লিমা আক্তার (৫০)। স্বামী মারা গেছেন ২৫ বছর আগে। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। তারা এখন তাদের স্বামীর বাড়িতে। লিমা আক্তারের স্বামী মারা যাওয়ার পর তার দুই মেয়ে ও দেবর লিমার স্বামীর সম্পত্তি লিখে নিয়েছে। তাকে কিছুদিন বাড়িতে রাখার পর বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। এরপর নিরুপায় হয়ে মানুষেল বাড়িতে থেকেই চলছিল তার দিন। সবশেষ তার ঠিকানা হয় শান্তিনিবাস।
লিমা আক্তার প্রায় ৪ বছর রয়েছেন শান্তিনিবাসে। এই সময়ের ঈদ কাটে তার এখানেই। আপনজন থেকেও নেই, শান্তিনিবাসেই ঈদ কাটে লিমা আক্তারের। কথাগুলো বলতে বলতেই হু হু করে কেঁদে ফেলেন লিমা আক্তার। ঈদের সময়ের স্মৃতিগুলো মনে করে এই নারী বার বার তার মুখে কাপড় দিয়ে চোখ মোছার চেষ্টা করছিলেন।
লিমা আক্তার বলেন, ঈদের দিন মেয়েরা কত বায়না করতো, ওর বাবার (স্বামী) কাছে টাকা চাইতে ভয় পেতো তাই আমার কাছে চাইতো, আমি ওদের বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে ওদের খেলনা কিনে দিতাম। ঈদের দিন সকালে সেমাই রান্না করতাম সবাই মিলে কি যে আনন্দ করতাম। এখন সেই মেয়েরা আমার খবরও রাখে না। ঈদের দিন আসলে আমার স্মৃতিগুলো মনে পড়ে খুব কষ্ট হয়। তারপরও এখানে যারা আছে তাদের সাথে মিলেমিশে ঈদের দিনটি কাটাই।
লিমা আক্তারের পাশেই মুখে হাত দিয়ে এদিক সেদিক তাকাচ্ছিলেন আরেক মা হাসিনা বেগম। তারও বয়স ষাটোর্ধ। দেখে মনে হলো নিজের ফেলে আসা সুখ-দুঃখের স্মৃতি গুলো মনে পড়ছে তার। কথা হয় হাসিনা বেগমের সাথে।
তিনি জানান, তার বাড়ি গোপালগঞ্জের মোকছেদপুর উপজেলায়। তিনি এখানে রয়েছেন প্রায় ১০ বছর। স্বামী আব্দুল জব্বার বিশ্বাস মারা গেছেন অনেক আগে। তিনি দুই ছেলে ও এক মেয়ের জননী। এক ছেলে ও এক মেয়ে মারা গেছে। আর এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। মেয়ে বিয়ের পর তার থাকার শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে দিয়েছেন মেয়ে। দূর দূর করে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া তাকে। বিভিন্ন স্থান ঘুরে এক পর্যায়ে তার আশ্রয়স্থল হয় শান্তিনিবাস।
হাসিনা বেগম বলেন, কতদিন আপনজনের সাথে ঈদ করি না। শান্তিনিবাসের সকলের সাথে ঈদ করি। ভালোই আছি। তবে মাঝে মধ্যে মনে পড়ে মেয়ের কথা। আমার মনে পড়লেও মেয়ে আমার কোনো খোঁজও নেয় না।
শুধুমাত্র লিমা আক্তার, হাসিনা বেগমই নয় সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রাধীন শহরের টেপাখোলা এলাকায় অবস্থিত শান্তিনিবাসে রয়েছে ১১ জন নারী ও ৪ জন পুরুষ। স্বপ্নময় শৈশব ছিলো তাদের। রঙিন কৈশোরও ছিলো। যৌবনে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে কতো আনন্দই না করেছেন, সন্তানের সব চাওয়া পুরণ করেছেন, সন্তানের যাতে কোনো কষ্ট না হয়, তার পূর্ণ খেয়াল রেখেছেন, ঈদ উৎসবে সন্তানের প্রত্যেকটি বায়না মিটিয়েছেন, অথচ আজ তাদের ঠাই হয়েছে শান্তিনিবাসে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শান্তিনিবাসে ১১ জন নারীর জন্য রয়েছে ১১টি আলাদা আলাদা থাকার ব্যবস্থা। পুরুষদের জন্যও আলাদা থাকার ব্যবস্থা। খাওয়া-দাওয়া, চিকিৎসাসহ সব ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে এখানে।
তিন বেলা ভালো মানের খাবারের ব্যবস্থা। রয়েছে চিকিৎসার সু-ব্যবস্থা। এর মধ্যে তিনি জন নারী খুবই অসুস্থ্য, তাদের দেখভাল করার জন্য রয়েছে আয়া।
আরেকজন আয়শা বেগম। বয়স আনুমানিক ৭৫ বছর। বাড়ি ছিল ফরিদপুর সদর উপজেলার সাদিপুর এলাকায়। ছোট বেলায় মা-বাবা দুজনেই মারা যান। মা-বাবা মারা যাওয়ার পর চাচারা সব সম্পত্তি নিয়ে নেন। এরপর বাড়ি থেকে তাকে বের করে দেওয়া হয়। জন্ম থেকেই তার একটি পা বিকলঙ্গ। ওই অবস্থাতেই আজ এবাড়ি কাল ওবাড়ি এভাবে কাটে তার দিন। নিজে অসুস্থ্য থাকার কারণে বিয়েও করা হয়নি। অবশেষে স্থানীয়দের সহায়তায় শান্তিনিবাসে ঠাই হয় তার। প্রায় ১৫ বছর এখানেই রয়েছেন তিনি।
আয়শা বেগম বলেন, দীর্ঘদিন রয়েছি এখানে। খুব ভালো আছি। অন্যের বাড়িতে থাকার সময় গালমন্দ সহ্য করে থাকতে হতো। এখানে সবাই খুব ভালোবাসে, ভালো আছি। যাওয়ার কোথাও কোনো জায়গা নেই, তাই ঈদের দিনটি এখানে যারা আছে তাদের সাথেই কাটাই, ভালো লাগে।
ফারুক মিয়া (৭৫)। বাড়ী ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলায়। তিনি ৪ মেয়ে ও ২ ছেলের জনক। শান্তিনিবাসে রয়েছেন ৪ বছর।
ফারুক মিয়া জানান, প্রায় ১০ বছর আগে আমার স্ত্রী ও ছেলে, মেয়েরা চক্রান্ত করে সকল সম্পত্তি তাদের নামে করে নেয়। এরপর আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। এরপর নিরুপায় হয়ে বিভিন্ন স্থানে দিন কাটে আমার। পরে ঠাই পাই শান্তিনিবাসে। আমি অসুস্থ্য, পরিবারের সবার কথা খুব মনে পড়ে। কিন্তু কেউই আমার খোঁজ নেয় না।
তিনি বলেন, ছেলে মেয়ের জন্য কিনা করেছি, তাদের কত আবদার পূরণ করেছি অথচ আমাকে ছুড়ে ফেলে দিলো ওরা। খুব মনে পড়ে, ঈদের দিন খুব বেশি মনে পড়ে। এক সময় ছেলেকে সাথে নিয়ে ঈদের নামাজ আদায় করেছি, কতকিছু কিনে দিয়েছি। আজ আমি ওদের কাছে বোঝা হয়ে গেছি। শান্তিনিবাসে ভালো আছি, সবাই খুব যত্ন করে।
সাজ্জাদ হোসেন (৬৫)। এখানে রয়েছেন ৩ বছর। চাকরি করতেন। স্ত্রী, ছেলে রয়েছে। চাকুরি থেকে অবসরের পর স্ত্রী, ছেলের সাথে মান অভিমানে চলে এসেছেন শান্তিনিবাসে। কেউ খোঁজ নেয় না তার।
সাজ্জাদ হোসেন বলেন, বাড়ি, সম্পত্তি সবকিছু পরিবারের সদস্যদের দিয়ে দিয়েছি। এখন আমি বাস করছি শান্তিনিবাসে। ভালো আছি। এখানকার সবাইকে আপন করে নিয়েছি। ঈদের আনন্দ এখানকার সবার সাথে ভাগাভাগি করে নেই।
রোকেয়া বেগম (৬৫)। বাড়ি জেলার মধুখালী উপজেলা সদরে। তিনি এখন খুবই অসুস্থ্য। কথা বলতে পারেন না ঠিকমত। বিছানার উপরই খাওয়া-দাওয়া, বাথরুম সবই। ভাঙ্গা-ভাঙ্গা গলায় কথা বলেন।
রোকেয়া বেগম বলেন, আমার কেউ নেই। স্থানীয়রা ৩বছর আগে আমাকে এখানে রেখে যায়। এরপর এখানেই আছি। এটাই আমার শেষ ঠিকানা। অসুস্থ্যতার কারণে তার মনেই নেই ঈদের কথা। আগামীকাল ঈদ একথা শুনতেই মুখে হাসি ফোটে তার।
সমাজসেবা পরিচালিত শান্তিনিবাসের উপ-তত্বাবধায়ক তাহসিনা জামান বলেন, শান্তিনিবাসে ১১জন নারী ও ৪ জন পুরুষ রয়েছে। এর মধ্যে তিন জন নারী খুবই অসুস্থ্য, তাদের সুস্থ্য করতে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এখানে যারা রয়েছেন তাদের থাকা-খাওয়া, চিকিৎসাসহ সকল ধরনের ব্যবস্থা এখান থেকেই করা হয়।
তিনি আরো বলেন, ঈদ উপলক্ষে সকলকে নতুন কাপড় দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ঈদের দিন সকালে রুটি-সেমাই, মিষ্টিসহ বিভিন্ন খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দুপুরে ও রাতে পোলাও, মুরগির রোস্ট, গরু এবং খাসির মাংসসহ বিভিন্ন খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। চাকরির পেশাগত দায়িত্ব পালনই নয়, এসকল মা-বাবাদের সেবা করতে পেরে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি।
নয়া শতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ