অভিবাসী নারী শ্রমিকরা যারা নির্যাতনের শিকার, নিঃস্ব হয়ে দেশে ফিরেছেন, তারা যে অর্থ সেখানে রেখে এসেছেন তা ফেরত আনার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণে সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছেন।
মঙ্গলবার (২০ জুলাই) জাতীয় প্রেসক্লাবে সিডব্লিউসিএস এর আয়োজনে এবং মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় ‘নারী অভিবাসী শ্রমিকের অধিকার বিষয়ক’ এক আলোচনা সভায় এই আহবান জানান বক্তারা।
আলোচনা সভায় আরো বক্তব্য রাখেন, আইসিএমপিডির কান্ট্রি কোর্ডিনেটর মোহাম্মাদ ইকরাম হোসেন, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রোগ্রাম কোর্ডিনেটর মহুয়া লেয়া ফলিয়া, সিডব্লিউসিএস প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ইসরাত শামীম প্রমুখ। আলোচনা সভায় মুল প্রবন্ধ উপস্থাপনা করেন যুগান্তররে সাংবাদিক রীতা ভৌমিক। এছাড়াও আলোচনা সভায় বিদেশ ফেরত নারী শ্রমিকরা তাদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের কথা তুলে ধরেন।
সভায় বক্তরা বলেন, ভবিষ্যতে একজন নারী অভিবাসী শ্রমিকও যেন আর নির্যাতনের শিকার না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। বিদেশে গৃহপরিচারিকার কাজ দেয়া নিয়ে দালালরা যে কৌশল অবলম্বন করে তা থেকে অভিবাসী নারীদের বের করে আনতে হবে। অভিবাসী নারীর অধিকার সুরক্ষায় স্থানীয় পর্যায়ে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে- ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা পর্যায়ের প্রতিনিধিদের অবগত থাকা দরকার কারা কোন দেশে যাচ্ছেন, কার মাধ্যমে যাচ্ছেন।
সভায় মোহাম্মাদ ইকরাম হোসেন বলেন, ইউনিয়ন পরিষদকে সম্পৃক্ত করে ইউনিয়ন পরিষদে নারী অভিবাসন কমিটি গঠন করতে হবে। ডেমো অফিসকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা এবং নারী-বান্ধব পরিবেশ প্রয়োজন। সরকারের বিভিন্ন সুবিধা আছে, সরকারের নতুন পলিসি উদ্যোগ নিচ্ছে যেমন রিইন্টিগ্রেশন পলিসি। একদম ডোর স্টেপে সার্ভিসগুলো প্রচার করতে হবে।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের মহুয়া লেয়া ফলিয়া বলেন, গণমাধ্যমে বেশিরভাগ খবর নেতিবাচক। ইতিবাচক খবর কম দেখতে পাই। অভিবাসী নারীদের প্রতি শব্দ চয়নে সতর্ক থাকতে হবে, যাতে তারা অসম্মানিতবোধ ও আঘাতপ্রাপ্ত না হয়।
অধ্যাপক ইসরাত শামীম বলেন, স্থানীয় সরকারকে অভিবাসনের সকল তথ্য জানতে হবে। অভিবাসী নারীদের ডিজিটাল শিক্ষা বাড়াতে হবে। দেশের বাইরে যাওয়ার আগেই কিভাবে মোবাইল ফোনে ছবি তুলতে হয়, কিভাবে তাদের প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস স্বজনদের কাছে পাঠাবেন, কিভাবে সংরক্ষণ করবেন। সংবাদিকদের প্রতিবেদনে সম্পূর্ণ অভিবাসন খাতের তথ্য আনা জরুরি।
মূল প্রবন্ধে জানানো হয়, বিএমইটি স্ট্যাস্টিটিক ডাটা অনুযায়ী, ১৯৯১ থেকে ২০২২ সালের মে পর্যন্ত ১০ লাখ ৫০ হাজার ৮১৯ জন নারী অভিবাসন করেছেন। এদের মধ্যে কিছু সংখ্যক নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। জানুয়ারি-২০২১ থেকে জুন-২০২২ পর্যন্ত মিডিয়ায় বেশিরভাগ নেতিবাচক কেসগুলো প্রচার হয়েছে। তবে নারী বিদেশে কিভাবে যাবে, কোথায় গেলে সঠিক তথ্য পাবে এবিষয়গুলো মিডিয়াতে কম প্রচার হয়। প্রত্যাশা করি, মিডিয়া সম্পূর্ণ অভিবাসন খাতের তথ্য প্রদান করবে। এতে আরো জানানো হয়, গত তিন বছরে সন্তান নিয়ে দেশে ফিরেছেন ১২ জন। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফিরেছেন ৬৫ জন নারী।
ভুক্তভোগী নারগিস আক্তার বলেন, জয়পাড়ার মনির নামে এক দালাল (আসল বাড়ি ব্রাম্মনবাড়িয়া) বিদেশ যাওয়া বাবদ ৫০ হাজার টাকা নেয়। তাকে লেবাননে এক বাসায় গৃহপরিচারিকার কাজ দেয়। সেখানে অত্যাচার নিযার্তন সহ্য করে এক বছর কাজ করেন। পরবর্তীতে গৃহকর্তার অত্যাচার ও নিযার্তনের পরিমাণ বেড়ে গেলে তিনি পালিয়ে যান। তিনি সেই দেশের ভাষাও জানতেন না, পরিচিতও কেউ ছিল না। এক বাঙালি নারীর সহযোগিতায় একটি কাজ পান। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি কোনো কাজ পাননি। বাংলাদেশে পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ থাকায় তিনি দেশেও ফেরত আসতে পারছিলেন। কখনো কাজ পেয়েছেন, আবার কাজ না পেলে আর্থিক কষ্টের মধ্য দিয়ে তিনি দিন কাটিয়েছেন। ২০২০ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশে ফেরত আসেন। দেশে ফেরার পর তার প্রতিবেশী, পাড়ার লোকেরা তার সাথে কথা বলেনি, অনেকে তাকে নিয়ে কটূক্তি করেছে। তিনি এ ব্যাপারে কোনো মামলা করেননি।
সৌদি থেকে ফেরত আরেক ভুক্তভোগী মোসা. বেবী আক্তার বলেন, দালালের মাধ্যমে গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে যান। খরচ হয় ৪০ হাজার টাকা। গৃহকর্তা তাকে মারধর করতো এমনকি ঠিকমত খাবার দেয়নি। ৩ দিন তাকে বাথরুমে আটকে রেখেছিল। একদিন সুযোগ পেয়ে পালিয়ে গিয়ে রাস্তার পাশে কান্নাকাটি করার সময় এক বাঙালি তাকে বাংলাদেশ দূতাবাসে যাওয়ার পরামর্শ দেন। সেখানে ১৫ দিন দূতাবাসের তত্ত্বাবধানে ছিলেন। কিন্তু দেশে ফেরার বিমান ভাড়া ছিল। বাংলাদেশ থেকে ২২ হাজার টাকা পাঠালে তিনি দেশে ফিরে আসেন।
নয়াশতাব্দী/জেডআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ