সিগারেটের ফেলে দেয়া টুকরা থেকে গত এক বছরে ৩১৯৩টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া বৈদ্যুতিক গোলযোগ ও ইলেকট্রিক-গ্যাস-মাটির চুলা থেকে আগুনের ঘটনা ঘটেছে ১১,৮৭৭টি। সব মিলিয়ে ২০২১ সালে ২১ হাজার ৬০১টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় মারা গেছেন ২১৯ জন নারী-পুরুষ। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২১৮ কোটি ৩১ লাখ ৯৭ হাজার ৪০৩ টাকা। অসেচনতার কারণে বিড়ি-সিগারেট থেকে প্রায় ১৫ শতাংশ আগুনের সূত্রপাত বলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের বার্ষিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
ফায়ার সার্ভিসের অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান জানান, ভবনকেন্দ্রিক নিরাপত্তা না থাকার কারণে অগ্নিদুর্ঘটনা বেশি হচ্ছে। যে কোনো ভবনকেন্দ্রিক আগুন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ঠিক থাকলে দুর্ঘটনার হার অনেক কমে আসবে। এটা মডার্ন ফায়ার সেফটির ব্যবস্থাপনা।’
তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিস ছাড়াও অনেক সংস্থা নাগরিকদের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করে থাকে। সব সংস্থা সমন্বিতভাবে কাজ করলেই আগুনের কারণে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব। পাশাপাশি বিড়ি-সিগারেটের ফেলে দেয়া জ্বলন্ত টুকরা থেকে ১৪.৭৮ শতাংশ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। অথচ আগুন নিভিয়ে টুকরাগুলো ফেলে দিলে এ ধরনের আগুন থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব হতো। একটু সচেতন হলে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত আগুন থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।
জানা গেছে, গত বছর দেশে বিভিন্নস্থানে আগুনের জন্য সম্ভব ২০টি কারণ নির্ণয় করেছে ফায়ার সার্ভিস। যেসব কারণে ২১ হাজার ৬০১টি অগ্নিকাণ্ডে ঘটনা ঘটে। এরমধ্যে চুলা থেকে ৩৯২২, বৈদ্যুতিক গোলযোগে ৭৯৫৫, বিড়ি-সিগারেটের ফেলে দেয়া জ্বলন্ত টুকরায় ৩১৯৩, খোলা বাতির ব্যবহার ৪০৩টি, জ্বালানি থেকে ৪৭৯, ছোটদের আগুন নিয়ে খেলায় ৫৮৬, যন্ত্রাংশের ঘর্ষণে ১৬০, ইচ্ছাকৃত অগ্নিসংযোগ ১৬৭, বজ্রপাতে ৬৭, আতশবাজিতে ১৬, উচ্চতাপে ৯৪, মেশিনের মিস ফায়ারে ৭৬, স্বতঃস্ফূর্ত প্রজ্বলন ১০, চিমনির স্ফুলিঙ্গ ১১, স্থিরবিদ্যুৎ ৭টি, রাসায়নিক বিক্রিয়ায় ১১, সিলিন্ডার-বয়লার বিস্ফোরণে ১০৫, গ্যাস সরবরাহ লাইনের আগুন ৭৮৯, যানবাহনের দুর্ঘটনাজনিত কারণ ২৬৯ ও ৩২৮১ টি আগুনের কারণ নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। এসব ঘটনায় আহত হয়েছে ৪১৭ জন পুরুষ ও ১৫৩ জন নারী। নিহত হয়েছে ১১৬ জন পুরুষ ও ১০৩ জন নারী। তবে ২১ হাজার ৬০১টি আগুনের মধ্যে ৬ হাজার ৮৩১টি আগুনে ফায়ার সার্ভিসের তৎপরতার প্রয়োজন হয়নি।
জানা গেছে, অগ্নিদুর্ঘটনায় প্রতি বছর শত শত কোটি টাকার সম্পদ পুড়ে ছাই হচ্ছে। প্রাণহানি হচ্ছে অসংখ্য মানুষের। বেশিরভাগ ভবনে বের হওয়ার জন্য বিকল্প সিঁড়ি না থাকার কারণে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। একইসঙ্গে এসব ভবনে আগুন নেভানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও ছিল না। গত বছর সর্বোচ্চসংখ্যক ১৪২ নারী-পুরুষ নিহত হন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের আগুনে। এছাড়া বস্তিতে ২ জন, গ্যাস সরবরাহ লাইনের আগুনে ২, গ্যাস সিলিন্ডারে-৮, বহুতল ভবনে-৬, অন্যান্য ভবনে-১২, যানবাহনের আগুনে ১৭, মার্কেট-দোকান ও হাটবাজারে-১১ ও অন্যন্যা স্থানে অগ্নিকাণ্ডে ১৯ জন নিহত হন। আহত হন ৫৭০ জন নারী-পুরুষ।
করোনা মহামারির মধ্যেও গেল বছর ২৯ ধরনের স্থানে অগ্নিকাণ্ডের কথা উল্লেখ করেছে ফায়ার সার্ভিস। এরমধ্যে বাসাবাড়ি ও আবাসিক ভবনে সর্বোচ্চ ৫ হাজার ৮১৮ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। বহুতল ভবনে ১৪৩টি, রান্নাঘরে ৩ হাজার ৫৫৪টি। রান্না ঘরের আগুন ছিল ২০২০ সালের তুলনায় অন্তত ১ হাজার বেশি। এছাড়া শপিংমল ও মার্কেটে ৪৫৮টি, হাট-বাজারে ৭১০টি, দোকান (মুদি ও টংসহ) এক হাজার ৬৭৪টি, পোশাক শিল্প-প্রতিষ্ঠানে (রফতানিমুখী) ১৮০টি, পোশাক শিল্প-প্রতিষ্ঠানে (স্থানীয়) ৯৫টি, পোশাক শিল্প ব্যতীত অন্য কলকারখানায় ৩৮২টি, পাটগুদাম ও পাটকলে ১১৯টি, কেপিআই-এ ১৮টি, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৬১টি অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে (মসজিদ, মন্দির, গির্জা ইত্যাদি) ৫২টি, ব্যাংক-বীমা ও অন্যান্য অফিসে ৯৫টি, হোটেল-মোটেল-রেস্তোরাঁয় ২৭৩টি, হাসপাতাল-ক্লিনিক-ফার্মেসি-ল্যাবে ৯১টি, বেজমেন্টে ২৫টি, বস্তিতে ১৯৯টি, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ও উপকেন্দ্রে ১০৭টি, বিমান ও আকাশপথে চলে এমন যানে ১টি, নৌযানে (জাহাজ, লঞ্চ, স্টিমার ইত্যাদি) ১২৭টি, ট্রেনে ১টি, গাড়িতে (স্থলপথে চলে এমন সব যান) ২৮০টি, গ্যাসলাইন ও গ্যাস সিলিন্ডারে ৮৯৪টি, বয়লারে ৯টি, এসিতে ৩৯টি, বন-জঙ্গলে ১৬৫টি, গোশালা ও খড়ের গাদাসহ এ ধরনের স্থানে ২৪৩৯টি অগ্নিকাণ্ড হয়। এর বাইরে অন্যান্য স্থানে তিন হাজার ৬০২টি অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞদের মতে, বাসাবাড়িতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে হচ্ছে। এর জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী সচেতনতার অভাব। আর কলকারখানাগুলোতে বিল্ডিং কোড না মানার ফলে অগ্নিকাণ্ড বাড়ছে। শর্টসার্কিটের অগ্নিদুর্ঘটনা রোধে বড় ব্যবসায়িক ভবনে ফায়ার স্টপার লাগানো এবং সব ভবন বা বাসাবাড়িতে ফায়ার এক্সটিংগুইশার রাখারও পরামর্শ দেন তিনি। নতুন ভবন নির্মাণে বিদ্যুৎবিষয়ক প্রকৌশলীদের সার্বক্ষণিক তদারকির ওপরেও জোর দেন এ বিশেষজ্ঞ। বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরো ও চুলা থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা প্রতিরোধে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন তিনি।
ফায়ার সার্ভিসের দেয়া তথ্যমতে, গত এক বছরে পুকুর, ডোবা খাল ও নদীপথে ৮৮৭ টি দুর্ঘটনা ঘটে। এরমধ্যে ১৭৭টিতে ফায়ার সার্ভিসের কোনো তৎপরতার প্রয়োজন পড়েনি। এসব ঘটনায় ৫২৪ জন পুরুষ ও ১২৯ জন নারী নিহত হন। আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় ১৪৯ জন নারী-পুরুষকে। বিভাগওয়ারি হিসেবে বেশি ঘটনা ঘটেছিল ঢাকায় ২৯৮টি। এছাড়া চট্টগ্রামে ১৩৫টি, রাজশাহীতে ১০৪টি, খুলনায় ৮৫, বরিশালে ৩, সিলেটে ৪৬, রংপুরে ১১৬ ও ময়মনসিংহে ১০০টি ঘটনা ঘটে।
নয়া শতাব্দী/এসএম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ