নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ইসির সংলাপ কোনো ফল বয়ে আনবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। গত ১৭ জুলাই থেকে এই সংলাপ শুরু হলেও বিএনপি, জাসদের একটি অংশসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দল নির্বাচন কমিশনের আমন্ত্রণে সাড়া দেয়নি। আগামী ৩১ জুলাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় পার্টির সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে ইসির এই কর্মসূচি শেষ হবে। তবে, শেষ হওয়ার আগেই এই সংলাপের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ইসিকে মূলত ৩টি চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হচ্ছে; ১. সব দলের অংশগ্রহণে আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান; ২. ইভিএম বা ব্যালটিং পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণের ব্যাপারে সব দলের মধ্যে মতানৈক্য প্রতিষ্ঠা এবং ৩. সব পর্যায়ের নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু এবং সহিংসতামুক্ত করে জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা। নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃবৃন্দ এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, এককভাবে শুধু নির্বাচন কমিশনের পক্ষে এই চ্যালেঞ্জগুলো উতরানো সম্ভব হবে না।
চলমান সংলাপে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ ৩৯টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ৩১ জুলাই বসবে ইসি এবং বিএনপির সঙ্গে ২০ জুলাই বসার কথা ছিল; যদিও বিএনপি আমন্ত্রণ রক্ষা করেনি। আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির জন্য সংলাপে দুই ঘণ্টা করে সময় বরাদ্দ করা হয়েছে। বাকি রাজনৈতিক দলগুলো পাবে এক ঘণ্টা সময়।
গত ৬ জুলাই বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে সংলাপের এ সময়সূচি প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন। ওই দিন ইসির সচিবের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সংলাপে নির্ধারিত কোনো আলোচ্যসূচি থাকছে না। আলোচ্যসূচি উন্মুক্ত। প্রতিটি নির্বাচন কমিশন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করে থাকে। এ কমিশনও সেই ধারা অব্যাহত রাখছে।
গত কমিশনের আমলে দেখা গেছে, সংলাপে যেসব সুপারিশ এসেছিল, সেগুলো মূলত বই আকারে প্রকাশ করেই নিজেদের দায়িত্ব শেষ করেছিল ইসি। এসব সুপারিশ বাস্তবায়নে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। এবারো তেমনটি হবে কিনা— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সেটা সময় হলে দেখা যাবে।
জানা গেছে, এর আগে কমিশন ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) কারিগরি দিক প্রদর্শনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছিল। ওই বৈঠকে বিএনপিসহ ১১টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়নি। অপরদিকে আওয়ামী লীগসহ ২৮টি দল অংশ নিয়েছিল।
বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ধারাবাহিক সংলাপ করে আসছে। গত ১৩ মার্চ শুরু হওয়া সংলাপে এ পর্যন্ত শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, নির্বাচন বিশেষজ্ঞ, গণমাধ্যমের প্রতিনিধি ও পর্যবেক্ষক সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপ করেছে।
কমিশনের একার পক্ষে যে ভালো নির্বাচন করা সম্ভব নয় তা গত ১১ জুন সাবেক নির্বাচন কমিশনারদের সঙ্গে সংলাপ শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল নিজেই জানিয়েছেন। এ সময় তিনি উপস্থিত সংবাদকর্মীদের জানান, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা ও ঐকমত্য না থাকলে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) পক্ষে ভোট করা কষ্টকর হবে। কমিশনের একার পক্ষে ভালো নির্বাচন করা সম্ভব নয়।
দায়িত্বভার পাওয়ার পর থেকেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কর্মপদ্ধতি ঠিক করতে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার ব্যক্তিদের সঙ্গে ধারাবাহিক সংলাপ করে যাচ্ছে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশন। তিনি সাংবাদিকদের আরো বলেন, অতিথিরা বলেছেন বর্তমানে যে সিস্টেম আছে তাতে এখানে খুব বেশি ভালো করা সম্ভব নয়। এটা একটু কম-বেশি কিছু হতে পারে। আমরা যদি দৃঢ় থাকি, আইন দৃঢ়ভাবে বাস্তবায়নের চেষ্টা করি, তাহলে অনেকটা উন্নয়ন সম্ভব।
সাবেক সিইসি আবদুর রউফের রেফারেন্স টেনে তিনি বলেন, প্রার্থী অনুযায়ী নয়, দলভিত্তিক নির্বাচনের কথা বলেছিলেন রউফ সাহেব। নির্বাচনে দেখা গেল যে অনেক আগে থেকে দলগুলো তাদের টোটাল প্রার্থীর নাম দিয়ে যাবে। সবাই তিনশ’ আসনে প্রার্থী দিল। পার্টি ক, খ, গ, ঘ। যে যত ভোট পেয়েছে, সেভাবে আসন পাবে। এ ধরনের একটা সিস্টেম আছে। তবে এটা আমাদের বিষয় নয়। দলগুলোকেই দেখতে হবে।
সিইসি বলেন, আমরা যে শপথ নিয়েছি, বর্তমানে যে আইনি কাঠামো আছে, সাংবিধানিক কাঠামো আছে, এর মধ্যেই আমাদের নির্বাচন করতে হবে। কেউ কেউ বলেছেন একাধিক দিনে নির্বাচন করলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে। কেউ কেউ আবার বলেছেন এতে সমস্যাও হবে। এ নিয়ে কোনো ঐকমত্য হয়নি। কাজেই একাধিক দিনে নির্বাচন করলে আমাদের জন্য অসুবিধাও হতে পারে। ওই ধরনের প্রস্তুতি আমাদের নেই।
দলগুলোকে পরামর্শ দিতে সমস্যা কোথায়— এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, ‘এখনো দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করিনি। সবাই বলেছেন নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। নির্বাচন যদি ইনক্লুসিভ না হয়, নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বাস্তব অর্থে থাকবে না। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনেকটা নষ্ট হয়ে গেছে। এই কালচারের মধ্যে কিছু ইতিবাচক গুণ আনতে হবে। তাদের মধ্যে পরমতসহিষ্ণুতা, ঐকমত্য যদি না থাকে নির্বাচন কমিশনের একার পক্ষে খুব ভালো নির্বাচন করা সম্ভব হবে না। এটা আমরা যেমন আগে বলেছি, ওনারাও বলেছেন।’
নির্বাচন কমিশনের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয় কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনকালীন একটি ঘটনায়। কুমিল্লা-৬ আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিনকে সিটি করপোরেশন ভোটে এলাকা ছাড়তে ইসি চিঠি দিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। এ বিষয়ে সিইসি বলেন, ‘আমাদের কিছু আইনগত দিক আছে। কিছু ক্ষমতা আংশিক, কিছু পরিপূর্ণ। কুমিল্লায় যা বলা হয়েছে— সরকারি সুবিধাভোগী অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা নির্বাচনি এলাকায় থাকতে পারবেন না। মাননীয় সংসদ সদস্য এই আচরণবিধি ভঙ্গ করছেন বলে প্রতীয়মান হয়েছে, আমরা এলাকা ছাড়তে বলেছি। উনি এলাকা ছাড়েননি। আমরা যখন কাউকে রিকোয়েস্ট করি, জোর করে একজন মাননীয় সংসদ সদস্যকে আদেশ মানানো যায় না। উনাকে বলাটাই এনাফ। উনি যদি সেটাকে অনার না করে থাকেন তাহলে আমাদের তেমন কিছু করার থাকে না।’
এদিকে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এটিএম শামসুল হুদা নির্বাচনি আইন পরিবর্তন না করার পক্ষে মত দিয়েছেন। বর্তমান কমিশনের উদ্দেশে তিনি বলেন, আইন-কানুন যা আছে তার মধ্য দিয়েই অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব। তা দিয়েই আমরা তো সুষ্ঠু নির্বাচন করেছি।
বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে ইসির কর্মকর্তাকে রিটার্নিং অফিসার করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বর্তমান সিইসির উদ্দেশে বলেন, আমি করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সব জায়গায় পারিনি। সব জায়গায় উপযুক্ত লোকবল নেই, প্রশিক্ষিত লোক দরকার। যাদের বেছে বেছে করেছি, বাকিগুলোতে ডিসিদের নিয়োগ করেছি। একেবারে বাদ দেয়া ঠিক হবে না।
সব দল না এলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না বলে মনে করেন শামসুল হুদা। তিনি বলেন, ‘কীভাবে আনবেন সেটা আপনাদের ওপর নির্ভর করবে। আমার দায়িত্বকালে বিএনপির আস্থা ফেরাতে অনেক সময় লেগেছে। ওনারা বলছেন কারেন্ট পরিস্থিতিতে ভোটে যেতে রাজি নন। যে দেশে গণতন্ত্র ও নির্বাচন আছে, সেদেশে কোনো দল বেশিদিন নির্বাচনের বাইরে থাকতে পারে না। আমরা যদি পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারি তাহলে তারা অবশ্যই আসবে।’
বর্তমান কমিশনের উদ্দেশে সাবেক এই সিইসি বলেন, এখন পর্যন্ত আপনাদের যা কার্যকলাপ দেখেছি, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে না কেউ। এটা যদি বজায় রাখতে পারেন, যেসব কর্মকর্তা আছে তাদের নিয়ে আপনারা ভালো নির্বাচন করতে পারবেন। আমরা সবাই চাই একটা সুন্দর নির্বাচন হোক।
ইসির সাবেক সচিব ড. মোহাম্মদ সাদিক বর্তমান কমিশনকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য ৯ ঘণ্টায় দিন হিসাব করে প্রস্তুতি নেয়ার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, ব্যালট ভোট গণনায় নানা সমস্যা হয়। এক্ষেত্রে ইভিএম আপনাদের মুক্তি দিতে পারে। কেন্দ্রে বুথের সংখ্যা বাড়িয়ে কেন্দ্র কমানোর পরামর্শ দেন তিনি।
ইসির সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোখলেছুর রহমান জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারদের রিটার্নিং কর্মকর্তা করার সুপারিশ দেন। তিনি বলেন, ইভিএম কিংবা ব্যালট যেভাবেই নির্বাচন হোক গোপন কক্ষে যেন কোনো লোক দাঁড়িয়ে না থাকে। ভোটের দিন ইন্টারনেটের গতি ধীর না করার পরামর্শ দেন তিনি।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার শাহ নেওয়াজ ইভিএম হ্যাকিংয়ের সুযোগ নেই মন্তব্য করে বলেন, এটাতে ইন্টারনেট নেই। এজন্য মক ভোটিং সিস্টেম বাড়াতে হবে। গোপন কক্ষে একজন লোক দাঁড়িয়ে থেকে বলছে, ভোট দিয়ে দেই। সেই ডাকাত সরাতে না পারলে ইভিএম মানুষ গ্রহণ করবে না। জাতীয় নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেয়ার পক্ষে মত দেন তিনি।
নির্বাচনকালীন সরকারের আচরণ দেখতে হবে বলে মনে করেন সাবেক কমিশনার আবু হাফিজ। তিনি বলেন, যেখানে কমিশনের লোক দিয়ে দায়িত্ব পালন সম্ভব সেখানে কমিশনের লোক নিয়োগ দিতে হবে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে। অন্যথায় জেলা প্রশাসককে নিয়োগ দিতে হবে। সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু এই বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে ইনভলভ হওয়া যাবে না। এটা সরকারি দলের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। আইন প্রয়োগ সঠিকভাবে করতে হবে। তাহলে নির্বাচন সুষ্ঠু করা সম্ভব। তবে, নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, সরকারের সদিচ্ছাই ইসির ৩ চ্যালেঞ্জ উত্তরণে বড় সহায় হয়ে উঠবে। মুখের কথায় নয়, বাস্তবে, ইসির ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সুষ্ঠু ভোট করা সম্ভব বলে ধারণা তাদের।
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ