ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

জীবন-জীবিকা নিয়ে এ কেমন খেলা

প্রকাশনার সময়: ৩১ জুলাই ২০২১, ২২:৫১ | আপডেট: ৩১ জুলাই ২০২১, ২২:৫৬

বলা হলো ‘কঠোর লকডাউন’। সব বন্ধ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে ঢাকায় ঢোকা দূরে থাক খোদ রাজধানীতেও কেউ নাকি চলতে পারবে না! ঈদের পর কার্যত ‘হাস্যরসে’ পরিণত হলো এ ঘোষণা। সড়কে জট লাগাতে শুরু করল ব্যক্তিগত গাড়ির বহর। সাধারণ মানুষ ভ্যান-রিকশায় ছুটতে শুরু করল কিছুটা জীবনের তাগিদে, কিছুটা বিনা কারণে। আটক, জরিমানা, জেল সবই হলো। তবে কঠোর লকডাউন কেন শিথিল লকডাউনও বাস্তবায়ন করা গেল না।

‘নরম’ লকডাউনের চরম কৌতুকের মধ্যে রফতানিমুখী শিল্প-কারখানার মালিকরা অস্থির হয়ে উঠলেন। ‘ডলার’ হাতছাড়া হওয়ার শঙ্কার পাশাপাশি ব্যাংক লোন, দায়-দেনাসহ নানা কারণে তারা পাগলপারা হয়ে উঠেলেন। এমন অবস্থায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাফ বললেন, ‘তাদের অনুরোধ সম্ভবত আমরা রাখতে পারছি না।’ অর্থাৎ তিনি ইঙ্গিত করলেন, শিল্প কারখানা ৫ আগস্টের আগে খুলছে না। চাঁদ দেখার মতো শুক্রবার সন্ধ্যায় ঘোষণা এলো ১ আগস্টই খোলা যাবে রফতানিমুখী শিল্পকারখানা।

তবে কারখানা খোলার ঘোষণা এলেও বন্ধ রাখা হলো গণপরিবহন। একবারও কারো মনে হলো না লাখ লাখ মানুষ যে ঢাকার বাইরে, তারা ফিরবেন কীভাবে? শ্রমিকদের মধ্যে তৈরি হলো চাকরি হারানোর শঙ্কা। শ্রমমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ান বললেন, ১ আগস্ট কাজে যোগ না দিলে কারো চাকরি যাবে না! এই বলা কতটা কার্যকর হবে তার ফলোআপ কি সরকারের তরফ থেকে করা হবে? হয় কখনো, হয়েছে কখনো?

ফলাফল নিম্নআয়ের মানুষগুলো হাজার ভোগান্তি মাথায় নিয়ে বাড়তি টাকা খরচ করে ছুট দিলেন ঢাকার পানে। গার্মেন্টস খুলবেন ভালো কথা। বিআরটিসি বাসগুলো তো ডিপোতেই পড়ে আছে। শ্রমিক আনার কাজে নামিয়ে দেয়া যেত সেগুলো। ট্রেনের স্পেশাল সার্ভিস করে শুধু শ্রমিকদের নিয়ে আসা যেত। কারখানা মালিকদের কাছে থেকে আদায় করা যেত ভাড়া! কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই এলো হটকারী সিদ্ধান্ত! যেন সন্ধ্যায় বলা হলো ‘চাঁদ দেখা গেছে, কাল ঈদ।’

এমন অসময়ে ‘চাঁদ’ দেখায় বিপাকে পড়েছেন শ্রমিকরা। যদিও পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ জানায় আগে থেকে ঢাকায় অবস্থান কিংবা ইতোমধ্যে ঢাকায় চলে আসা শ্রমিকদের নিয়েই কারখানা চালু করা হবে।

এ বিষয়ে বিজিএমইএ’র ভাইস প্রেসিডেন্ট শহিদুল আজিম বলেন, আমাদের অনেক শ্রমিক ইতোমধ্যে ঢাকায় চলে এসেছেন। সব মিলিয়ে প্রায় ৭০ শতাংশ শ্রমিক ঢাকায় অবস্থান করছেন। তাদের নিয়েই আপাতত সীমিত পরিসরে কারখানা চালু করা হবে। তিনি জানান, এখনো যেসব শ্রমিক ঢাকার বাইরে আছেন তাদের ওপর কোনো চাপ নেই। তারা ধীরে ধীরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে আসবেন।

কিন্তু বাস্তবে ঘটছে উল্টো। গ্রামে থাকা শ্রমিকদের জোর করে কর্মস্থলে আসতে চাপ দিচ্ছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। কঠোর লকডাউনের মধ্যে অফিস না করলে ছাঁটাইয়ের হুমকি দেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন শ্রমিকরা। সব মিলিয়ে কর্মস্থলে ফিরতে রাস্তায় নামতে বাধ্য হন অনেকে। মহাসড়কে দেখা দেয় ভিড়। ঢাকা ফিরছেন এ খাতে জড়িত অসংখ্য মানুষ। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় কয়েকগুণ ভাড়া দিয়ে ফিরছেন তারা। বেশিরভাগেরই স্বাস্থ্যবিধি মানতে কার্পণ্য করতে দেখা গেছে।

রুবেল হোসেন নামের অ্যাপেক্স টেক্সটাইলের এক কর্মীর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। তিনি নয়া শতাব্দীকে বলেন, এই করোনা মহামারির মধ্যেও অফিস খুলেছে। বাড়িতে ছিলাম, কিন্তু যথাসময়ে অফিসে উপস্থিত থাকতে বলছে কর্তৃপক্ষ। অনুপস্থিত থাকলে ছাঁটাইয়ের কবলে পড়ব। তাই চাকরি বাঁচাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফিরছি। বিজিএমইএ’র ঘোষণার বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, মুখে এমন বলে ঠিকই। কিন্তু বাস্তবে তার উল্টোটা ঘটে। অফিস থেকে সরাসরি জানিয়ে দিয়েছে আসতেই হবে। মাগুরা থেকে আসা বিল্লাল হোসেন জানান, কালকে গার্মেন্ট চালু হবে। এ কারণে সকাল সকাল বাড়ি থেকে রওনা দিয়েছি। যাতে ঠিকমতো পৌঁছাতে পারি। কিন্তু দৌলতদিয়া ঘাটে এসে মানুষের ভিড়ে পড়তে হয়েছে। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে ফেরি পার হয়েছি।

ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে আসা ফয়সাল হোসেন জানান, সকালে ডিউটিতে যোগ দিতে হবে। সময়মতো না গেলে সমস্যা হবে। কারণ এমনিতেই ঈদের পর থেকে গার্মেন্টস বন্ধ ছিল। অনেক কাজ জমে আছে। এখন যদি ঠিকমতো ডিউটিতে যেতে না পারি মালিক কী করবে বলতে পারি না। তাই তো আগেই রওনা দিলাম। রাজবাড়ীর কামরুল হাসান জানান, ভাই কাল থেকে অফিস খুলবে। সময়মতো যাওয়া লাগবে। গার্মেন্টেসের চাকরি খুব ঝামেলার। যেভাবেই হোক সময়মতো ডিউটিতে যোগ দিতে হবে। কোনো কারণে যদি চাকরিটা যদি যায়। না খেয়ে মরতে হবে। তাই তো ভাইরাসের মধ্যেও ঝুঁকি নিয়ে যাইতেছি।

সরকারের এমন আচরণ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা। জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. লেলিন চৌধুরি নয়া শতাব্দীকে বলেন, এমনিতেই দেশে এখন সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি চলছে। এতদিন সংক্রমণের হার কমবেশি ৩০ শতাংশের আশপাশে। লকডাউন চলছিল। এর আগে বেশ কয়েকটি লকডাউন বা কঠোর বিধিনিষেধ ব্যর্থ হওয়ার পরে সরকারের পক্ষ থেকে ধারণা দেয়া হয়েছিল এই দুই সপ্তাহের লকডাউন সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। সে অনুযায়ী শুরুটাও হয়েছিল। কিন্তু আমরা দেখলাম ৮ম দিনে এসে ৯ম দিনে গার্মেন্টস খুলে দিল। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় গাদাগাদি করে নানান কায়দায় মানুষ কষ্ট করে আসছেন। এর মধ্যে দিয়ে করোনা বিস্তৃত হওয়ার একটা অনুকূল পরিবেশ তৈরি হবে। এই মানুষগুলোর সঙ্গে মানবতার ব্যবহার করা হচ্ছে এটিও সঠিক হচ্ছে না।

এমন করলে মানুষ সরকারের কথা ভবিষ্যতে বিশ্বাস করবে না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পরেরবার সরকার যে ঘোষণাগুলো করবে, মানুষ কিন্তু এগুলোর প্রতি আস্থা রাখবে না। কারণ এত ঢাকঢোল পেটানোর যে লকডাউন তা যদি এভাবে হয়ে যায়। তাহলে অন্যগুলো তো আরো সহজেই ভুলে যাবে। ফলে করোনা ছড়িয়ে পড়ার একটা বিস্তৃত পরিবেশ পাবে। আমাদের শঙ্কা হচ্ছে সামনের সপ্তাহে করোনা সংক্রমণ আরো বেড়ে যায় কিনা? সেটা বেড়ে গেলে তো সমস্যা।’

হাসপাতালের বর্তমান পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে ডা. লেলিন চৌধুরি বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালের সামর্থ্যরে শেষ সীমা এখন অতিক্রম করছে। হাসপাতালে এখন জায়গা নেই, এর মধ্যে আবার ডেঙ্গু বাড়ছে। সব মিলিয়ে আমরা এক ধরনের ভীতিজনক অবস্থার দিকে অগ্রসর হচ্ছি। এবং এটি খুবই বিস্মিত হওয়ার মতো ব্যাপার যে, ৫ দিন গার্মেন্টস বন্ধ রাখলে দেশ ডুবে যেত অথবা তাদের কন্ট্রাক্ট বাতিল করা হতো এমন কথার পরিপ্রেক্ষিতে গার্র্মেন্টস খুলে দেয়া একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। ’

তিনি আরো বলেন, ‘গার্মেন্টস মালিকরা দাবি করছেন যে, সবচেয়ে কম সংক্রমণ গার্মেন্টসে। আমাদের কথা একেবারে ক্লিয়ার যে, যেসব স্থানে কম সংক্রমণ সেসব স্থানের গার্মেন্টস খুলে দেয়া হোক। আর যেখানে বেশি সংক্রমণ তাহলে সেখানের গার্মেন্টসগুলো বন্ধ রাখা হোক। আজকের মানুষ যেভাবে এসেছে তা দেখে আমি ব্যথিত।’

জানা গেছে, সারাদেশ থেকেই মানুষ ঢাকার উদেশে রওয়ানা দিয়েছেন। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় চরম ভোগান্তি নিয়েই ফিরছেন তারা। গুনতে হচ্ছে কয়েকশ’ গুণ বেশি ভাড়া। বিভিন্ন এলাকা থেকে নয়া শতাব্দীর প্রতিনিধিদের পাঠানো সংবাদ থেকে এ তথ্য জানা যায়।

বরিশাল প্রতিনিধি শামীম আহমেদ জানান, গার্মেন্টস খোলার খবরে শনিবার সকালে বরিশালে রাজধানীমুখী পোশাক শ্রমিকদের ঢল নেমেছে। কঠোর লকডাউনের কারণে যাত্রীবাহী বাস চলাচল না করায় মোটরসাইকেল, বিভিন্ন ধরণের থ্রি-হুইলার ও পণ্যবাহী যানবাহনে নানান কৌশলে যাত্রীরা ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা দিয়েছেন। অনেকেই কোনো ধরণের যানবাহন না পেয়ে হেঁটেই সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।

সব মিলিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন পোশাক শ্রমিকরা। লকডাউনে সব যানবাহন বন্ধ থাকায় নগরীর নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল এলাকায় শনিবার সকাল থেকে রাজধানীমুখী পোশাক শ্রমিকদের ভিড় বাড়তে থাকে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাস টার্মিনাল এলাকায় লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে। তবে যাত্রীবাহী কোনো যানবাহন না থাকায় রাজধানী পর্যন্ত এত দূরের পথ কীভাবে তারা পৌঁছাবেন, এ নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন পোশাক শ্রমিকরা।

ফুলপুর (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি মো. খলিলুর রহমান বলেন, লকডাউনের নবম দিন শনিবার স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে ময়মনসিংহের ফুলপুর বাসস্ট্যান্ডে দেখা গেছে ঢাকামুখী পোশাক শ্রমিকদের ঢল। পোশাক কারখানা খুলে দেয়ার সিদ্ধান্তে পোশাক শ্রমিকরা লকডাউন উপেক্ষা করেই বিভিন্ন কৌশলে ঢাকায় যাওয়ার চেষ্টা করছেন। ময়মনসিংহের ফুলপুর থেকে পণ্যবাহী ট্রাকে, পিকআপ, মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকারসহ বিভিন্ন ধরনের থ্রি-হুইলার ও পণ্যবাহী যানবাহনে নানা কৌশলে গাদাগাদি করে ঢাকার দিকে ছুটছেন কর্মজীবী মানুষ। কোথাও মানা হচ্ছে না ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধি।

গুরুদাসপুর (নাটোর) উপজেলা সংবাদদাতা মেহেদী হাসান তানিম জানান, চলমান কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যেই শিল্পকারখানা খুলে দেয়ায় ঈদের সময় বাড়িতে আসা কর্মজীবী মানুষেরা ঢাকায় ফিরতে শুরু করেছেন। শনিবার সকাল থেকেই গুরুদাসপুরের কাছিকাটা বিশ^রোড মোড় থেকে বৃষ্টি উপেক্ষা করে পণ্যবাহী ট্রাকে গাদাগাদি করে নিজ নিজ কর্মস্থলে ছুটছেন কর্মজীবী মানুষ। যাত্রীদের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব বা স্বাস্থ্যবিধি মানতে দেখা যায়নি।

ঝিনাইদহ প্রতিনিধি জাফর উদ্দিন রাজু বলেন, শিল্পকারখানা খোলার খবরে শনিবার সকাল থেকেই ঝিনাইদহ শহরের কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে ঢাকাগামী যাত্রীদের প্রচণ্ড ভিড় দেখা যায়। বিভিন্ন স্থান থেকে ইজিবাইক, ভ্যান, রিকশাযোগে টার্মিনালে এসে হাজির হচ্ছেন তারা। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছেন এই কর্মজীবী মানুষেরা। কাজে যোগ দিতে ইজিবাইক, মাহেন্দ্রসহ ছোট ছোট যানে ঢাকায় ফিরতে হচ্ছে তাদের। এক জেলা থেকে অন্য জেলায় গিয়ে সেখান থেকে নতুন বাহনে ছুটছেন তারা। যাত্রীদের অতিরিক্ত চাপে ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তাদের। কয়েকগুণ বেশি ভাড়া গুনতে হচ্ছে তাদের। যানবাহন না পেয়ে অনেককে বসে থাকতে দেখা গেছে।

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি গোলাম মাসুদ জানান, রফতানিমুখী শিল্পকারখানা খুলে দেয়ার খবরে ঢাকায় ফিরছেন গার্মেন্টসকর্মীরা। কুড়িগ্রামের চিলমারী ঘাটে ঢাকামুখী যাত্রীদের তীব্র ভিড় দেখা গেছে।

লৌহজং (মুন্সীগঞ্জ) প্রতিনিধি তরিকুল ইসলাম সাইম বলেন, দেশের রফতানিমুখী শিল্প কলকারখানা খুলে দেয়ায় গতকাল শিমুলিয়া-বাংলাবাজার ফেরিঘাটে ঢাকামুখী যাত্রীদের ভিড় বেড়েছে। শনিবার সকাল থেকে কঠোর বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌরুটের ফেরিগুলোতে যাত্রী ও ব্যক্তিগত যানবাহন পারাপারের হিড়িক পড়েছে। উত্তাল পদ্মা, বৈরী আবহওয়ার মধ্যেও ফেরিতে নদী পার হচ্ছেন শত শত যাত্রী ও ব্যক্তিগত যানবাহন। যাত্রীদের কারো কারো মুখে মাস্ক থাকলেও শারীরিক দূরত্ব বা স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই নেই।

মাদারীপুর প্রতিনিধি শিব শংকর রবিদাস জানান, গার্মেন্টসকর্মীদের চাপে বেসামাল পরিস্থিতি বাংলাবাজার-শিমুলিয়া ফেরিঘাট। ফলে বাড়ানো হয়েছে ফেরি। যাত্রীদের চাপে ফেরিতে জরুরি গাড়ি ওঠাতে হিমশিম খাচ্ছে। গার্মেন্টসসহ রফতানিমুখী কলকারখানা খোলার ঘোষণায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে বিআইডব্লিউটিসি সূত্র দাবি করেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ফেরির সংখ্যা ৬ থেকে বাড়িয়ে ১০ করা হয়েছে। লঞ্চসহ অন্যান্য নৌযান বন্ধ রয়েছে। ফেরিতে স্বাস্থ্যবিধি মানার তেমন কোনো লক্ষণ নেই।

মধুখালী (ফরিদপুর) প্রতিনিধি সালেহীন সোয়াদ সাম্মী জানান, রোববার খুলছে রফতানিমুখী গার্মেন্টস ও শিল্পকলকারখানা। সরকারের এ ঘোষণার পর শনিবার ভোর থেকে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে দেখা গেছে শ্রমিকদের ঢল। ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে কর্মস্থলে ফেরা শ্রমিকদের আনাগোনা বাড়তে শুরু করে।

গণপরিবহন বন্ধ থাকায় খোলা ট্রাক, পিকআপ, প্রাইভেটকার, সিএনজি, মাহেন্দ্র, অটো ও মোটরসাইকেলযোগে কয়েকগুণ বেশি ভাড়া দিয়ে গাদাগাদি করে গন্তব্যে যাচ্ছেন তারা।

মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি মো. আজিজুল হাকিম জানান, কর্মস্থলে ফিরত মানুষের চাপ বেড়েছে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ফেরিঘাটে। প্রতিটি ফেরিতে দেখা গেছে যাত্রী ও কর্মস্থলে ফিরতে মানুষের উপচেপড়া ভিড়। গাদাগাদি করে গা-ঘেঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে ফেরিতে। মানা হচ্ছে না সামাজিক দূরত্ব।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) সূত্রে জানা যায়, রোববার থেকে দেশের গার্মেন্টস ও রফতানিমুখী শিল্পকারখানা চালু হবে। ঈদের আগে এসব প্রতিষ্ঠানের লোকজন বাড়িতে গিয়েছে পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে। এখন শিল্পকারখানা চালু হওয়ায় কর্মজীবী মানুষরা কর্মস্থলে ফিরতে শুরু করেছেন। এ কারণে পাটুরিয়া ঘাটে ফিরতি মানুষের চাপ বেড়েছে।

ময়মনসিংহ ব্যুরো আজহারুল হক জানান, করোনাঝুঁকি সঙ্গে নিয়ে জীবিকার তাগিদে হেঁটে, পিকআপ ভ্যান ও ট্রাকে করে ঢাকায় ছুটছেন গামেন্টস শ্রমিকরা। বসে নেই বেসরকারি চাকরিজীবীরাও। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সাধারণ ছুটি থাকলেও আজ রোববার থেকে খুলছে বিভিন্ন গামেন্টসসহ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এ অবস্থায় মনে করোনা আতঙ্ক থাকলেও বাধ্য হয়েই কর্মস্থলে ফিরছেন হাজার হাজার নারী-পুরুষ। শ্রমিকদের কথা একটাই করোনার ঝুঁকি থাকলেও জীবিকার তাগিদে কর্মস্থলে পৌঁছতেই হবে। না হলে চাকরিটা বাঁচানো যাবে না।

নোয়াখালী প্রতিনিধি রনজিত চন্দ্র কুরী জানান, শিল্পকলকারখানা খোলার খবরে গতকাল সকাল ঢাকামুখী মানুষের ভিড়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ ভিড় বাড়তে থাকে। জীবন ও জীবিকার তাগিদে ঝুঁকি নিয়ে ঢাকা যাচ্ছেন গার্মেন্টসকর্মীরা। কাজে যোগ না দিলে চাকরি থাকবে না বলে অভিযোগ তাদের।

পাবনা প্রতিনিধি কাজী বাবলা বলেন, চলমান লকডাউনের মধ্যে আজ রোববার থেকে রফতানিমুখী সব মিলকলকারখানা খুলে দেয়ায় চাকরি বাঁচাতে কর্মজীবীরা ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন। পাবনার কাজিরহাট ফেরিঘাটে নানান বয়সী মানুষের উপচেপড়া ভিড়ে কোনোভাবেই স্বাস্থ্যবিধি মানানো সম্ভব হচ্ছে না। গতকাল শনিবার ছেড়ে যাওয়া তিনটি ফেরিতে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। মানুষের ভিড়ে তিনটি ফেরিতে কোনো যানবাহন পার করা সম্ভব হয়নি।

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি লিখন আহমেদ বলেন, গার্মেন্টস খোলার খবরে ট্রাকে করে ঢাকায় ছুটছেন মানুষ। সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল, কড্ডার মোড়, পাঁচলিয়া, নলকা মোড় ও সয়দাবাদ থেকে বৃষ্টি উপেক্ষা করে পণ্যবাহী ট্রাকে গাদাগাদি করে ঢাকায় ছুটছেন কর্মজীবী মানুষেরা। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে ভেঙে ভেঙে মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে ভিড় করছেন ঢাকামুখী যাত্রীরা। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় ট্রাকে করে ঢাকার উদ্দেশে ছুটছেন কর্মজীবী নিম্ন আয়ের মানুষেরা।

শ্রীপুর (গাজীপুর) প্রতিনিধি এস এম জহিরুল ইসলাম জানান, রোববার খুলছে পোশাক কারখানা। কারখানা খুলে দেয়ার ঘোষণায় হাজার হাজার শ্রমিক গাজীপুর, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ ফিরতে শুরু করেছেন। শনিবার বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিভিন্ন জেলা থেকে দলবেঁধে শ্রমিকদের কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে ছুটতে দেখা গেছে। গণপরিবহন চলাচল বন্ধ থাকায় শ্রমিকেরা পিকআপ, ট্রাক ও ইঞ্জিনচালিত ভ্যান ও রিকশায় চড়ে বাড়ি থেকে আসছেন। যানবাহন না পেয়ে অনেকে হেঁটে ছুটছেন গন্তব্যের পথে। আবার অনেকে গাড়ি পাওয়ার আশায় বিভিন্ন স্ট্যান্ডে ও সড়কের গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে মোড়ে জড়ো হয়ে অপেক্ষা করছেন দীর্ঘক্ষণ। এতে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকিও বাড়ছে।

টাঙ্গাইল প্রতিনিধি আব্দুল্লাহ আল নোমান জানান, রোববার থেকে পোশাকশিল্প খোলার ঘোষণায় কঠোর লকডাউনের মধ্যে কর্মস্থলে ফিরতে শুরু করেছেন পোশাকশিল্পের কর্মীরা। এতে বিভিন্ন প্রকার যানবাহনের চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কে। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় খোলা ট্রাক, রিকশা, অটোরিকশা, মোটরসাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে কর্মস্থলে ফিরছে তারা। আর এতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে তাদের।

নাটোর প্রতিনিধি এম.এম আরিফ বলেন, শনিবার সকাল থেকেই নাটোরে গুরুদাসপুরের কাছিকাটা বিশ্বরোড মোড় থেকে বৃষ্টি উপেক্ষা করে পণ্যবাহী ট্রাকে গাদাগাদি করে ঢাকায় ছুটছে কর্মজীবী মানুষরা। যাত্রীদের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধির কোনো বালাই দেখা যায়নি।

রংপুর ব্যুরো চীফ আব্দুস সালাম জানান, মহামারি নিয়ন্ত্রণে লকডাউনের মধ্যে কারখানা খুলে দেয়ায় কর্মস্থলে ফিরতে বড় বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হচ্ছে পোশাককর্মীদের। গার্মেন্টস খুলে দেয়ায় কাজে যোগ দিতে ট্রাক, পিকআপ ভ্যান ও মাইক্রোবাসে ছুটছেন মানুষ। পথের দুর্ভোগ নিয়ে শনিবার ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরমুখী এসব পোশাককর্মী বলছেন, একে চাকরি হারানোর ভয়, অন্যদিকে পথে কিছু নেই। তাদের বিপদ দুই দিকেই।

নয়া শতাব্দী/এম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ