ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

দুর্গত এলাকায় হাহাকার

উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে বিস্তৃত হওয়ার শঙ্কা
প্রকাশনার সময়: ২০ জুন ২০২২, ১৪:৪১

সিলেটে কোথাও বন্যার পানি এক থেকে দেড় ফুট বেড়েছে আবার কোথাও সমপরিমাণ পানি কমেছে। এই বাড়া-কমার মধ্যে বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে পারে।

সিলেটের উজানে ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে আরো তিন-পাঁচ দিন ভারি বৃষ্টি হবে বলে জানিয়েছে সে দেশের সরকারি আবহাওয়া অফিস। এখনো সিলেট বিভাগীয় শহরের সঙ্গে বন্ধ কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলা এবং সুনামগঞ্জ জেলার সড়ক যোগাযোগ।

সিলেট মহানগরের ঘাসিটুলা, কলাপাড়া, লামাপাড়া, নগরের শামীমাবাদ, কানিশাইল, মজুমদারপাড়া, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট, সুরমা আবাসিক এলাকা, আখালিয়া, শাহজালাল উপশহর, ওসমানী মেডিকেল রোড, সোবহানিঘাট, শাপলাবাগ ও এয়ারপোর্ট থানার চালিয়া, উপরপাড়া, গোয়াবাড়ি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এসব এলাকার পানি কমেছে এক থেকে দেড় ফুট পর্যন্ত। তবে পানি কমলেও এখনো বাসাবাড়িতে প্রচুর পানি রয়েছে।

নগরের ঘাসিটুলা এলাকার বাসিন্দা ইশতিয়াক আহমদ বলেন, আজ বৃষ্টি কম হওয়ায় পানি এক থেকে দেড় ফুট কমেছে। তবে বাসাবাড়িতে এখনো এক থেকে দুই ফুট পর্যন্ত পানি আছে। বাবা-মা-বোনসহ আমাদের পরিবারের পাঁচ সদস্য এখনো ঘাসিটুলা ইউসেপ টেকনিক্যাল স্কুলে বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রে আছি। কেন্দ্রের মানুষ খাবার সংকটে আছে। অনেকেই অভুক্ত।

সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) ১১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রফিকুল ইসলাম ঝলক বলেন, লালাদিঘির পাড় এলাকায় আমার বাসাসহ, ভাতালিয়া, কুয়ারপাড়, বিলপার ও ইঙ্গুলাল রোডে পানি থৈ থৈ করছে। রোববার প্রায় এক ফুট পানি কমেছে। তবে আমার বাসায় এখনো হাঁটুসমান পানি।

সিলেট সদর উপজেলার ১ নম্বর জালাবাদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. ওবায়দুল্লাহ ইসহাক বলেন, আমার ইউনিয়নে প্রায় এক ফুট পানি কমেছে। বন্যায় এ ইউনিয়নের মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখনো ইউনিয়নের ৯৫ ভাগ এলাকা পানির নিচে। বন্যাদুর্গতদের সহায়তায় সরকারের পাশাপাশি বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

ইউপি চেয়ারম্যান মো. ওবায়দুল্লাহ আরো বলেন, আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিদিন রান্না করা ও শুকনা খাবার সাধ্যানুযায়ী মানুষের মধ্যে বিতরণ করছি। তবে এগুলো যথেষ্ট নয়।

বিশ্বনাথ উপজেলার বাসিন্দা ও বাঁচাও বাসিয়া নদী ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক ফজল খান বলেন, তিন দিন পর রোববার বিশ্বনাথে একটু রোদ উঠেছে। বন্যার পানিও কমেছে প্রায় দেড় ফুট। পানি কমায় লোকজন স্বস্তি প্রকাশ করছে। তবে এখনো বন্যার পানির নিচে প্রিয় বিশ্বনাথ শহর।

অন্যদিকে, সিলেটের জকিগঞ্জে বন্যার পানি বেড়েছে বলে জানা গেছে। জকিগঞ্জ উপজেলার কাজলসার ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মোস্তাক আহমদ বলেন, কুশিয়ারা নদীর অমলসীদ পয়েন্টে পানি আজো বেড়েছে। এ কারণে বেশ কয়েকটি ডাইক ভেঙে পানি উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকায় ঢুকছে। ক্রমেই বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। এ অবস্থায় বন্যাদুর্গত লোকজনের মধ্যে খাবার সংকট দেখা দিয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে সরকারিভাবে পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী পাঠানোর আহ্বান জানান তিনি।

জকিগঞ্জ উপজেলার স্থানীয় সাংবাদিক এনামুল হক মুন্না জানান, জকিগঞ্জের বীরশ্রী ইউনিয়নের পীরনগর গ্রামে কুশিয়ারা নদীর তীররক্ষা বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভয়াবহ বন্যায় রারাই গ্রামে কুশিয়ারা নদীর বেড়িবাঁধে ভেঙে তলিয়ে গেছে রারাই, ফলাহাট, পাঠাবচক, ইলাবাজ, ভরণ, শীতলজুরা, হাইলইসলামপুর, আনারসিসহ অনেক গ্রাম।

কানাইঘাট প্রেসক্লাবের সহ-সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রশীদ জানান, কানাইঘাটে সুরমা নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় ফের বন্যার পানি বাড়ছে। পার্শ্ববর্তী জকিগঞ্জ উপজেলার কুশিয়ারা নদীর পানি আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। এতে কানাইঘাট উপজেলার সাতবাঁক, দীঘিরপাড়, লক্ষ্মীপ্রসাদ পূর্ব, লক্ষ্মীপ্রসাদ পশ্চিম, বড়চতুল, কানাইঘাট পৌরসভা, রাজাগঞ্জ ও ঝিংগাবাড়ী ইউপিতে পানি বাড়ছে। সকাল থেকে সুরমা উপচে কানাইঘাট বাজারে হু হু করে পানি ঢুকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়িয়ে দিয়েছে।

জকিগঞ্জের অমলসীদ পয়েন্ট সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি বাড়ছে বলে জানান পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেট কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমদ। তিনি বলেন, কানাইঘাট পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি সকাল থেকে বাড়ছিল। তবে বিকেল ৩টার পর থেকে আবার কমতে শুরু করছে। সিলেট সদর পয়েন্টে যিনি আছেন তার মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ থাকায় তার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে পানি বাড়া-কমার মাপ আমরা পাচ্ছি না। যেহেতু শহরে ও সদর উপজেলায় পানি কমছে তাই বলা যায় সুরমার এই পয়েন্টে পানি কমতে শুরু করেছে।

এদিকে, দিনে দিনে কাতর হয়ে পড়ছেন সিলেটের বানভাসি মানুষ। চরম দুর্দিনে দিন কাটছে তাদের। খোদ সিলেট নগরীর আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে অভুক্ত রয়েছে মানুষজন। দিনে এক বেলাও খাবার জুটছে না তাদের। দেখা মিলছে না জনপ্রতিনিধিদেরও। এখনো পানিবন্দি মানুষদের উদ্ধারে ব্যস্ত থাকার কারণে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা।

নগরীর শেখঘাটের ময়নুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের দুটি ভবনে বসবাস করছে অর্ধশতাধিক পরিবার। নগরের শেখঘাট, কুয়ারপাড়, বিলপাড়সহ কয়েকটি এলাকা থেকে বাড়িঘর ছেড়ে এসে লোকজন উঠেছেন এই কেন্দ্রে। অনেকটা গাদাগাদি করে বসবাস করছেন লোকজন। আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা কুয়ারপাড়ের তসলিমা বেগম জানান, গত দু’দিন ধরে তারা অবস্থান করছেন। আশপাশের লোকজন রান্না করা খাবার কখনো দিচ্ছেন, কখনো দিচ্ছেন না। প্রশাসনের কেউ এসে ত্রাণ দেয়নি বলে দাবি তার। আব্দুস শুকুর নামের আরো এক বন্যার্ত জানান, তার ঘরে কোমর পানি। স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন।

শেখঘাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ঘাষিটুলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্র পরিদর্শনকালে এমন চিত্রই চোখে পড়ে। স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলররা জানান, কিছু কিছু আশ্রয় কেন্দ্রে শুকনো খাবার দেয়া হচ্ছে। এখনো সরকার থেকে পর্যাপ্ত ত্রাণ আসেনি। তবে রান্না করা খাবার পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সিলেট নগরীতেই অর্ধশতাধিক আশ্রয় কেন্দ্র। ১০নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তারেক আহমদ ও ১২নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সিকন্দর আলী জানান, আশ্রয়কেন্দ্রেও মানুষের ঠাঁই হচ্ছে না। পানিবন্দি লোকজনও জীবন বাঁচাতে এখন আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটছেন। ফলে আশ্রয়কেন্দ্রে আসা লোকজনের সারি দীর্ঘ হচ্ছে।

নগরের বাইরে সিলেট জেলায় সাড়ে ৪শ’ আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন বন্যার্তরা। দুশ্চিন্তা কাটছে না তাদের। অনেক আশ্রয়কেন্দ্রে গবাদি পশু ও মানুষ একসঙ্গে বসবাস করছে। উজানের ঢল অব্যাহত থাকার কারণে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়া যাচ্ছে না। সিলেট জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার লুৎফুর রহমান জানিয়েছেন, আমরা সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর এলাকার আশ্রয়কেন্দ্রে শুকনো খাবার পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করেছি। থানা এবং জেলা পুলিশের সদস্যরা নৌকাযোগে আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে খাবার পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করছেন। সিলেটের পুলিশ সুপার ফরিদ উদ্দিনসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বন্যাকবলিত এলাকায় কাজ করছেন বলে জানান তিনি।

সেনাবাহিনীর তরফ থেকে উদ্ধার কাজ পরিচালনার পাশাপাশি শুকনো খাবার ও ত্রাণ দেয়া হয়েছে।

সুনামগঞ্জে বন্যার বিভীষিকার চিত্র: টানা বর্ষণ আর ভারতের পাহাড়ি ঢলে ভয়াবহ বন্যায় কবলিত সিলেট ও সুনামগঞ্জ। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হাওরবেষ্টিত সুনামগঞ্জ। জেলাটির ১১টি উপজেলার সবই পানিতে তলিয়ে গেছে। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে সড়ক যোগাযোগ। বন্ধ রয়েছে নিত্যপণ্য সরবরাহ। টানা তিন দিন বিদ্যুৎহীন গোটা জেলা। একপ্রকার অন্ধকারে বসবাস করছে এই জেলার লাখ লাখ মানুষ। কারো বাড়িতে কোমরপানি, করো বাড়িতে বুকপানি। অনেকে বাড়ি ছেড়ে গবাদিপশু নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। কেউ আশ্রয় নিয়েছেন দোতলা-তিনতলা বাড়ির ছাদে, কেউবা আশ্রয় নিয়েছেন বাড়ির টিনের চালে, কেউ আবার আশ্রয় নিয়েছেন রাস্তার পাশে আটকে পড়া পরিত্যক্ত গাড়ির ছাদে।

সেখানেও এক অমানবিক পরিবেশ। নেই খাবার, নেই বিশুদ্ধ পানি। প্রাণ বাঁচাতে হাহাকার করছে শিশুরা। তীব্র খাবার সংকট পুরো জেলাতেই।

সরজমিনে দেখা যায়, রাস্তার পাশে পানিতে ডুবে আছে যানবাহন। তলিয়ে আছে বাড়িঘর। কোথাও কোনো শুকনো জায়গা নেই। গোটা জেলা যেন সুনসান বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। সিলেটের টোকেরবাজার ব্রিজ থেকে দক্ষিণ সুনামগঞ্জের পাগলাবাজার— এই ২৫ কিলোমিটার সড়কের দু’পাশে চোখে পড়ে বন্যার প্রলয়ঙ্করী ক্ষতচিত্র। ভয়াবহ এই বন্যায় আশ্রয়হীন মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছেন। যাদের ঘরবাড়ি পানিতে ডুবে গেছে তারা রাস্তার দু’পাশে অস্থায়ী ঘর বানিয়ে কোনোরকম বসবাস করছেন। কেউ আবার একতলা বাড়ির খোলা ছাদে আশ্রয় নিয়েছেন। অনেকে আবার রাস্তার পাশে পরিত্যক্ত ট্রাকের নিচে আশ্রয় নিয়েছেন। আবার যেসব গাড়ি বন্যার পানিতে সড়কের পাশে আটকে আছে সেসব গাড়ির ছাদে আশ্রয় নিয়েছে গৃহহীনরা। কেউ আবার ডুবে যাওয়া বাড়ির টিনের চালে তোশক বিছিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন।

তিনি জানান, রাস্তার পাশে আশ্রয় নেয়া অনেকে আমাকে জানিয়েছেন, বন্যায় তাদের বাড়িঘর ভেঙে গেছে। পানি কমলেও আশ্রয় নেয়ার মতো তাদের ঘর নেই। তাদের সব নিয়ে গেছে প্রলয়ঙ্করী বন্যা। তিনি আরো জানান, সুনামগঞ্জের বন্যাপীড়িতরা সবচেয়ে বেশি খাবার সংকটে ভুগছেন।

সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় নিত্যপণ্য সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। এতে জেলাজুড়ে খাবার সংকট দেখা দিয়েছে। আশপাশের দোকান থেকে যৎসামান্য শুকনো খাবার খেয়ে কোনোরকমে জীবন বাঁচাচ্ছেন তারা। খাবারের জন্য আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে মানুষ আহাজারি করছেন।

এদিকে বন্যার পানিতে ডুবে গেছে সুনামগঞ্জের কবরস্থান-শ্মশান। মানুষ মারা গেলে দাফন ও সৎকার করার কোনো জায়গা নেই। অনেকে মৃতদেহ নৌকাযোগে অন্য জেলায় নিয়ে যাচ্ছেন দাফন করার জন্য। সুনামগঞ্জে বন্যার পানি কিছুটা কমলেও এখনো বাড়িঘর ডুবে আছে। তলিয়ে আছে সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়কও। এদিকে তিন দিন ধরে বিদ্যুৎ না থাকায় সুনামগঞ্জের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করতে পারছেন না। অনেকে উদ্বেগ জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দিচ্ছেন।

এদিকে, পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানিয়েছে, সুরমা নদীর পানি সিলেট পয়েন্টে কিছুটা কমেছে, তবে বেড়েছে কানাইঘাটে। অন্য নদীগুলোর পানি বৃদ্ধিও অব্যাহত আছে। বিভাগীয় কমিশনার মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন জানান, দুই জেলায় এখন প্রায় ৪০ লাখ মানুষ পানিবন্দি।

তিনি বলেন, ‘বন্যার পাশাপাশি বিদ্যুৎহীনতা ও মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় মানুষের ভোগান্তি আরো বেড়েছে। উদ্ধার কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে। প্রশাসন বানভাসি মানুষের সহায়তায় সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

‘দুই জেলার বেশিরভাগ প্রধান সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় এবং মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় বিপদে পড়া মানুষের সঠিক তথ্য মিলছে না। প্রশাসন, গণমাধ্যম সবাইকেই তথ্য পেতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।’

এদিকে, পানিবন্দি মানুষের সহায়তায় শুক্রবার থেকে সিলেটে এবং শনিবার থেকে সুনামগঞ্জে কাজ শুরু করেছে সেনাবাহিনী। শনিবার থেকে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে নৌবাহিনীও। সেনাবাহিনীর এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল হামিদুল হক বলেন, সেনাবাহিনীর ১৭টি ব্যাটালিয়ন বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হয়ে সিলেট ও সুনামগঞ্জে উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছে। একটি প্যারা কমান্ড দলও এই কাজে যুক্ত হয়েছে।

সিলেটে গত বুধবার বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বৃহস্পতিবার তা ভয়াবহ রূপ নেয়। এদিন বিকেল থেকে দ্রুত বাড়তে শুরু করে পানি। তলিয়ে যায় সিলেট নগরের বেশিরভাগ এলাকা। বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জেলার কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলা। সড়কসহ এই দুই উপজেলার প্রায় পুরোটাই পানিতে তলিয়ে গেছে। সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কও পানির নিচে।

বন্যার পানির কারণে শুক্রবার বিকেলে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সব ধরনের বিমান চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়। শনিবার দুপুর দেড়টার দিকে সিলেট রেলস্টেশনও বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এতে সারাদেশের সঙ্গে আকাশ ও রেলপথে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে সিলেট।

টাঙ্গাইল, মুন্সীগঞ্জ ও শরীয়তপুরে বন্যা বিস্তৃতির শঙ্কা: আগামী ২৪ ঘণ্টায় টাঙ্গাইল, মুন্সীগঞ্জ ও শরীয়তপুর জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড। রোববার পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া সই করা পূর্বাভাসে এ তথ্য জানানো হয়।

পূর্বাভাসে পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, দেশের সব প্রধান নদ-নদীতে পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবহাওয়া অফিসের গাণিতিক মডেলভিত্তিক পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন ভারতের আসাম, মেঘালয় ও হিমালয় পাদদেশীয় পশ্চিমবঙ্গে মাঝারি থেকে ভারি এবং কোথাও কোথাও অতিভারি বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা রয়েছে। ফলে আগামী ৪৮ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা, সুরমা, কুশিয়ারা, তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমরসহ সব প্রধান নদ-নদীতে পানি সমতল বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর জেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। এছাড়া দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে।

সর্বোচ্চটা দিয়ে দুর্গতদের পাশে থাকব— সেনাপ্রধান: সেনাবাহিনী দুর্গত মানুষের সহায়তায় যা কিছু করা সম্ভব তা করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ঢাকা সাভারসহ বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টের সেনাসদস্যদের বন্যার্তদের সহায়তায় নিয়োজিত করা হয়েছে। অনেককে স্ট্যান্ডবাই রাখা হয়েছে। সিলেট অঞ্চলে যা হয়েছে, এমন দুর্যোগ আসতে পারে, সেটি ভাবনার অতীত ছিল বলেও মন্তব্য করেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ।

তিনি বলেন, এটা অভাবনীয় বিপর্যয়। রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে। আমরা দুর্গত মানুষের সহায়তায় সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। রোববার সিলেটে বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করে সেনাপ্রধান আরো বলেন, মানুষ দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। তাদের সহায়তায় সেনাসদস্যরা কী পরিমাণ কষ্ট করছে তা নিজে দেখতে এসেছি।

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেন সেনাপ্রধান। পরে উপজেলার বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্কে ত্রাণ বিতরণ করেন তিনি।

সাংবাদিকদের তিনি বলেন, সেনাবাহিনী এর চেয়ে ভালো কাজ করতে পারত কিনা— আমরা এই আলোচনায় যেতে চাই না। আমাদের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে চাই। তবে বৈরী আবহাওয়া, প্রবল স্রোত, টানা বৃষ্টি, নেটওয়ার্কহীনতা সত্ত্বেও সেনাসদস্যরা বন্যাকবলিতদের সহায়তায় কাজ করে যাচ্ছে।

পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুস্পষ্ট নির্দেশনা পাওয়ার কথাও জানান সেনাপ্রধান। বলেন, সেনাবাহিনী দুর্গত মানুষের সহায়তায় যা কিছু করা সম্ভব তা করে যাচ্ছে। এরইমধ্যে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ঢাকা, সাভারসহ বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টের সেনাসদস্যদের বন্যার্তদের সহায়তায় নিয়োজিত করা হয়েছে। অনেককে স্ট্যান্ডবাই রাখা হয়েছে।

সেনাপ্রধান বলেন, দ্রুত এই পানি নেমে যাবে বলে মনে হচ্ছে না। তবে বন্যার পানি কমলেও মানুষের দুর্ভোগ সহসা কমবে না। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিও হবে। পরবর্তী ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় সেনাবাহিনী প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমরা ত্রাণ ও চিকিৎসা প্রদান শুরু করেছি। সেনাসদস্যদের বলেছি কষ্ট যতই হোক মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই দুর্যোগ মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।

নয়া শতাব্দী/জেআই

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ