গত ২২ জানুয়ারি ভোর ৫টা। সাইনবোর্ড এলাকার মাছ ব্যবসায়ী মাহির উদ্দিন। মাছ কিনতে যাত্রাবাড়ী আড়তে যাওয়ার জন্য সাদ্দাম মার্কেট মেইন রোড থেকে একটি লেগুনায় ওঠেন। গাড়িটি যাত্রাবাড়ী মাছের আড়তের সামনে না থেমে গুলিস্তানগামী ফ্লাইওভারের ওপর উঠে যায়। যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা বরাবর ফ্লাইওভারের ওপর লেগুনার ড্রাইভার, হেলপারসহ ডাকাত দলের সদস্যরা সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে চলন্ত গাড়ি থেকে মাহিরকে ফেলে দেন।
এতে তার মৃত্যু হয়। প্রথমে দুর্ঘটনা মনে হলেও পরে তদন্তে ডাকাতি ও হত্যা বলে প্রমাণিত হয়। এর একদিন পর রমনায় ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে সর্বস্ব খোয়ান ভারতীয় দুই নাগরিক। এ ঘটনার সপ্তাহ পার না হতেই গতকাল শনিবার ডাকাতের ছুরিকাঘাতে ডেমরায় সাইফুল ইসলাম নামে এক ট্রাক চালক খুন হন। সংঘবদ্ধ ডাকাত দলের সদস্যরা এ সময় তার কাছে থাকা টাকা ও মোবাইল ফোন নিয়ে যায়। শুধু এ তিনটি ঘটনাই নয়- সম্প্রতি ভোর-সকালে রাস্তায় বেড়ে গেছে ছিনতাইকারী ও ডাকাত আতঙ্ক। এমন পরিস্থিতিতে ভোরের নিরাপত্তায় নতুন করে কপালে চিন্তার ভাজ পড়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের।
অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে শীতের দিনে রাজধানীতে ভোরে রাস্তায় নিরাপত্তা ঘাটতির কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। এ কারণে ভোরে টহল টিমকে আরো সজাগ হওয়ার পাশাপাশি সন্দেহভাজন যানবাহনে তল্লাশি বাড়ানো উচিত। এতে কিছুটা হলেও অপরাধীদের কন্ট্রোল করা সম্ভব হবে। জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ) কৃষ্ণ পদ রায় নয়া শতাব্দীকে বলেন, সম্প্রতি রাজধানীতে কিছু ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ আবার তাদের আইনের আওতায়ও এনেছে। দু-একটি ঘটনার তদন্ত চলছে। আশা করছি দ্রুতই তাদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে।’
তিনি বলেন, ভোরে রাজধানীর নিরাপত্তা আরো নিশ্চিত করতে এরই মধ্যে টহলপার্টিকে আরো সজাগ রাখা হয়েছে। নতুন করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা সাজানো হচ্ছে। জানা গেছে, শীতের দিনে রাতভর ডিউটি করে ভোরে ক্লান্ত হয়ে যায় পুলিশের টহল পার্টির সদস্যরা। তারা এসময় কোথাও থেমে একটু বিশ্রাম নেন। এই সুযোগটা কাজে লাচ্ছে অপরাধীরা। তাদের টার্গেটে থাকে ভোরের ব্যবসায়ীরা। বিশেষ করে মাছ-সবজি-ডিম বিক্রেতারা। কারণ এসময় এ ধরনের ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন পাইকরি বাজার থেকে মালামাল কিনে খুচরা বাজারে নিয়ে যান।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, দুইভাগে বিভক্ত হয়ে ছিনতাই ও ডাকাতি করে থাকে অপরাধীরা। এদের একটি গ্রুপ পুলিশের টহল পার্টির ওপর নজর রাখে। ওই গ্রুপটি মূল দলে থাকা অপরাধীদের কাছে পুলিশের অবস্থান জানিয়ে দেয়। এরপর তারা সুযোগ বুঝে অপরাধ ঘটিয়ে পালিয়ে যায়। গত ২২ জানুয়ারি রাজধানীর মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের ওপর পড়ে থাকা এক ব্যক্তিকে উদ্ধার করা হয়। পরে তাকে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। দুর্ঘটনায় অপমৃত্যু বলে লাশের ময়নাতদন্তও সম্পন্ন হয়। ঘটনার এক সপ্তাহ পর পুলিশ উদ্ঘাটন করেছে সেটি অপমৃত্যু নয়, হত্যা। এর নেপথ্যে রয়েছে লেগুনার হেলপার ও যাত্রীর বেশে থাকা একটি চক্র। নিহত ব্যক্তির নাম মাহির উদ্দিন। তিনি মাছ ব্যবসায়ী ছিলেন।
ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) শাহ ইফতেখার আহমেদ বলেন, ‘প্রথমে ঘটনাস্থলের উপস্থিত ব্যক্তিরা অস্বাভাবিক মৃত্যু হিসেবে ধরে নেন। থানায় একটি অপমৃত্যু মামলাও হচ্ছিল। কিন্তু মৃত্যুর ধরন ও কথিত দুর্ঘটনাস্থলের পরিস্থিতি দেখে সন্দেহ হয়। এরপর তদন্ত শুরু করে রহস্য পাওয়া যায়। পরে জানা যায় ওই ব্যক্তিকে ছিনতাইকারীরাই হত্যা করেছে।’ এ ঘটনায় জড়িত চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা হলেন— রিপন, রুবেল, মনজু ও আবদুর রহমান। তারা গত বৃহস্পতিবার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। মাত্র ৫ হাজার টাকা ছিনিয়ে নিতে তারা হত্যা করেন।
তিনি বলেন, গত ২২ জানুয়ারি ভোর ৫টায় মাহির উদ্দিন মাছ কিনতে যাত্রাবাড়ী আড়তে যাওয়ার জন্য সাইনবোর্ডের বাসা থেকে বের হন। তিনি সাদ্দাম মার্কেট মেইন রোড থেকে একটি লেগুনায় ওঠেন। গাড়িটি যাত্রাবাড়ী মাছের আড়তের সামনে না থেমে গুলিস্তানগামী ফ্লাইওভারের ওপর উঠে যায়। যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা বরাবর ফ্লাইওভারের ওপর লেগুনার ড্রাইভার, হেলপারসহ ডাকাত দলের চার সদস্য চলন্ত গাড়ি থেকে মাহিরকে ফেলে দেন। পরে সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে একটি লেগুনা গাড়ি শনাক্ত করা হয়। এরপর ২৫ জানুয়ারি ফরহাদ নামের ওই ড্রাইভারকে তার শ্বশুরবাড়ি মাদারীপুর থেকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর তার দেয়া তথ্যমতে বাকী তিনজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
গত ২৩ জানুয়ারি ভোরে দুই সপ্তাহের ছুটিতে নিজ দেশে যাওয়ার উদ্দেশে হোস্টেল থেকে বের হন ডা. সিরাজুল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দুই ভারতীয় শিক্ষার্থী শাহীল আহমেদ ও আসিফ ইকবাল। তারা মগবাজার এলাকার একটি হোস্টেলে থাকতেন। সেখান থেকে বের হয়ে গ্রামীণ চেক শো-রুমের সামনে পৌঁছালে একটি সাদা রঙের প্রাইভেটকার তাদের গতিরোধ করে। এরপর গলায় চাপাতি ধরে তাদের সঙ্গে থাকা একটি ট্রলি ব্যাগ, একটি হ্যান্ডব্যাগ, একটি ল্যাপটপ, দুটি মোবাইল ফোন, ৫৭ হাজার ভারতীয় রুপি, নগদ ৭ হাজার ৬ টাকা ছিনিয়ে নেয়। এ ঘটনায় মামলা দায়েরের পর ২৮ জানুয়ারি রাজধানীর ও কেরানীগঞ্জ এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৭ জনকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেফতারকৃতরা হলেন—ফখরুল ইসলাম ফকু, আলমাস, সামুন, আবদুল্লাহ আল ইউসুফ আহম্মেদ আসিক, শাহিন, বাবু ও শফিকুল ইসলাম। এ সময় তাদের কাছ থেকে ডাকাতির কাজে ব্যবহূত একটি প্রাইভেটকার, দুটি চাপাতি, লুটে নেয়া একটি ল্যাপটপ ও একটি মোবাইলসহ ১৮টি মোবাইল, ৪৩ হাজার ৯৫০ ভারতীয় রুপি ও নগদ তিন হাজার টাকা জব্দ করা হয়।
ডিবির যুগ্ম কমিশনার. মাহবুব আলম বলেন, মামলাটির ছায়া তদন্তের ধারাবাহিকতায় শুক্রবার কেরানীগঞ্জ মডেল থানা ও ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ডাকাত দলের সাত সদস্যকে গ্রেফতার করে ডিবি রমনা বিভাগ। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা ডাকাতির ঘটনায় তাদের সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করেছেন। গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। এ ঘটনায় পলাতক আরো একজনকে গ্রেফতারে অভিযান চালানো হচ্ছে।
জানা গেছে, এ ঘটনার আগে রাতভর বাসে ডাকাতদের হাতে নির্যাতিত হয়ে সর্বস্ব খোয়ান টাঙ্গাইল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক শফিকুল ইসলাম। ফেসবুকে তিনি অভিযোগ করে একটি পোস্ট দেন, সেখানে তিনি বলেন, গত ২০ জানয়ারি জরুরি প্রয়োজনে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন। ওইদিন রাত সাড়ে ১০টার পর ঢাকা থেকে আর টাঙ্গাইল যাওয়ার বাস নেই। তিনি ও তার বন্ধু আবদুল্লাহপুর যখন পৌঁছান, তখন রাত প্রায় সাড়ে ১২টা। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা হয়ে রাজশাহীগামী একটি বাসের চালককে হাত দেখালেও থামেনি। এর কিছুক্ষণ পর ঢাকা-রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জগামী একটি বাস দেখতে পেয়ে আবারো হাত দেখান তারা। বাসটি থেমে যায়। এরপর দুই বন্ধু দ্বিতীয় সারির দুটি আসনে বসেন পাশাপাশি। বাসটা একটু অন্ধকার, কেমন একটু ফাঁকা ফাঁকাও মনে হয়েছিল। জিজ্ঞাসা করতে বাসচালকের সহকারী বলেন, বেশির ভাগ যাত্রীই ঘুমোচ্ছেন। আরো যাত্রী পথ থেকে উঠবেন। দেড় শ টাকা ভাড়া মিটিয়ে দুজনেই এরপর গা এলিয়ে দেন। কামারপাড়া পার হওয়ার পর বেশ নির্জন একটা জায়গায় গিয়ে তাদের ওপর সাত থেকে আটজন ঝাঁপিয়ে পড়ে। একজন গলায় , আরেকজন পেটে ছুরি ধরে তাদের। তার বন্ধুকে বাসের পেছনের দিকে নিয়ে যায়। অকথ্য ভাষায় গালাগাল, চড়থাপ্পড় চলে। একজন বললেন, ‘এই বাসের সব ডাকাত।’
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ