ঢাকা, রোববার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

মোজাইক পাথরের আড়ালে আসছে জাল রুপি

৪ দেশ ঘুরে যায় ভারতে * দেশি-বিদেশি চক্রের সন্ধানে গোয়েন্দারা
প্রকাশনার সময়: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০ | আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৯:৩৪

মোজাইক পাথরসহ বিভিন্ন নির্মাণ সামগ্রীর আড়ালে দেশে আনা হচ্ছে ভারতীয় জাল রুপি। পরে তা দেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচার করা হচ্ছে। এ কাজে যুক্ত রয়েছে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের দুটি পরিবার। এই পরিবারের কিছু সদস্য পাকিস্তানে বসে সাগর ও আকাশপথে জাল রুপি পাঠাচ্ছে। সম্প্রতি ১৫ লাখ জাল রুপিসহ ৪ জনকে গ্রেফতারের পর এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় দেশি-বিদেশি একাধিক সদস্যকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের গ্রেফতারে অভিযান চালানো হচ্ছে বলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান জোনের উপপুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান নয়া শতাব্দীকে জানান, গত বছর নভেম্বর মাসে খিলক্ষেত থানায় দায়েরকৃত সাত কোটি ৩৫ লাখ ভারতীয় জাল রুপি পাচারসংক্রান্ত একটি মামলা গুলশান বিভাগের কাছে আসে। ওই মামলার তদন্ত করতে গিয়ে আমানুল্লাহ ভূঁইয়া, কাজল রেখা, ইয়াসিন আরাফাত কেরামত ও নোমানুর রহমান খানকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে ১৫ লাখ জাল রুপি উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানান পাকিস্তান থেকে বিভিন্ন দেশ ঘুরে দেশে জাল রুপি আনছে। তারা নির্মাণ সামগ্রীর আড়ালে চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনারে জাল রুপি আনার পর তা বিভিন্নস্থানে রেখে লোক মারফত ভারতে পাচার করেছে বলে স্বীকার করেছে। তাদের দেয়া তথ্যমতে দেশি-বিদেশি আরো কিছু লোকজনের নাম পাওয়া যাচ্ছে। যাচাই-বাছাই শেষে তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে। জানা গেছে, গত ৭ ফেব্রুয়ারি গুলশান বিভাগের একটি টিম পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোড থেকে নোমানুর রহমান খানকে গ্রেফতার করে। এরপর তাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে সে পাকিস্তানে অবস্থানকারী তার ভাই মো. ফজলুর রহমান ওরফে ফরিদ বিভিন্ন সময়ে পাকিস্তান থেকে আকাশ ও সমুদ্রপথে বিভিন্ন পণ্য সামগ্রীর আড়ালে এবং একাধিক ব্যক্তির মাধ্যমে ভারতীয় জাল রুপির সুপার নোট বাংলাদেশে পাঠায় বলে স্বীকার করে। পাচারকৃত জাল রুপির বড় একটি অংশসহ তার অপর ভাই সাইদুর রহমান, ইমপোর্টার তালেব, সমন্বয়কারী ফাতেমা আক্তার সম্প্রতি গ্রেফতার হয়েছে এবং বাকি অংশ হাজারীবাগে অবস্থানকারী কাজল এবং আমানের কাছে রয়েছে বলে জানান। এরপর তার দেয়া তথ্যমতে, হাজারীবাগের ২১নং মনেশ্বর রোড থেকে ইয়াসির আরাফাত ওরফে কেরামত এবং আমান উল্লাহ ভূঁইয়াকে আটক করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে ১২ লাখ জাল রুপি উদ্ধার করা হয়। পরে তাদের দেয়া তথ্যমতে কাজল রেখার বাসায় তল্লাশি করে ৩ লাখ ভারতীয় জাল রুপি উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতার করা হয় কাজলকে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা পাকিস্তান থেকে আন্তর্জাতিক চক্রের মাধ্যমে ভারতীয় জাল রুপির সুপার নোট কৌশলে সংগ্রহ করে বিভিন্ন পণ্যে এবং লাগেজ পার্টির মাধ্যমে দেশে আনার পর কুরিয়ারের মাধ্যমে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের এলাকায় দিয়ে পাচার করে আসছিল বলে স্বীকার করে।

ডিসি মশিউর রহমান জানান, দীর্ঘদিন ধরে জাল রুপি পাচারকারী এ চক্রের কেন্দ্রে আছে মূলত দুইটি পরিবার। এরমধ্যে মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর থানা এলাকায় রয়েছে একটি পরিবার। এই পরিবারের অধিকাংশ সদস্য একসময় পাকিস্তানে অবস্থান করত। বর্তমানে এই পরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্য ফজলুর রহমান পাকিস্তানের করাচিতে অবস্থান করে উন্নত মানের জাল রুপি সংগ্রহ করে শুঁটকি মাছ, মোজাইক পাথর ও অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রীর বস্তায় সমুদ্রপথে বাংলাদেশ পাঠায়। এ কাজে তাকে সহযোগিতা করে তার ভাই সাইদুর রহমান রহমান, নোমানুর রহমান এবং ভগ্নিপতি শফিকুর রহমান। আমদানিকারকদের যোগসাজশে তারা পাকিস্তানের করাচি বন্দর থেকে শ্রীলঙ্কা হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনারে রাখা জাল রুপি খালাস করে। এরপর গোডাউনে মজুদ করা জাল রুপি বিভিন্নস্থানে বিক্রির পর সে টাকা আবার হুন্ডির মাধ্যমে পাকিস্তানে পাচার করে আসছিল।

তিনি জানান, মুন্সীগঞ্জের এ পরিবার ছাড়াও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গোমস্তাপুর উপজেলার বেনীচক গ্রামে রয়েছে কাজল রেখার পরিবার। চক্রের সদস্য হিসাবে রয়েছে তার স্বামী আমানুল্লাহ, ভাই কেরামত, বোন- শারমিন দোয়েল, ভগ্নিপতি সোনামিয়া, চাচা আয়নাল, ভাইগনা ফিরোজ, কিবরিয়া, ভাতিজা নেলসনসহ অনেকে। কাজল রেখা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গ্রেফতারকৃত গাড়িচালক আমান উল্লাহ ভূঁইয়ার দ্বিতীয় স্ত্রী। এ পরিবারের সদস্যরা জাল রুপি কেনার পর লাগেজ ও কুরিয়ারের মাধ্যমে চাঁপাইনবাবগঞ্জে নিয়ে আসে। এরপর বিভিন্ন সীমান্তবর্তী দিয়ে ভারতে পাচার করে। আমান উল্লাহ ভূঁইয়া মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সুনামগঞ্জ জেলা শাখার সরকারি গাড়িচালক। দীর্ঘ বত্রিশ বছর সরকারি চাকরির বয়সে অর্ধ যুগেরও বেশি সময় ধরে সে বাংলাদেশে জাল রুপি পাচার চক্রের বড় ডিলার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিল। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত পাকিস্তানি নাগরিক ফজলুর রহমান ওরফে ফরিদের সঙ্গে রয়েছে তার সরাসরি যোগাযোগ। ফজলু ওরফে ফরিদের পাকিস্তান থেকে জাল রুপি ইমপোর্টার, ডেলিভারি ম্যান, পারসেন্ট, টাকা লেনদেনের স্থান নির্ধারণ করে দিত। চালান হাতে পাওয়ার পর গ্রেফতারকৃত আমান, কাজল রেখা, ফাতিমা, আবু তালেব, সুলতান ও ফজলু রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে সেগুলো ভারতে পাচার করে। এক লাখ রুপির সুপার নোটের বিনিময় মূল্য গড়ে ৩৮ হাজার রুপি নির্ধারণ করা হতো। সেখান থেকে প্রতি লাখে তিন থেকে চার হাজার টাকা কমিশন পেতে কেরামত ও কাজলরেখা। সীমান্ত দিয়ে ম্যানুয়ালি জাল রুপি পাচার ছাড়াও সোনা মসজিদ স্থলবন্দর ড্রাইভারদের মাধ্যমে ফেনসিডিল, অস্ত্র, চোরাই মোবাইল ও গাঁজাসহ বিভিন্ন নিষিদ্ধ সামগ্রী কেনা-বেচায়ও জাল রুপি ব্যবহার হতো বলে তদন্তে উঠে এসেছে। বর্ডার পার করতে সহায়তা করত গোমস্তাপুর ও শিবগঞ্জ এলাকার মোস্তফা, হাবিল, আয়নাল, মাসুদ, নীলসন, একরাম ও ইয়াদুর।

পাকিস্তানে অবস্থানরত ফজলু ওরফে ফরিদ এক সময় কাপড়, খেলাধুলার সামগ্রী, শুঁটকি মাছের কার্টনে ভারতীয় জাল রুপি বাংলাদেশে পাঠাত। পরে বেশি পরিমাণ জাল রুপি পাঠানোর জন্য পাথরের বস্তা বেছে নেয় বলে তদন্তে উঠে এসেছে।

জানা গেছে, এ ঘটনার আগে গত ২০ মার্চ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ৫০ লাখ ভারতীয় রুপিসহ চাঁদপুরের বাসিন্দা ফকরুলকে গ্রেফতার করা হয়। চার দেশে ঘুরে ওই রুপি বাংলাদেশে আসে বলে ফকরুল ইসলাম স্বীকার করেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ফকরুল জানান, দুবাইতে তার কাছে এক অপরিচিত ব্যক্তি জাল রুপিগুলো দেশে আনার জন্য দেন। কথা ছিল গ্রিন চ্যানেল পার হওয়ার পর ফকরুলের মোবাইলে এক ব্যক্তি কল করে রুপিগুলো নির্দিষ্ট একটি স্থানে পৌঁছানোর জন্য নির্দেশ দেবেন। সেখানে যাওয়ার পর দ্বিতীয় ব্যক্তি ফকরুলের কাছ থেকে ফোন করে মালামাল বুঝে নেবেন। এক্ষেত্রে আগাম কারো নাম্বার ফকরুলকে দেয়া হয়নি। উল্টো ফকরুলের নাম্বার সিন্ডিকেট সদস্যদের কাছে ছিল। এ ঘটনার পর তাদের আর সন্ধান পাওয়া যায়নি।

সূত্রমতে, টাকা পরিবহনের জন্য তাকে ১০০০ ডলার দেয়ার কথা ছিল। পাশাপাশি ঢাকায় একটি পাঁচ তারকা হোটেলে রাত্রিযাপনের প্রলোভনও দেখানো হয়। কিন্তু তার আগেই তিনি ধরা পড়ে যান। ধরার পড়ার পর তার মোবাইলে আসা একটি ফোন কলের সন্ধান পাওয়া যায়। ওই নাম্বারটি শুধু ফকরুলের ব্যবহূত মোবাইলে একবারই কল করা হয়েছিল বলে তদন্তে উঠে এসেছে। এমন ঘটনার পর থেকে ওই মোবাইল ফোন সেটের আর অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ