ভারতে এক কেজি ভোজ্যতেলের দাম ১৬২ রুপি— যা বাংলাদেশি টাকায় ১৮৩ টাকা। বাংলাদেশের বাজারে বর্তমানে প্রতি লিটার ভোজ্যতেল বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকা। ভারতীয় মুদ্রায় যা দাঁড়ায় ১৪১ দশমিক ৬৪ রুপি। উভয় দিক থেকেই ভারতে তেলের দাম ২০ দশমিক ৩৬ রুপি (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২৩ টাকা) বেশি। ফলে বাংলাদেশ থেকে ভারতে তেল পাচার হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের দাবি— পাচারের শঙ্কা নয়, পাচার এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। এ কারণে, পাচার রোধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা চাওয়ার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। ভোজ্যতেল পাচার প্রতিরোধে চিঠিটিতে স্বাক্ষর করেছেন অধিদফতরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান। ভোক্তা অধিদফতরের পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, তেল পাচার হয়ে যাচ্ছে— এমন কিছু অভিযোগ আমরা পেয়েছি। পাচার প্রতিরোধে কাজ করার মতো কোন উইং আমাদের নেই। এ কারণে আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছি। যাতে করে বাণিজ্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য।
ভারতের ডিপার্টমেন্ট অব কনজ্যুমার অ্যাফেয়ার্সের (প্রাইস মনিটরিং সেল) তথ্য বলছে, গত ১৬ মার্চ থেকে ভারতে বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের গড় দাম ১৬২ রুপি— যা বাংলাদেশি টাকায় রূপান্তরিত (১ টাকা ১৩ পয়সা) করলে দাঁড়ায় ১৮৩ টাকার বেশি।
ভারতীয় গণমাধ্যম বলছে, ভারতে এডিবল ওয়েল বিক্রি হচ্ছে ১৭০-১৮০ রুপিতে। এর মধ্যে অবশ্য সয়াবিন, সানফ্লাওয়ার, পামসহ বিভিন্ন তেল রয়েছে। এই হিসেব করলে তেলের দাম পড়ছে ১৯২-২০৪ টাকার মধ্যে। বাংলাদেশে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম ১৩৬ টাকা, বোতলজাত ১৬০ টাকা এবং ৫ লিটারের বোতল ৭৬০ টাকা। তবে পাম ওয়েলের দাম এখনো ঠিক করা হয়নি। আগের দাম প্রতি লিটার ১৩৩ টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই সুযোগে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বর্ডার দিয়ে তেল পাচার করছে।
ওই চিঠিতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে। সরকার ভোজ্যতেলের যে মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে তা পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের মূল্যের চেয়ে তুলনামূলক কম। ফলে বাংলাদেশ থেকে ভোজ্যতেল পার্শ্ববর্তী দেশে বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলীয় সীমানা দিয়ে পাচার হচ্ছে।
পাইকারি ব্যবসায়ী নাকি পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলো এই তেল পাচার করছে তা উল্লেখ করা হয়নি এই চিঠিতে। তবে বাংলাদেশ থেকে পার্শ্ববর্তী দেশে যেন ভোজ্যতেল পাচার না হয় সে বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়ার অনুরোধ করা হয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে।
সম্প্রতি সরকার সয়াবিন তেলের উৎপাদন ও ভোক্তা পর্যায়ে ২০ শতাংশ এবং আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির আঁচ ভোক্তা পর্যায়ে কমিয়ে আনাই ভ্যাট কমানোর মূল কারণ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ভোজ্যতেল দাম কমানোর পর যদি পাচার হয়ে— তাহলে তো ঘাটতি থেকেই যাবে। তাহলে ভোক্তাকে চরমভাবে ভুগতে হবে। এ কারণে দাম কমিয়ে আনার পাশাপাশি পাচার রোধ করাটাও এখন চ্যালেঞ্জ।
বেসরকারি ভোক্তা অধিকার সংস্থা কনশাস কনজ্যুমার্স সোসাইটি (সিসিএস) এবং কনজ্যুমার ইয়ুথ বাংলাদেশ-এর (সিওয়াইবি) প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক পলাশ মাহমুদ বলেন, ভ্যাট কমিয়ে দাম নিয়ন্ত্রণের যে চেষ্টা তা পুরোপুরি ব্যর্থ হবে যদি পাচার রোধ করা সম্ভব না হয়। এর জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
ভোক্তা অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, চলতি মাসে ভোজ্যতেলের বাজারে যে অস্থিরতা তার পেছনে মূলত পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলোর সরবরাহ কমিয়ে দেয়ার বিষয়টিই উঠে আসছে।
সম্প্রতি কোম্পানিগুলোতে ভোক্তার বেশ কয়েকটি অভিযান সূত্রে জানা গেছে, গত ফেব্রুয়ারি শেষে যখন ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলো আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে সয়াবিন ও পাম অলিনের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবনা দেয় তখন সরকার তা বাতিল করে দেয়। কিন্তু এই সময় দাম বৃদ্ধি করতে না পেরে কোম্পানিগুলো তাদের সরবরাহ একেবারেই কমিয়ে করে দেয়। সরবরাহ কম থাকায় পাইকারি ব্যবসায়ীরাও বাড়তি দামে তেল বিক্রি শুরু করে। বাজারে একটি সংকট তৈরি হয়। সরবরাহ কমিয়ে দেয়ার এ ঘটনা বেশ কয়েকটি অভিযানে উঠে আসে।
কয়েকদিন ধরেই ভোক্তার কর্মকর্তারা সিটি, মেঘনা, এস আলম, টিকেসহ পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলোতে মনিটরিংয়ে যায়। এই মনিটরিংয়ে দেখা যায়, অনেক প্রতিষ্ঠানই সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। আবার এস আলম এই সময়েও ৭৯৫ টাকার ৫ লিটারের তেল ৮৩৫ টাকায় নতুন খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে, যা সরকার নির্ধারিত দামের বেশি।
আন্তর্জাতিক বাজারে আগে থেকেই ঊর্ধ্বমুখী ভোজ্যতেলের বাজারে নতুন করে সংকট তৈরি করছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। সয়াবিন ও পাম অলিনের দাম উঠে যায় টনপ্রতি ১৮০০-১৯০০ ডলারে। এর মধ্যে ইন্দোনেশিয়া পাম ওয়েল রফতানি কমিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর আর্জেন্টিনা তাদের সয়াবিন তেল ও সয়া মিলের রফতানি বন্ধের ঘোষণা দেয়। বাংলাদেশে প্রতি বছর সয়াবিন ও পাম অলিনের চাহিদা রয়েছে প্রায় ১৮ লাখ টন, যার পুরোটাই আমদানি নির্ভর।
নয়া শতাব্দী/এসএম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ