামে তেল সংগ্রহ করার আশায় পেট্রোল পাম্পগুলোর সামনে শত শত মোটরসাইকেল নিয়ে ভিড় করছেন ক্রেতারা। এ সময় ফিলিং স্টেশনে ক্রেতাদের হট্টগোল দেখা যায়।

এদিকে কুড়িগ্রামের ফিলিং স্টেশনে প্রতি লিটার পেট্রোল ১৩০ টাকা করে নেওয়া হয় রাত ১২টার আগেই। এমন অভিযোগ করছেন সেখানকার বেশিরভাগ ক্রেতা। রংপুরে শাপলাচত্ত্বর এলাকার তিনটি পাম্প বন্ধ করে দেয়া হয় দাম বাড়ার খবর গণমাধ্যমে প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে। মডার্নমোড় এলাকা, কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল এলাকা, সিওবাজার এলাকার ফিলিং স্টেশনগুলো বন্ধ পাওয়া যায়। বুড়িরহাট এলাকার একটি ফিলিং স্টেশনে ক্রেতাদের প্রচণ্ড ভিড় ও হট্টগোল ঠেকাতে পুলিশি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন পড়ে।

চট্টগ্রাম: নগরীর হালিশহর ঈদগাঁ এলাকায় পাম্পে ভিড় করছেন বাইকাররা। অনেক পাম্পের মালিক তেল বিক্রি না করে পাম্প বন্ধ করে দিয়েছেন। জ্বালানি তেলের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন গাড়ি চালকরা। না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বাইকারারা। এ ছাড়া জ্বালানি নিতে আসা যানবাহনের কারণে আশপাশের সড়কগুলোতে ৩০ মিনিটের বেশি সময় ধরে যান চলাচল বন্ধ ছিলো। মেট্রোপলিটন পরিবহন মালিক গ্রুপের নেতারা বলেন, রাতে হঠাৎ তেলের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এরপর অনেক পেট্রোল পাম্প তেল সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। আবার অনেক পেট্রোল পাম্প তেল দিলেও প্রচণ্ড ভিড়ের কারণে গণপরিবহনগুলো তেল নিতে পারেনি। এছাড়া, বর্ধিত দামে তেল কিনলে ভাড়াও বৃদ্ধি করতে হবে। এই পরিস্থিতিতে শনিবার সকাল থেকে গণপরিবহন চলাচল বন্ধ থাকবে।

পঞ্চগড়: হঠাৎ জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির সংবাদে জেলায় পেট্রোল পাম্পগুলোতে তেল বিক্রি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবে রাত থেকে শহরের প্রতিটি তেলের পাম্পে পর্যাপ্ত জ্বালানি তেল থাকলেও মালিকরা বাড়তি মুনাফার আশায় তেল বিক্রি বন্ধ রাখেন। এদিকে একই কারণে পাম্পগুলোতে ভিড় জমিয়েছেন বাইক, বাস, ট্রাক চালকরা। দীর্ঘ সময় এ পাম্প ও পাম্প ঘুরেও মেলেনি জ্বালানি তেল। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন তারা। ভুক্তভোগী মো. শাহ আলম ও আতাউর রহমান বলেন, খবর পেয়ে পাম্পে এসে দেখি তারা তেল সরবরাহ করছে না। বাড়তি দামে বিক্রির জন্য পাম্প মালিকরা তেল মজুত রেখেছেন।

ঠাকুরগাঁও: জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার খবরে গভীর রাতে জেলার ফিলিং স্টেশনগুলোতে। ফিলিং স্টেশন মালিকরা মোটরসাইকেল চালকদের এক লিটার ও বড় যানবাহন চালকদের দশ লিটারের বেশি তেল দিচ্ছেন। তবে তেলের দাম বৃদ্ধিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তেল নিতে আসা যানবাহক চালকরা। জেলা ঠাকুরগাঁও জেলার পেট্রোল পাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এনামুল হক জানান, সবাইকে সন্তুষ্ট রাখতেই অল্প করে তেল দেয়া হচ্ছে।

গাইবান্ধা: তেলের দাম বৃদ্ধির খবরে উপচে পড়া ভিড় গাইবান্ধা পেট্রল পাম্পগুলোতে। শহরের প্রতিটি তেলের পাম্পে পর্যাপ্ত জ্বালানি তেল থাকলেও বাড়তি দামের আশায় তারা তেল বিক্রি বন্ধ রাখে। এ দিকে রাত থেকেই পাম্পগুলোতে ভিড় জমিয়েছেন বাস ও মোটরসাইকেল চালকরা।

ভোলা: জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো খবরে জেলায় সব পাম্প বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এতে চরম বিপাকে পড়েছেন গাড়ি চালকরা। এ দিকে পুলিশ পাহারায় যুগিরঘোলের পদ্মা ওয়েল কোম্পানির পাম্প থেকে স্বল্প সংখ্যক গ্রাহককে অকটেন সরবরাহ করা হয়। ডিপোতে মজুদের চেয়ে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় প্রতিটি মোটরসাইকেলে এক লিটার ও বড় গাড়িতে ৫ লিটার করে তেল সরবরাহ করা হয় আগের দামেই। জেলা শহরে মাত্র একটি পাম্প খোলা থাকায় হিমসিম খেতে হচ্ছে পাম্প কর্তৃপক্ষকে। বিশৃঙ্খলা এড়াতে মোতায়েন করা হয়েছে পুলিশ। পাম্পের ম্যানেজার জানান, তেলে দাম বৃদ্ধির খবরে শত শত গাড়ি আসতে শুরু করেছে। রাতে ২ ঘণ্টায় যে গাড়ি এসেছে ২ মাসেও এতো গাড়ি আসে নাই। অকটেনের চাহিদা বেশি। ডিজেলে গাড়ি তেমন একটা আসছে না।

কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. বদরূল ইমাম গণমাধ্যমকে বলেছেন, জনগণের সঙ্গে কোনো আলাপ-আলোচনা, প্রস্তুতি ছাড়াই রাতের অন্ধকারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হলো। গ্যাসের দাম বাড়ানোর সময় গণশুনানি হয়। কিন্তু তেলের দামের ক্ষেত্রে এই লুকোচুরিটা কেন? হঠাৎ করে গভীর রাতে ভোক্তা পর্যায়ে কারো সঙ্গে কোনো পরামর্শ না করে হুট করে ইচ্ছে মতো একটা দাম নির্ধারণ করে দিলাম। এটাকে আমি মোটেও সুষ্ঠু একটা ব্যবস্থাপনার মনে করি না।

এই বিশেষজ্ঞের অভিযোগ, বিশ্ববাজারে তেলের দাম এখন নিম্নমুখী। আর এই যে সমন্বয়ের কথা ওনারা বারবার বলেন, কিন্তু তেলের দাম যখন দীর্ঘদিন ধরে অনেক কম ছিল আমরা তো কম দামে তেল কিনিনি। ওই টাকা যদি হিসাব করা হয়, তাহলে লাভের কত টাকা জমা আছে বিপিসির কাছে। এই দুর্যোগপূর্ণ সময়ে সেই টাকাটা কি সমন্বয় করা যায়। দাম বাড়বে তাই বলে এত অস্বাভাবিক?

আর জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম বলেছেন, দাম কিছুটা বাড়ানো হবে, এই আশঙ্কা ছিল। তবে সেটা সহনীয় পর্যায়ে রাখা যেত। যতটা বাড়ানো হয়েছে, তা চিন্তার বাইরে। এতে করে মানুষের জীবন চালানো কঠিন হয়ে পড়বে। এদিকে কিছুদিন আগে পানির বিল বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে ঢাকা ওয়াসা। ইউরিয়ার সারের দামও বেড়েছে। এরইমধ্যে বাড়ল তেলের দাম। নতুন করে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর ইঙ্গিত ইতোমধ্যে দিয়েছে সরকার।

যদিও গত ২৭ জুলাই প্রধানমন্ত্রী এক অনুষ্ঠান বলেছেন, অকটেন এবং পেট্রোল কিন্তু আমাদের কিনতে হয় না। এটা আমরা যে গ্যাস উত্তোলন করি, সেখান থেকে বাই প্রোডাক্ট হিসেবে পেট্রোল ও অকটেন পাই। বরং অকটেন আমাদের যতটুকু চাহিদা তার চেয়ে অনেক বেশি পেট্রল ও অকটেন আমাদের আছে। আমরা অনেক সময় বাইরে বিক্রিও করি।

পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়বে পরিবহন ভাড়ায়, দাম বাড়বে খাদ্যপণ্যে। এতে মানুষের জীবন আরও কঠিন হয়ে পড়বে। এরইমধ্যে ভাড়া সমন্বয়ের দাবিতে চট্টগ্রামে নগর পরিবহন বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে মালিকরা। গত নভেম্বরে সবশেষ জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছিল। তখন গণপরিবহনে প্রায় ২৭ ভাগ ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়েছিল। এবার কত শতাংশ বাড়বে সে সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি।

বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রমেশ ঘোষ বলেছেন, জ্বালানি তেলের দাম যে পরিমাণে বাড়ানো হয়েছে, তাতে যাত্রীদের ওপর চাপ বিপুলভাবে বাড়বে।

এই পরিবহন ব্যবসায়ী মনে করেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর কারণে নতুন করে বাস, লঞ্চ ও ট্রাকভাড়া বাড়বে। প্রাইভেট কারের মালিক ও মোটরসাইকেলের চালকদের খরচও বাড়বে। ব্যয় বাড়বে কৃষি খাতে, যা বাড়িয়ে দেবে পণ্যের দাম।

নয়া শতাব্দী/এফআই

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ